"আমাদের সন্তানাদি ইতিহাস পড়ে না, হিটলারের শয়তানি কর্মকান্ড জানে না, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতায় অজ্ঞ, বয়স যাদের ত্রিশ, জানেই না বার্লিনসহ দুই জার্মানি বিভক্ত ছিল (এবছর - নভেম্বরে- বার্লিন দেওয়াল ধ্বসের ত্রিশ বছর), পূর্ব জার্মানি, পূর্ব ইউরোপ কমিউনিস্ট শাসিত। আগামীতে নাতিনাতনীরা জানবে না, ইউরোপে একদা সময় চেঞ্জ হতো।" পাশের বাড়ির প্রৌঢ় ভদ্রলোক (জার্মান) আরও বললেন, "সময় চেঞ্জের জন্য যে অপেক্ষা, এর মধ্যেও রোমান্টিকতা আছে। ঝলমলে স্ফুর্তি এবং বিষাদও আছে। কাজকর্ম, নিদ্রার ফারাক বিষয়টি উপেক্ষনীয় নয়।"
ভদ্রলোকের কথার 'শানেনয়ুল' (সংক্ষিপ্ত, মূল কথা) বুঝতে অপারগ। জানতে চাই, কি বলতে চান। খোলসা করেন, "দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে ইউরোপে শীত ও গ্রীষ্মকালে সময় পাল্টানো হয়েছে তিনবার। ১৯৮২ সালে পাল্টানো সময় এখনও চলছে। দুই বছর পরে আর চলবে না।" বলে, প্রতিবেশী বিমর্ষ।
মার্চের শেষ রবিবারে সময় চেঞ্জ, এক ঘন্টা এগিয়ে। অর্থাৎ, রবিবারের মধ্যরাত্রির পরে পরবর্তী দিন, একঘন্টা বাড়তি। ছিল রাত্রি তিনটি, হয়ে গেল চারটি। শীতকালে এক ঘন্টা কম। শীতে এক ঘন্টা পিছিয়ে, গ্রীষ্মে এক ঘন্টা বাড়তি। এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর গ্রীষ্মের সময়, এক ঘন্টা এগিয়ে, অক্টোবর থেকে মার্চ এক ঘন্টা পিছিয়ে।
ঘন্টার এই আগুপিছু নিয়ে আবহাওয়ার বিজ্ঞানীদের নানা তর্কবিতর্ক তিন দশকের বেশি। ইউরোপে। কী কার্যকারণে এক ঘন্টার পরিবর্তন? প্রকৃতি ও পরিবেশে কী হেরফের? আবহাওয়ার একদল বিশেষজ্ঞ-বিজ্ঞানী বলেছেন, ঋতু পরিবর্তনে মানুষের দেহমনে-মানসিকতায় ওলটপালট। মনো চিকিৎসকদের একদলের ভিন্ন কথা। "ছয়মাসের ঠিক একদিন পরেই শরীরস্বাস্থ্য, মন মানসিকতা পাল্টায় না। অন্তত মাসাধিক সময় দরকার। শীতকালে (মার্চ অবধি) যে মানুষ গরম জামাকাপড় পরে, মার্চের ৩১ তারিখের পরে, গ্রীষ্মের শুরু-কাল হিসেবে কি হালকা পোশাকে (গ্রীষ্মের পোশাক) সজ্জিত? না। আবহাওয়ার (ক্লাইমেট) পরিবর্তনে এপ্রিলেও রীতিমতো ঠান্ডা। গায়ে গরম পোশাক, বিছানায় লেপ দরকার। এও বাহ্য। ঘরে হিটার আবশ্যক।
- ২৯ মার্চে মিউনিখসহ বাভারিয়া রাজ্যে দিনে ১৭ তাপমাত্রা (গরম), রাতে মাইনাস (২)। বার্লিনে ১৯ (দিনে, গরম) রাতে দুই। মাইনাস নয়। ঠান্ডা।
- কী করে তা হলে শীতগ্রীষ্মের সময় পাল্টানো জরুরি? আদৌ কি জরুরি?
গোটা ইউরোপের (ইইউ) সঙ্গে ব্রিটেনের সময়কাল এগিয়ে-পিছিয়ে। ব্রিটেন এক ঘন্টা পিছিয়ে। ইউরোপিয় ইউনিয়ন বলছে, ব্রিটেনের সঙ্গে তালাক (ব্রেক্সিট) কেন আমরা সময় (শীত-গ্রীষ্মে) পাল্টাবো? গ্রীষ্মে যে সময়, শীতেও একই সময় থাকবে। ঘড়ির কাঁটা পাল্টাবো না। ইইউ (ইউরোপিয় ইউনিয়ন)-এর মাতব্বররা চাইলেই হবে না। জনগণ কী বলছে? চাই গণভোট।
- জার্মানরা গণভোটে আস্থাশীল। সরকারও। যেমন, বার্লিনের পয়লা বিমানবন্দর (১৯০৬ সালে প্রতিষ্ঠিত), 'ফ্লগ হাফেন টেমপেলহোফ'-এর আশেপাশের বাসিন্দারা বললেন, "শব্দদূষণে আমরা অতিষ্ঠ।" গণভোট হলো। মাত্র একুশজনের ভোট বিমানবন্দরের বিপক্ষে। ব্যস, বন্ধ।
- জনমত ও গণতন্ত্রে আস্থাশীল। হোক তা একজনের ভোটে। ইউরোপে সময় পাল্টানো জরুরি কি না, শীত ও গ্রীষ্মে, গণভোটে জার্মানরা গণভোটে বিভক্ত। ৫৪ ভাগ মানুষ চান, শীত-গ্রীষ্মে সময় (ঘন্টা) আগুপিছু হোক। ৪৩ ভাগ চান একই সময়।
- এই নিয়ে চমৎকার বিতর্ক। উপভোগ্য। আবহাওয়াবিদ এবং ডাক্তারদের (শরীর বিশারদ) নানা মত।
যতই তর্কবিতর্ক হোক, ইউরোপিয় ইউনিয়নের এক গোঁ, ২০২১ সাল থেকে সময়ের (ঘন্টার) হেরফের নয়। অর্থাৎ শীতের তিনটে, গরমেরও তিনটে। সময়ের ব্যবধানে না কী বিশ্বব্যাপী ব্যবসা বাণিজ্যে ঝামেলা।
সময়ের (একঘন্টা) রদবদলে, প্রতিবেশী বলেছিলেন, "আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম জানবে না ইউরোপের সময়ের যে ইতিহাস ছিল, ঐতিহাসিক কারণ ছিল, উল্লেখিত হবে না পাঠ্যবইয়ে। যেমন হয় না হিটলারের সব অতীত, কমিউনিস্ট পূর্ব জার্মানি, পশ্চিম জার্মানির আগ্রাসন এবং আজকের আগ্রাসী ধনতন্ত্রের বেলেল্লাপনায় সামাজিক-মানবতার ধ্বংসের মূলে কে, কারা। ইউরোপে সময়ের ব্যবধান মানবিকতার চেয়ে রাজনৈতিক, মানুষ নিমিত্ত।"