লোকসভা ভোটের দামামা বেজে উঠেছে দেশে। উন্নয়নের ভারতবর্ষে ভুখা কৃষকের আত্মহত্যা থেকে শুরু করে সন্ত্রাসবাদী বিস্ফোরণে চল্লিশ সেনা জওয়ানের অপমৃত্যু, সবকিছুকে নিজের সুবিধামতো বাজারমূল্যে বেচে বা নিলামে দর হাঁকিয়ে আসন্ন নির্বাচনে নিজের ও নিজের দলের আখের গোছানোর মহালগ্ন সমাগত। সেই লগ্নে রাজনীতি বিষয়ে কিছু লিখতে গেলে প্রত্যাশিত এটাই, যে কোনো একটি পক্ষ অবলম্বন করতে হবে (যেহেতু নিরপেক্ষ রাজনীতি বলে আদতে কিছু হয় না), তারপর এই মুহূর্তের প্রয়োজন মাথায় রেখে, অর্থাৎ নির্বাচনী জয়-পরাজয়ের অঙ্কটি বুঝে নিজের পছন্দের দল বা জোটের সুবিধা হয় এবং বিপক্ষের অসুবিধা হয়, এমনভাবে কিছু লিখতে হবে। এটাই দস্তুর। এতে অন্যায় কিছু নেই, বরং এটা প্রয়োজনীয় কাজ।
লাঠি-বন্দুকের ভোট দখলের বদলে প্রাক নির্বাচনী যুক্তি-তক্কো-গপ্পো অনেক বেশি গণতান্ত্রিক। বলা যায় জনমতকে প্রভাবিত করার ন্যায়সংগত এবং বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি এটাই। তাছাড়া নির্বাচনে নির্বাচকদের (অর্থাৎ ভোটদাতাদের) রাজনৈতিক ভুল হলে তার মাশুল দিতে হয় তাঁদের এবং সারা দেশকে। সরকারের মেয়াদ পাঁচ বছর হলেও নির্বাচিত সরকারের হাতে থাকে এমন ক্ষতি করে যাবার ক্ষমতা, যার জের চলতে পারে সুদীর্ঘ সময়। অবশ্যই সদিচ্ছাসম্পন্ন সরকারের হাতে থাকে দীর্ঘস্থায়ী সুফলপ্রদ কাজ করে ফেলার ক্ষমতাও। অর্থাৎ নির্বাচনে নাগরিকের অংশগ্রহণ স্বতঃস্ফূর্ত, সচেতন ও সুবিবেচনাপ্রসূত হওয়া অতি গুরুত্বপূর্ণ।
আরও পড়ুন, রাষ্ট্র, সরকার, দেশ: প্রেম
সুতরাং এই বিশেষ সময়টিতে নির্দিষ্ট মত বা আদর্শের হয়ে উঠে দাঁড়ানো, চিহ্নিত অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো এবং কলমকে এই মুহূর্তের জরুরি লড়াইয়ের হাতিয়ার করা ন্যায্য কাজ। তবু ঠিক এই কাজটুকু করার জন্য এই সিরিজ লিখছি না। এই সময়ের জরুরি কাজটি না করে চাঁদ-ফুলের রোম্যান্টিকতা, বিশুদ্ধ জ্ঞানের বা অরাজনৈতিক সাহিত্যের চর্চা করা কী অসম্ভব নিন্দনীয়, সেই বিষয়ে অনেক সচেতন মানুষ নিয়মিত বলছেন এবং ফেসবুকাদি জনমুখপত্রে লিখছেন। তাঁদের সঙ্গে আমি একমত। এই গুরুত্বপূর্ণ সময়টি অরাজনৈতিক বিলাসিতায় অতিবাহিত করতে আমিও রাজি নই। লেখার বিষয় তাই আবশ্যিকভাবে রাজনৈতিক। সমস্যা হল, কোনো একটি নির্দিষ্ট দল বা জোটের ওপর ভরসা রাখলে এবং নির্বাচনে নিজের পছন্দমতো কিছু করে ফেলতে পারলেই সমস্যা মিটে যাবে, বা তার বেশ কিছুটা সুরাহা হবে, এমন আশাবাদের ভার বহুবছর ধরে বহন করতে করতে আমাদের কাঁধ ক্লান্ত এখন। আশার বোঝা ঘাড়ে নিয়ে বারবার মুখ থুবড়ে পড়তে পড়তে ভেঙে গেছে নাগরিক পাঁজর। উঠে দাঁড়ানোর ক্ষমতা এখনো ফুরিয়ে যায়নি, কিন্তু ওঠার পদ্ধতিটার মধ্যে কোথাও গলদ থেকে যাচ্ছে এই প্রতীতি ক্রমশ দৃঢ়তর হচ্ছে।
এ লেখা শুরুর মুহূর্তে চাকরির দাবিতে লাগাতার অনশন করছেন স্কুল সার্ভিস কমিশনের ওয়েটিং লিস্টে থাকা শিক্ষকেরা। তাঁদের পাশে দাঁড়িয়ে সরকারকে কেউ প্রশ্ন করছেন না, অথচ সরকারি দল দুজন অভিনেত্রীকে প্রার্থী করেছেন বলে দুয়ো দিতে ব্যস্ত সেই রাজ্যবাসীরাই। পাশাপাশি নগ্নভাবে শুরু হয়েছে প্রার্থী হিসেবে টিকিট না পেলেই দল বদলে এতদিনের শত্রুর তরফে সহসা সেনাপতির ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়ার খেলা।
নাটকে দ্বৈত চরিত্রে অভিনয় করার অভিজ্ঞতা আছে। দৌড়ে গ্রীনরুমে গিয়ে পোষাক বদলে আসতেও এর চেয়ে বেশি সময় লাগত আমাদের। অথচ পেশাদার রাজনীতিবিদের ছদ্মবেশে ভানুমতীর খেল দেখানো এই অপেশাদার অভিনেতাদের দুয়ো দেয় না ভারতীয় ভোটারকুল, প্রশ্ন করে না ন্যূনতম আনুগত্যের অভাবকে। ভারতীয় রাজনীতিতে ইংরেজি “ইন্টিগ্রিটি” শব্দটির অনুপস্থিতি নিয়ে ভাবিত নয় দেশবাসী, কিন্তু আমরা সুদিনের স্বপ্ন দেখি সোনার পাথরবাটির অস্তিত্বে বিশ্বাস রেখে। “অচ্ছে দিন” পাবার জন্য কোনো চেষ্টাই কি আমরা করেছি কোনো নেতার কর-ও-পদ্মে পরস্মৈপদী আস্থা স্থাপন ছাড়া? প্রশ্ন করেছি কি নিজেদের যোগ্যতাকে, চেতনাকে?
আমরা নিজেদের রাজনৈতিক বিশ্বাস বা অবস্থানকে প্রশ্ন করি না, কারণ প্রক্রিয়াটি কঠিন এবং অস্বস্তিকর। আমাদের নিষ্ঠাবান রাজনৈতিক নেতা-কর্মীরা সরকারকে বা অন্য কোনো ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীকে প্রশ্ন করার জরুরি কাজটি করে থাকেন। এই ক্ষেত্রে তাঁরা আম নাগরিকের তুলনায় বেশি তৎপর এবং সেই কারণে সম্মাননীয়, কিন্তু আত্মসমালোচনার ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষের মতোই সমাজের অগ্রপথিকেরাও প্রায়শ কুণ্ঠিত। এটাই প্রত্যাশিত, কারণ অপরকে প্রশ্ন করার মধ্যে একধরণের ক্ষমতায়ন আছে, আর নিজেকে প্রশ্ন করার মধ্যে আছে ভেঙে পড়ার ভয়। কিন্তু আমরা এই ভয়ের কাজটা এড়িয়ে যাই বলে রাজনৈতিক পট পরিবর্তন হলেও রাজনৈতিক পদ্ধতি আর প্রকরণগুলো একই থেকে যায়। এক ইস্যু এসে অন্য ইস্যুকে মুছে দেয়। খেলা চলতে থাকে। আমরা হাঁ হয়ে দেখি। সবকিছু গুলিয়ে যায় খেলা দেখতে দেখতে। আমাদের পরিস্থিতি একই থাকে।
গুলিয়ে দেবার খেলার একটা উদাহরণ দিই। বিভিন্ন অর্থনৈতিক সমস্যা থেকে দানা বেঁধে ওঠা রাজনৈতিক বিক্ষোভ ও আন্দোলন যখন ক্রমশ দিল্লীর অস্বস্তির কারণ হয়ে উঠছিল, এতটাই যে শুধুমাত্র ধর্মের জিগিরে ভর করে নির্বাচনী বৈতরণী নিরাপদে পার হবার ব্যাপারে নিশ্চিত হতে পারছিলেন না সরকারপক্ষ, ঠিক তখনি সন্ত্রাসবাদীদের চক্রান্তে এবং আভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা নিয়ন্ত্রণকারীদের গাফিলতিতে বা ব্যর্থতায় কাশ্মীরের রাস্তায় নিহত হলেন চল্লিশজন ভারতীয় সেনা জওয়ান। জওয়ানদের অকালমৃত্যুতে শোকাহত হবার বদলে সকলে ঝাঁপিয়ে পড়ল এই ভয়াবহ ঘটনা থেকে ফায়দা তুলতে। এই কাজে সরকারপক্ষের সক্রিয়তা ছিল চমকপ্রদ ও ভীতিকর। দেশপ্রেমিক বনাম দেশদ্রোহীর বিভাজন ও রেটরিককে প্রায় চিল চিৎকারে পরিণত করে এক উন্মাদনার সৃষ্টি করা হল, যার উদ্দেশ্য বহুমুখী। হইচই সৃষ্টি করে কৃষকদের মহামিছিল থেকে শুরু করে যাবতীয় অর্থনৈতিক দুরবস্থার দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে দেওয়া পাকিস্তানের দিকে এবং দেশপ্রেমের ধ্বজাধারী সেজে লোকসভা নির্বাচনে জয় নিশ্চিত করার চেষ্টার পাশাপাশি এটাও নিশ্চিত করা গেল, সেনার মৃত্যুতে সরকারের গাফিলতি নিয়ে কেউ প্রশ্ন তুলতে না পারে।
আরও পড়ুন, মিমি-নুসরত এবং ট্রোলের অন্ধকার জগৎ
এই অবধি সহজবোধ্য, যদিও দেশের অধিকাংশ বিভ্রান্ত করা গেছে এই পদ্ধতিতেই। এর পরের ধাপে বাকিদেরও ভাবনা গুলিয়ে যায়। জাতীয়তাবাদের আগুনে নিজের ভাত গরম করার চেষ্টা বিজেপিই প্রথম করছে না। দেশপ্রেমিক সাজার তাগিদে আফজল গুরুকে তড়িঘড়ি ফাঁসি দিয়েছিল কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন ইউপিএ সরকার। ঘটনাচক্রে তাতে তাদের কার্যোদ্ধার হয়নি। পরবর্তীকালে দিল্লীর জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ে এই ফাঁসির প্রতিবাদ এমনভাবে হল আর কংগ্রেস তাতে এমনভাবে যোগ দিল, যে মনে হল যেন বর্তমান সরকারই ফাঁসির জন্য দায়ী। আশ্চর্যজনকভাবে (আসলে প্রত্যাশিতভাবে) বিজেপি দায় এড়ানোর চেষ্টা করল না, বরং সমাবেশকারীদের ধরপাকড় করে একপ্রকার যেচে দায় নিল নিজেদের ঘাড়ে। এভাবে পরের দায় ঘাড়ে নেওয়া ছিল তাদের পক্ষে রাজনৈতিকভাবে লাভজনক। দেশপ্রেমিকের একচ্ছত্র কপিরাইট হস্তগত করতে বিজেপি নেতৃত্ব তখন ব্যস্ত।
এই নাটক আমাদের দেখানো হল। আমরা দেখলাম। সরকারপক্ষ যখন শুধুমাত্র বিরোধীদের নয়, যাবতীয় সংশয়ী স্বরকেই দেশদ্রোহী দাগিয়ে দিতে ব্যস্ত, তখন সেকুলার বুদ্ধিজীবীরা সন্ত্রাসবাদের সমালোচনা করতে ভুলে যান এবং “দেশদ্রোহী” শব্দটিকে “রিক্লেম” করার মরিয়া প্রচেষ্টায় নিজেদেরকেই দেশদ্রোহী বলা শুরু করলেন। এই জাতীয় আধুনিক চিন্তার প্রয়োগে সোশাল মিডিয়ায় শিক্ষিত জনগণের একাংশকে অবশ্যই প্রভাবিত করা যায়, কিন্তু গরিষ্ঠসংখ্যক সাধারণ ভারতবাসীর মনে সত্যিই দেশদ্রোহী হিসেবে চিহ্নিত হবার ভয় থাকে, একথা বাম মনস্ক নেতারা বিলক্ষণ জানেন। জেনেও এই কাজই তাঁরা করেন, বারবার করেন। আসলে ধর্মোন্মাদ বনাম সেকুলার নাটকে বিজেপি যেমন সচেতনভাবেই খলনায়ক সেজে থেকেছে এতদিন, তেমনি এই দেশপ্রেমিক বনাম দেশদ্রোহী নাটকে কে ভিলেন সাজবে, তাও ঠিক করা আছে। গিরিশ ঘোষ থেকে শুরু করে অনেক বড় মাপের নাট্যপরিচালক নিজের নাটকে ভিলেন সেজেছেন। কোন অভিনেতা কোন ভূমিকায় অভিনয় করছেন, তার থেকে ঢের গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হল, নির্দেশনা কোথা থেকে আসছে? সেই প্রশ্নের উত্তর না জানলেও এটুকু জেনে রাখা ভালো যে নায়ক আর খলনায়ক একই নির্দেশকের তত্ত্বাবধানে একটি কাহিনীকে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলেন এবং দর্শকদের ব্যস্ত রাখেন।
নাটকের উপস্থাপনা এবং আমাদের দেখা নিয়ে নানান প্রশ্নে বিদ্ধ হওয়া এই সিরিজের অন্যতম উদ্দেশ্য। অর্থনীতি এবং রাজনীতির শিক্ষা অত্যন্ত কম হওয়ায় সুবিধা এই যে একেবারে সাধারণ মানুষের জায়গা থেকেই এসব প্রশ্ন বা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে পারব। এপ্রিল-মের সময়সীমা, ভারতের ভৌগোলিক সীমা বা রাজনৈতিক মল্লযুদ্ধের রিং-এর সীমায় আবদ্ধ থাকা হয়ত হয়ে উঠবে না। কী করে থাকব? লিখতে বসে কি মন থেকে মুছে ফেলতে পারছি ক্রাইস্টচার্চের গুলিচালনা বা দক্ষিণেশ্বরে পুড়ে যাওয়া পঞ্চাশটি ঘরের কথা? এদের ঘিরে কি প্রশ্ন নেই, আতঙ্ক নেই? সব প্রশ্নের পাবো না হয়ত, কিন্তু খোঁজা চলবে। চলবে লড়াই, বেঁচে থাকার।
(লেখক চিকিৎসক। মতামত ব্যক্তিগত।)