বেঁচে থাকার লড়াই মানুষের চিরকালই ছিল। সভ্যতার ঊষালগ্ন থেকে নয়, তারও আগে থেকে। বস্তুত এই লড়াই মানুষের একার নয়, জীবমাত্রেরই। তবে অন্যান্য জীবের থেকে মানুষের লড়াই চরিত্রগতভাবে আলাদা। অন্যান্য জীব যেখানে প্রধানত প্রকৃতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিজেদের প্রাকৃতিক নির্বাচনের উপযুক্ত করে তুলতে চেষ্টা করে, মানুষ সেখানে প্রকৃতি ও প্রতিবেশকে নিজের উপযুক্ত করে তোলাতেই বেশি জোর দিয়েছে।
সব জীবই প্রকৃতির উপর কমবেশি প্রভাব বিস্তার করার চেষ্টা করে। ব্যক্তিগত পরিসরকে সুরক্ষিত রাখার চেষ্টাও দেখা যায়। শুধু যে সিংহ হায়নাকে বিতাড়িত করে বা বাঘ হত্যা করে নিজের এলাকায় ঢুকে পড়া অন্য বাঘ বা সমগোত্রীয় শিকারীকে, তা নয়, উদ্ভিদও নানা রাসায়নিক নিঃসরণ করে নিজের পছন্দ-অপছন্দ জাহির করে থাকে, নির্বাচন করে প্রতিবেশী। আবহাওয়াও অল্পবিস্তর প্রভাবিত হয় সব উদ্ভিদ ও প্রাণীর দ্বারাই। কিন্তু এই সবকিছুই হয় প্রকৃতির এক অলিখিত নিয়ম মেনে, তাতে সকলের অংশগ্রহণ থাকে আর প্রত্যেকের হাতে থাকে সীমিত ক্ষমতা ও অধিকার। মানুষ চিরকাল চেষ্টা করেছে এই সীমা পেরোতে। ক্ষমতা বৃদ্ধির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়তে থেকেছে ক্ষমতা জাহির করার পরিসর। এর জন্য নিজের শরীরের ওপর নির্ভরতা ছেড়ে ক্রমশ যন্ত্রের উপর নির্ভরশীল হয়েছে এই প্রজাতি, মূলত মেধাকে কাজে লাগিয়ে। যন্ত্রের উন্নতির সঙ্গেই মানুষের শক্তিও হয়ে উঠেছে অপ্রাকৃত এবং লাগামছাড়া। এভাবে সভ্যতা যত এগিয়েছে মানুষ সরে এসেছে মানিয়ে নেওয়ার প্রাকৃতিক ব্যবস্থা থেকে এবং মানিয়ে চলার মানসিকতা থেকেও। এই সরে আসার চিহ্ন মানুষের দর্শন ও রাজনীতিতে সুস্পষ্ট।
আরও পড়ুন, লোকসভা নির্বাচন ও সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা
একইভাবে প্রকৃতির নিয়মের বিরুদ্ধে প্রতিস্পর্ধা দেখানোর অভ্যাসে সূচিত হয়েছে নিয়মকে পেরিয়ে যাবার, অগ্রাহ্য করার বা নিয়মের বিরুদ্ধে বিক্ষুব্ধ হবার মানবিক প্রবণতা। সভ্যতার প্রসারের সঙ্গে প্রকৃতির নিয়মগুলিকে না মানার ক্ষমতা মানুষের উন্নতির পরিমাপ হয়ে উঠেছে ক্রমশ। প্রাকৃতিক ব্যবস্থাগুলোকে নিজের ইচ্ছেমতো পাল্টে নেবার প্রয়োজনে বহুক্ষেত্রে নিয়মগুলোকে কাটাছেঁড়া করে বুঝে নেবার চেষ্টাও হয়েছে। এই চেষ্টার নাম বিজ্ঞান। বোঝার পর জবরদস্তি মানুষের পছন্দানুযায়ী ঘটনা ঘটানোর নাম প্রযুক্তি (টেকনোলজি)। এভাবে প্রকৃতিকে মাটিতে পেড়ে ফেলে তার শরীর ও মনের ওপর আমাদের আধিপত্য কায়েম করার পুরুষালি পদ্ধতিটিকে অবলম্বন করেই আমরা ক্রমশ আধুনিক হয়েছি। আমরা যখন বিজ্ঞান, যুক্তিবাদ, উন্নয়ন ইত্যাদির স্তুতিগান করি এবং এসবের ভিত্তিতে সমাজ, দেশ ও প্রশাসকের সাফল্য-ব্যর্থতার হিসেব করি, তখন আমরা এই পৌরুষের আস্ফালনকেই স্বীকৃতি দিই। কিন্তু আধিপত্যবাদ কোনো সংকীর্ণ পরিসরে আবধ্য থাকতে পারে না। মানুষ শুধুমাত্র প্রকৃতির ওপর আধিপত্য করবে আর নিজেদের মধ্যে আদান-প্রদান হবে সম্পূর্ণ সাম্যের আদর্শে, এমনটা হবার কথা নয়। আমাদের প্রজাতিগত পৌরুষের দিগবিজয়ের ইতিহাস আদতে পিতৃতন্ত্রের বিকাশের ইতিহাসের সঙ্গে ওতপ্রোত।
অতি জটিল হয়ে ওঠা আধুনিক মানুষের সমাজব্যবস্থাকে বোঝাতে “পিতৃতান্ত্রিক” শব্দটি সঠিক হলেও এই শব্দটির কারণে বোঝার ভুল বা ভুল বোঝাবুঝি তৈরি হতে পারে। বদলে “আধিপত্যবাদী “ বললে হয়ত সুবিধা হবে, কারণ এই ব্যবস্থাটি আধিপত্য বিস্তার করার ক্ষমতার ভিত্তিতে গড়ে উঠেছে এবং এই ব্যবস্থায় শোষণ সংঘটিত হয় শুধুমাত্র লিঙ্গের ভিত্তিতে নয়, শারীরিক শক্তি, আর্থিক অবস্থান, মেধা ও চাতুর্যের তারতম্য, পেশা, দেশ, গাত্রবর্ণ, ধর্ম, ইত্যাদি অনেককিছুর ভিত্তিতে। আধুনিক সমাজে মানুষের ক্ষমতা (বা ক্ষমতার তারতম্য) মূলত অর্থনীতির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হলেও অন্যান্য দিকগুলোর কথা একেবারে ভুলে গিয়ে “অর্থনৈতিক নির্ধারণবাদ”কেই রাজনৈতিক দর্শন করে ফেললে মানবমন আর মানবসমাজের অনেকটাই না বোঝা থেকে যাবে।
মানুষের সমাজে প্রাকৃতিক নিয়মগুলোর বদলে ক্রমশ মানুষের তৈরি নিয়ম আরোপিত হয়েছে। এইসব নিয়ম অবশ্যই সম্পূর্ণ খামখেয়ালি নয়, এসব গড়ে ওঠারও একটা ঐতিহাসিক প্রক্রিয়া আছে, কিন্তু একথা অনস্বীকার্য যে প্রাকৃতিক নিয়মের মতো সামাজিক নিয়ম রচনায় সকলের সমান অংশগ্রহণ নেই। আসলে প্রাকৃতিক নিয়মাবলির তো কোনো একজন রচয়িতা নেই, সব জীবের (এবং জড়ের) যৌথ যাপনে স্বাভাবিকভাবেই গড়ে উঠেছে সেই বিধিমালা, যা সবার ওপর সমানভাবে প্রযোজ্য। মানুষের সমাজেও শুরুতে পারস্পরিক বোঝাপড়ার ভিত্তিতেই কিছু রীতিনীতি গড়ে উঠতে আরম্ভ করে, কিন্তু গোষ্ঠী ও গোষ্ঠীপতির জন্মের সঙ্গে সঙ্গেই এসব নিয়ম থেকে সাম্য মুছে যেতে আরম্ভ করে। সমাজ ক্রমশ বড়, জটিল এবং সংগঠিত হবার পর যেসব লিখিত বা মান্য নিয়ম তৈরি হয়েছে, ধর্মীয় অনুশাসন বা দেশের আইন হিসেবে, সেগুলোর নির্দিষ্ট রচয়িতা আছেন। অর্থাৎ একজনের বা একটি দলের হাতে ন্যস্ত থেকেছে নিয়ম তৈরির ক্ষমতা। এই সময় থেকেই নিয়মগুলো কৃত্রিম এবং সকলের অধিকারকে সমানভাবে তুলে ধরতে ব্যর্থ হতে শুরু করেছে। সভ্যতা যত এগিয়েছে, ক্ষমতার তারতম্য যত বেড়েছে, আইন রচনায় দুর্বলের অংশগ্রহণ তত কমেছে। স্বাভাবিকভাবেই আধুনিক আইনসমূহ সাধারণ মানুষের পক্ষে দুর্বোধ্য, প্রায়শ তাঁদের নাগালের বাইরে এবং এর প্রয়োগব্যবস্থা সর্বদা দুর্বলের প্রতি সদয় নয়। অবশ্যই গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা সাধারণ মানুষের সামনে কিছুটা অংশগ্রহণের সুযোগ তৈরি করেছে, কিন্তু তা কাগজে-কলমে যতটা, বাস্তবে ততটা নয়। প্রতিশ্রুতি আর বাস্তবের এই পার্থক্যের আলোচনায় এই মুহূর্তে যাবো না। আপাতত নিয়মের বিরুদ্ধে মানবিক বিক্ষোভের কথা মনে রেখে এটুকু বলে রাখি, প্রাকৃতিক নিয়মের ক্ষেত্রে যে ক্ষোভ বা মানতে না চাওয়া আছে, কৃত্রিমভাবে চাপিয়ে দেওয়া নিয়মের ক্ষেত্রে তা আরো বেশি হওয়াই স্বাভাবিক। অতএব আইন চাপিয়ে দেবার চেষ্টা, তার ফাঁকফোকর খোঁজা, আইনের দেওয়ালে সিঁধ কাটা আর তার লৌহকপাট ভাঙার হিংস্র লড়াই… এসব মিলে এই বহুমাত্রিক কর্মকাণ্ড মানুষের সমাজজীবন আর রাজনীতিতে প্রকট হবে, এটাই প্রত্যাশিত। সমাজ ও রাজনীতি নিয়ে ভাবার সময় একথা মাথায় রাখলে সুবিধে হয়।
বাঁচার লড়াইয়ের ক্ষেত্রে, বা বলা ভালো এই লড়াইকে বোঝার ক্ষেত্রে আধুনিক মানুষ আরো এক জায়গায় অদ্ভুত। বেঁচে থাকার জন্য জীবজগতকে যেসব লড়াই লড়তে হয়, তার মধ্যে একটা হল অন্য প্রজাতির বিরুদ্ধে, একটা অংশ প্রাকৃতিক শক্তিগুলোর সঙ্গে, আর শেষ একটা অংশ নিজের প্রজাতির অন্যদের সঙ্গে। প্রথম দুটি লড়াই অনেক বড় এবং প্রজাতিগুলির বেঁচে থাকার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। তৃতীয় অংশটি প্রজাতির মধ্যে নির্দিষ্ট একজনের বেঁচে থাকতে কাজে লাগে। এই আভ্যন্তরীণ প্রতিযোগিতা হয়ত সুস্থতম জিনের প্রবাহ নিশ্চিত করতেও কাজে লাগে, কিন্তু প্রকৃত প্রস্তাবে এই তৃতীয় গোত্রের লড়াই প্রথম দুটির পাশে অপেক্ষাকৃত ছোট। অথচ আধুনিক মানুষের সমাজতত্ত্ব আর রাজনৈতিক ভাবনা দেখলে মনে হয় যেন প্রথম দুটি লড়াই চিরকালের জন্য জেতা হয়ে গেছে, বাকি শুধু অন্তঃপ্রজাতি সংগ্রাম। রাজনীতি বলতে আমরা সাধারণত যা বুঝি, তা নিতান্তই এই শেষ অংশটুকুর মধ্যে জেতার প্রয়াস। কে কাকে কেন জেতাতে চাইছেন, তা দল বা মত অনুসারে আলাদা, কিন্তু আমাদের সবচেয়ে উন্নত ও মানবদরদী রাজনৈতিক ভাবনাগুলিও মূলত বিরোধভিত্তিক, কারণ তা প্রজাতির আভ্যন্তরীণ লড়াই নিয়েই ব্যস্ত।
আধুনিক মানুষের ব্যক্তিগত মনন, চাহিদা, স্বার্থবোধ, স্বপ্ন, হতাশা… সবকিছুর মূল নিয়ন্তা হয়ে উঠছে এই অন্তঃপ্রজাতি (intraspecific) সংগ্রামের মানসিক প্রভাব। না পাওয়া নিয়ে ততটা দুঃখ নেই, যতটা আছে অন্যের চেয়ে কম পাওয়া নিয়ে। মরে যাওয়া নিয়েও ততটা ক্ষোভ নেই, যতটা আছে অপরের কাছে হেরে যাওয়া নিয়ে। আমাদের প্রতিটি অসুবিধার জন্য আমরা একজন অপরাধী খুঁজি, এমন এক মানুষ বা জনগোষ্ঠী খুঁজি, যাকে দোষী সাব্যস্ত করা যায়। স্কুলের পরীক্ষা থেকে মাঠের খেলা, আমাদের সব সাফল্যের মাপকাঠি কোনো এক অপরকে পরাজিত করতে পারা।
আমাদের গৃহস্থালির রাজনীতি থেকে আমাদের আন্তর্জাতিক রাজনীতি, ফেসবুক থেকে পার্লামেন্ট, সর্বত্র এই “নেইবার্স এনভি, ওনার্স প্রাইড”-এর কাহিনি। অপরের চেয়ে এগিয়ে থাকাটুকুতে আবদ্ধ মধ্যবিত্ত জীবনসংগ্রাম আমাদের। “অপর” বলতেও আমরা চিনি শুধু প্রতিবেশী আর পরিচিতকে। তাকে বা তাদেরকে হারিয়ে দিতে পারাই আমাদের জীবনের লক্ষ্য। বাজার এই মনোভাবকে কাজে লাগিয়েই সমুদ্র-মন্থন করে তুলে আনে ওনিডা টিভি ও হলাহল। টেলিভিশন সেট সে তুলে দেয় সর্বোচ্চ বাজারদর দিতে আগ্রহী ক্রেতার হাতে আর হলাহলপাত্র তুলে দেয় অনুগত রাজনৈতিক নেতাদের হাতে। তাঁরা আমাদের ডাক দেন নানা ভাষায়… “মিত্রোঁ”, “ “বন্ধুগণ”! মুগ্ধ আমরা উন্মুখ এগিয়ে গেলেই তাঁরা আমাদের গলায় ঢেলে দেন দু'চামচ, চোখে দেন দু'ফোঁটা, কানেও। আমাদের দৃষ্টিতে, শ্রবণে, বাচনে, যাপনে ছড়িয়ে পড়ে বিষ। আমাদের শরীর জ্বলতে থাকে, মন জ্বলতে থাকে, আর আমরা হিংস্র হয়ে উঠি নিকটতম অপরের বিরুদ্ধে। চাকরি না পাওয়া নিম্ন-মধ্যবিত্ত হিন্দুর মনে হয় তার দুঃখের জন্য দায়ী শীতের মরসুমে শাল বিক্রি করতে আসা কাশ্মীরি মানুষটি, সাধারণ ভারতবাসীর মনে হয় তার দুঃখের জন্য দায়ী পাকিস্তানি মানুষেরা... পৃথিবীর মানচিত্র থেকে দেশটিকে মুছে দিতে পারলেই জগতের সমস্যা মিটে যাবে, আর সিরিয়ায় পাড়ি দিয়ে ইসলামিক স্টেটের সৈন্যদলে নাম লেখানোর স্বপ্ন দেখা কলেজ পড়ুয়া তরুণ ভাবে একদিন সে ফিরে এসে স্বদেশকে কাফিরমুক্ত করবে। এভাবে আমরা পরস্পরকে ছোবল দিতে থাকি আর টিভির পিছনে লুকিয়ে থাকা নীল-চক্ষু দানব মুচকি হেসে তার অনুগত নেতার পিঠ চাপড়ে দেয়।
“র্যাশনাল অ্যানিম্যাল” তকমাটি মানুষ নিজেই নিজেকে দিয়েছে। নিজের পিঠ চাপড়ে আমরা এতই খুশি যে নিজেদের যুক্তি-বুদ্ধিকে প্রশ্ন করার প্রয়োজন বোধ করি না। লোভ আর স্বার্থপরতাই বুদ্ধির একমাত্র পরিচয় কিনা, বা আত্মধ্বংসী রাজনীতিতে ঠিক কতটা বুদ্ধির পরিচয় আছে, এসব জরুরি প্রশ্ন আমরা এড়িয়ে যাই। আদতে পৃথিবীর প্রাণীকুলের মধ্যে মানুষই সবচেয়ে বোকা কিনা, তার উত্তর ভবিষ্যতই দেবে, কিন্তু আমরা যদি আমাদের জীবনবোধ আর (রাজ)নীতির খোলনলচে বদলানোর জন্য এখনি উদ্যোগী না হই, তবে আমাদের প্রজাতির ভবিষ্যৎ অতি সংক্ষিপ্ত।