দিল্লির পাঁচ সাংবাদিক (ইংরেজি ও হিন্দি কাগজের) বার্লিনে (পশ্চিম) এসেছেন দুই দিনের জন্য, পশ্চিম জার্মান সরকারের আমন্ত্রণে। ৯ নভেম্বর, ১৯৮৯, চলে যাবেন বার্লিন ছেড়ে। ফ্রাঙ্কফুর্ট হয়ে দেশে। বললুম ওঁদের, "দুইদিন থেকে যান, যদি সম্ভব। সাংঘাতিক ঘটনা ঘটবে, শুধু জার্মানিতে নয়, গোটা বিশ্বে। ইতিহাসের প্রত্যক্ষ সাক্ষী হবেন।" জানতে চান, "কী হতে পারে?" বলি। বিশ্বাস হয় না ওঁদের।
একজন বলেন, "তাই কি সম্ভব? কোনও বিপ্লব হলেই, যে দেশেই হোক, বহুবিধ গুজব ছড়ায়, আখেরে লবডঙ্কা। পূর্ব জার্মানির মাথার ওপরে রাশিয়া, গর্বাচভ, সব বিপ্লব যথাসময়ে গুঁড়িয়ে দেবেন। মনে রাখবেন, গর্বাচভের জিগরি দোস্ত এরিখ হোনেকার (পূর্ব জার্মানির রাষ্ট্রকর্তা), তাঁকে রক্ষা করবেন যে কোনও মূল্যে। যদি কিছু সাংঘাতিক ঘটনা ঘটে, রয়টার্সে খবর দেবেন।" আরেক সাংবাদিকের কথা, "আমরা সরকারের অতিথি, ইচ্ছে করলেও থাকতে পারব না, ফিরতেই হবে। ভিসাও ৯ তারিখে শেষ, বাড়াবেও না হয়তো। ইতিহাস থেকে বঞ্চিত হচ্ছি, এক্সক্লুসিভ স্টোরি করারও সুযোগ হারাচ্ছি। বরং আপনিই লিখুন।"
ঠিক যে, 'সাংঘাতিক ঘটনা ঘটবে' বললেও, একশো ভাগ নিশ্চিত নই, রাজনীতির ব্যাপার, যে কোনও মুহূর্তে ওলটপালট। কিন্তু দৃশ্য ও ঘটনাবলীর পরম্পরায় স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর, যে 'অঘটন' আসন্ন। সময়ের ব্যবধান মাত্র।
জার্মান রেডিও ডয়েচ ভেলের (Deutsche Welle) বাংলার একমাত্র সংবাদদাতা, বিশেষ প্রতিনিধি। বার্লিনে কাজ করি, হেড অফিসের (তখন কোলনে) নির্দেশ, নির্দেশদাতা বিভাগীয় প্রধান আবদুল্লা আল ফারুকের, "সকাল থেকে পূর্ব বার্লিনে ঠাঁই নাও।" এই নির্দেশ ৬ নভেম্বরের। ৬ নভেম্বর থেকেই ঘটনা টালমাটাল। বার্লিন থেকে ছুটছি লাইপজিগে। রিপোর্ট পাঠাচ্ছি। লাইপজিগে দিনভর আন্দোলন। এবং এই আন্দোলন 'ফ্রাইহাইট' (Freiheit)। বাকস্বাধীনতা, মানব স্বাধীনতার।
লাইপজিগের রাস্তাঘাটে দেখি হাজার হাজার মানুষ, 'ফ্রাইহাইট, ফ্রাইহাইট' চিৎকারে মুখর। হাতে পতাকা। নেতৃত্বে লাইপজিগের একজন পাদরি (ধর্মযাজক)। তাঁকে ঘিরে উন্মাদনা। বলা হয়, তিনিই 'ফ্রাইহাইটের' মূল পাণ্ডা। সরকারি প্রচারণা। তাই কি? তাহলে ফ্রাউ বারবেল বোলাইয়ের (Frau Berbel Bolei) ভূমিকা ছিল না কোনও?
আমরা জানি, বারবেল বোলাই মাসের পর মাস পূর্ব বার্লিন সহ পূর্ব জার্মানির বিভিন্ন শহরের চার্চে গিয়ে, শনি ও রবিবারে, প্রার্থনার সময়কালে, চার্চে সমবেত প্রার্থনাকারীদের 'ফ্রাইহাইটের' আন্দোলনে উজ্জীবিত করেছেন। বিপদে পড়েছেন। স্টাসি (Stasi, পূর্ব জার্মানির গোয়েন্দা পুলিশ)-র খপ্পরে বহুবার নাজেহাল।
বারবেল বোলাই মূলত 'ফ্রাইহাইট' আন্দোলনের নেত্রী। তাঁর দোষ, কমিউনিস্ট তিনি। 'ফ্রাইহাইট' চেয়েছেন ঠিকই, কিন্তু দুই জার্মানির মিলন তথা একত্রিকরণ চান নি। পশ্চিম জার্মান সরকার (আজকের জার্মান সরকার) তাঁকে ইতিহাস থেকে মুছে দিয়েছে। মোছার মূলে প্রয়াত প্রাক্তন চ্যান্সেলর হেলমুট কোল।
পূর্ব প্রসঙ্গে ফিরছি। ৯ নভেম্বর, ১৯৮৯। দিনমান ঝিরঝিরে বৃষ্টি। শীতের অশ্লীল ঠাণ্ডা। সঙ্গে বাতাস। 'ফ্রাইহাইটের' আন্দোলনে পূর্ব জার্মানি টগবগে। আন্দোলনকারীদের আশ্বস্ত করার জন্য পলিটব্যুরোর ম্যারাথন মিটিং। গুজবে প্রকাশ, ওই বৈঠকে এরিখ হোনেকার অনুপস্থিত। মিখাইল গর্বাচভকে ফোন করে পাচ্ছেন না। মস্কোর নির্দেশ পেলে 'ফ্রাইহাইটের' আন্দোলন ধূলিসাৎ করবেন। না পাওয়ায় পলিটব্যুরোর গুন্টার সাবোস্কি (Gunter Schawoski) এক পৃষ্ঠার 'বয়ান' লেখেন। ওই বয়ানের প্রথম লাইন, 'আজ থেকে পূর্ব জার্মানরা পশ্চিম বার্লিনে যেতে পারবেন...' "ভিসা নিয়ে", কথাটি আর উচ্চারিত হয় নি। "যেতে পারবেন" শুনেই জনতা উদ্বেলিত, ছুটতে থাকে বার্লিনের চেক পয়েন্টে (পূর্ব-পশ্চিমের বর্ডারে)। মুহূর্তেই ভেঙে যায় চেক পয়েন্টে নিয়মাবলী। সে এক দৃশ্য। না দেখলে অবিশ্বাস্য। নিজের চোখকে বিশ্বাস করি না। 'ফ্রাইহাইটের' কী উন্মাদনা, আকুতি। বার্লিন দেওয়াল পতনের সূত্রপাত। দেওয়াল ধ্বসে পশ্চিম বার্লিনবাসীরাই শাবলহস্ত।
জানিয়ে রাখা ভালো, যেহেতু দেখেছি, বার্লিন দেওয়াল ধ্বংস করেনি পূর্বের একজনও, করেছে পশ্চিম বার্লিনের মানুষ। যেমন, বার্লিন দেওয়াল চিত্র (গ্রাফিটি), এঁকেছে পশ্চিম বার্লিনের শৌখিন শিল্পীরা। নানা রঙে। নানা বিষয়ে। নিসর্গ দৃশ্য থেকে প্রতিকৃতি, নারীপুরুষের নগ্নতাও বাদ যায় নি। ছবির নীচে কোনও শিল্পীর নাম নেই। পূবের একজন শিল্পীরও দেওয়ালের আরেক পিঠে ছবি আঁকা দূর অস্ত, দেওয়ালের আধ কিমি'র আশেপাশে যাওয়ার হিম্মত ছিল না। গেলেই গুলি (পূর্ব জার্মান পুলিশের)। রাতের অন্ধকারে যাঁরা দেওয়াল টপকানোর চেষ্টা করেছেন, অনেকেই নিহত। অনেকেই দেওয়ালের বদলে বেছে নিয়েছেন বনবাদাড়। অনেকেই সফল, অধিকাংশই ব্যর্থ। গুলিতে নিহত।
গোটা পূর্ব জার্মানির সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া। দিনরাত পুলিশের টহল। প্রতি এক কিমি পরপর পুলিশের চৌকি। টাওয়ার। অন্তত ২৫ ফুট উঁচু টাওয়ারের উপরে ছোট্ট ঘর। ছোট্ট ঘুলঘুলি। পাহারাদার তথা ওয়াচম্যান (পুলিশ)। চোখে দূরবীন, হাতে রাইফেল।
বার্লিন দেওয়াল ছিল ১৬১ কিমি। শুরুতে অবশ্য দেওয়াল নয়। কাঁটাতারের বেড়া। দুই সপ্তাহ পরে কংক্রিট দেওয়াল গাঁথার কাজ। নির্দেশ এসেছে মস্কো থেকে। ১৬১ কিমি দেওয়াল নির্মাণে সময় লেগেছে তিন বছরের বেশি।
কাঁটাতারের বেড়ার কাজ ১১ অগাস্ট, ১৯৬১ সালে (পরে দেওয়াল তৈরি), বারনাউয়ার স্ট্রাসে (Bernauer Strasse) তথা সড়কে। বারনাউয়ার স্ট্রাসে বেছে নেওয়ার কারণ, এক ফারলং দূরেই পাঙ্কো জেলা। এখানে সোভিয়েত রাশিয়ার সৈন্যঘাঁটি। পশ্চিম বার্লিন অ্যালায়েড ফোর্সের দখলে।
বারনাউয়ার স্ট্রাসের এপারে পশ্চিম বার্লিন, ওপারে পূর্ব। রাস্তা মাত্র ২০ ফুট চওড়া। এপারে এখন, অর্থাৎ পশ্চিম বার্লিনে, তৈরি করা হয়েছে 'মাউয়ার মিউজিয়ম' (দেওয়াল যাদুঘর), যদিও সেখানে দ্রষ্টব্য বিশেষ কিছু নেই।
৯ নভেম্বর, ১৯৮৯, সন্ধ্যা আটটায় প্রথম পূর্ব বার্লিনের চেক পয়েন্ট খোলা হয় প্রেনসলাউয়ার ব্যার্গের বোর্নহোলমার স্ট্রাসে (এই সড়ক ২২ অগাস্ট, ১৯০৩ সালে নির্মিত)। রাত বারোটার আগে আরও চারটি চেক পয়েন্ট। স্মরণীয়, সব চেক পয়েন্ট নয়, ১১ তারিখের মধ্যে বাকিগুলো।
বার্লিনের অন্যতম আকর্ষণীয় স্থান, ট্যুরিস্টদের জন্য, পোটসডামার প্লাৎস। এই পোটসডামার প্লাৎস ছিল 'নো-ম্যান'স ল্যান্ড'। পশ্চিম বার্লিন অংশে ছিল তিন কিমি ম্যাগনেট ট্রেন। ট্যুরিস্ট চড়ে দেওয়াল দেখতেন। তিন কিমি দেওয়াল। প্রশস্ত। বার্লিনের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের পাশ ঘেঁষে উঁচু দেওয়ালের গায়ে কোনও এক বাঙালি ছবি না এঁকে বিরাট অক্ষরে লাল কালিতে লিখেছে, 'শালা'।