Advertisment

ব্যর্থ কে? কলকাতায় ফণী নাকি হুজুগে বাঙালি?

রেললাইনের সঙ্গে লোহার চেন দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে ট্রেনের বগি। বলা হল ঝড়ের দাপটে নাকি ট্রেন বেলাইন হতে পারে কারশেডে। এর সত্যতা কতটা তা কিন্তু পরিষ্কারভাবে বললেন না রেল কোম্পানির কোনও অধিকর্তা।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
Fani, Fani And Reality

কলকাতা বেঁচে গেছে ফণীর রোষ থেকে

শুরুতেই স্বস্তির শ্বাস ফেলা যাক। ভুবনেশ্বরের আশেপাশে যা ঘটেছে তার সরাসরি খবর পেয়েছি সেই জায়গার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক বা ছাত্রদের কাছ থেকে। ওড়িশার এই অঞ্চলকে লণ্ডভণ্ড করে দিয়ে গেছে প্রকৃতি। তার মধ্যেও মানুষকে অবশ্যই সাহায্য করেছে আবহাওয়া বিজ্ঞান। আগের থেকে জানা থাকায় সাবধান হয়েছে প্রশাসন, সতর্ক থেকেছেন সাধারণ মানুষ। এতো বড় একটা প্রাকৃতিক দুর্যোগের তুলনায় প্রাণহানি হয়েছে বেশ কম। ওড়িশার সরকার সময়োচিত ব্যবস্থা নিয়েছে। বিজ্ঞানের সাহায্য নিয়ে ভবিষ্যৎ দর্শনের কথা এখানে বারবার উঠে আসবে।

Advertisment

আবহাওয়া বিশ্লেষণ বিজ্ঞানের কোন মৌলিক শাখা নয়। পৃথিবীর ভূগোলের সঙ্গে সে আজকের দিনে নির্ভর করে থাকে অঙ্ক, পদার্থবিজ্ঞান, বিভিন্ন ধরনের প্রযুক্তি এবং দূর যোগাযোগব্যবস্থার উন্নতমানের বৈদ্যুতিন যন্ত্রপাতির ওপর। বিশেষ করে কৃত্রিম উপগ্রহ থেকে তোলা ছবি, এবং তার ওপর নির্ভর করে দ্রুতগতিতে গণকযন্ত্রের অসংখ্য অঙ্ক কষার ক্ষমতা আমাদের সাহায্য করে ভবিষ্যৎ সম্পর্কে একটা ধারণা দিতে। আবহাওয়ার বিষয়ে আজকাল অনেক কিছুই মিলে যায়। ঠিক সেই নিয়মেই গত দিন দিন ধরে আমরা বেশ ভালোভাবে জানতাম ঘূর্ণিঝড় ফণী সম্পর্কে। ভগবানের দয়ায় ফণী কলকাতায় কিংবা সে ভাবে ভাবতে গেলে পশ্চিমবঙ্গের কোন অঞ্চলেই তেমন ছোবল মারে নি। কলকাতার ওপর দিয়ে ঘণ্টায় একশো কিলোমিটার গতির ঝড় বয়ে গেলে কি হতে পারত তা ভাবলে শিউরে উঠতে হয়। সব মিলিয়ে পশ্চিমবঙ্গের প্রতিযোগিতামূলক সাম্প্রদায়িকতায় অংশগ্রহণ করে বিধাতা, আল্লা, যীশু, এবং আর বিভিন্ন ধর্মের যে সমস্ত দেবদেবী আছেন তাঁরাই আমাদের রক্ষা করেছেন।

অর্থাৎ এখানে যেটা বলা প্রয়োজন তা হল ওড়িশায় বিজ্ঞানকে হাতিয়ার করে সরকারের যে প্রস্তুতি সেখানে বিজ্ঞান ভবিষ্যতকে দেখতে পেয়েছিল ঠিকঠাক। ক্ষতি কিছু হয়েছে, কিন্তু সব মিলিয়ে সে পরিমাণ সীমিত। পশ্চিমবঙ্গে ক্ষতি প্রায় কিছুই হয় নি, তার কারণ বিজ্ঞান অকৃতকার্য। যে ভয় দেখানো হয়েছিল, তা একেবারেই ঠিক নয়। আবহাওয়াবিদরা যদি বারবার বলেন যে ব্যাপক ঝড় হবে কলকাতায়, এবং যখন অজ্ঞ হলেও পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে যে ঝড় কলকাতায় আসছে না, সেই সময়েও বিভিন্ন গল্প বানিয়ে যদি মানুষকে বোঝানোর চেষ্টা হয় অনাগত ভয়াবহতার কথা, তাহলে সে ব্যর্থতা বিজ্ঞানীর, সে ব্যবসা সংবাদমাধ্যমের, সে অপ্রয়োজনীয় উত্তেজনা ভোটপিপাসু রাজনৈতিক দলের।

ভাবুন একবার পশ্চিমবঙ্গের কথা। ঝড়ের সরলরৈখিক গতিবেগ বলা হচ্ছে ঘণ্টায় ২০ কিলোমিটারের আশেপাশে। এটা কিন্তু ঘূর্ণিঝড়ের আছড়ে পড়ার সময় বিধ্বংসী গতিবেগ নয়। ঝড় কীভাবে এগোচ্ছে তার গতিবেগ। সেই হিসেবে কলকাতা থেকে যখন কয়েকশো কিলোমিটার দূরে ঘূর্ণিঝড়, তখন থেকেই লাল সতর্কতা। শুক্রবার রাতের আগে কিছুই ঘটবে না সেকথা বোঝা যাচ্ছিল বারবার। তা সত্ত্বেও রাজ্য সরকারের ঘোষণায় এবং মিডিয়ার বাড়াবাড়িতে জনজীবন বিপর্যস্ত। অবশ্যই খোলা ছিল কিছু বেসরকারি বিদ্যালয়, কিন্তু সেখানেও পড়ুয়াদের পাঠাতে বিশেষ সাহস পান নি অভিভাবককুল। রেল কর্তৃপক্ষ বুঝেশুনেই বাতিল করেছেন বিভিন্ন ট্রেন। কিন্তু সংবাদমাধ্যমে দেখানো হল রেললাইনের সঙ্গে লোহার চেন দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে ট্রেনের বগি। বলা হল ঝড়ের দাপটে নাকি ট্রেন বেলাইন হতে পারে কারশেডে। এর সত্যতা কতটা তা কিন্তু পরিষ্কারভাবে বললেন না রেল কোম্পানির কোনও অধিকর্তা।

সব থেকে গোলমাল হল কলকাতা বিমানবন্দরে। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রকম ঘোষণা করা হল বিমানবন্দর বন্ধ থাকার বিষয়ে। সবথেকে বড় কথা তার অনেক আগে থেকেই বেসরকারি বিমান সংস্থাগুলো অকারণে বাতিল করতে শুরু করল বিভিন্ন উড়ান। শুক্রবার দুপুরে বিশাখাপত্তনম কিংবা ভুবনেশ্বরের কিছু উড়ানে গোলমাল হতে পারে একথা স্বাভাবিক। কিন্তু তার সঙ্গে সারা দেশের অন্যান্য বেশ কয়েকটি নির্ধারিত বিমান বাতিল করার কোন যুক্তিযুক্ত কারণ খুঁজে পাওয়া গেল না।

বিজ্ঞান তো ভবিষ্যতের কথা বলবে মোটামুটি ঠিকঠাক। লক্ষ্য করলে দেখবেন বিজ্ঞান থেকে পাওয়া তথ্য কিন্তু একবারও বলে নি যে শুক্রবার রাতের আগে কলকাতায় কোনও প্রাকৃতিক বিপর্যয় হবে। আবহাওয়াবিদরা যে গাদাগাদা বক্তব্য রাখলেন, তাতে কিন্তু এই অংশটা সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। অর্থাৎ বিদগ্ধ বিজ্ঞানীদের ব্যাখ্যায় ঘেঁটে গেল বৈজ্ঞানিক অনুসিদ্ধান্তের সঠিক নিয়ম। আর সংবাদমাধ্যমকে তো সংবাদ বিক্রি করেই বেঁচে থাকতে হয়। তাই দিঘায় সামান্য বৃষ্টির ছাঁট আর ঝোড়ো হাওয়া সারাদিন মশলামুড়ি মাখিয়ে পেশ করা হল দর্শকদের সামনে। সাদামাটা ঝড় বৃষ্টিতেই পেশাদার সাংবাদিকদের অনেকটা অভিনয় করতে হল ক্যামেরার সামনে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে শুক্রবার সারাদিন পেশ করা হল বিভিন্ন সতর্কবাণী। একবারও ভালোভাবে দেখা হল না বিজ্ঞান কী বলছে।

শনিবার সকালেও গল্প ভেসে বেড়াচ্ছে যে নদিয়া আর মুর্শিদাবাদ ঘুরে রাজশাহীর দিকে এগোচ্ছে সাইক্লোন। সপ্তাহান্তের উত্তেজনা আমাদের রাজ্য ছাড়িয়ে পড়শি দেশের দিকে। আর রাখালের পালে বাঘ না পড়লেও পরোক্ষভাবে ভোটপ্রচার কিছুটা হয়ে গেল বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের। মানুষের পাশে দাঁড়ানোর বার্তার ঘনত্বও বাড়ল অনেকটা।

তাই কলকাতার কান ঘেঁষে ফণীর উড়ে যাওয়ার খবর যতই স্বস্তির হোক না কেন, এর সঙ্গে জড়িয়ে থাকল ব্যাপক এক অস্বস্তির খবরও। তা হল সত্যিই কি কান ঘেঁষে গেল ফণী, নাকি লাল সতর্কতা নিয়ে অনেকটা বেশি বাড়াবাড়ি করা হল! কলকাতার চিকিৎসাক্ষেত্রেও অনুযোগ শোনা যায় যে সামান্য পেটব্যথা নিয়ে গেলে বিষয়টাকে কর্কট রোগের মাত্রায় পৌঁছে দিয়ে রুগীকে ভড়কে দেওয়ার প্রবণতা থাকে কিছু সুযোগসন্ধানী ব্যক্তির। সরকারি স্কুলগুলোতে হঠাৎ করে গ্রীষ্মকালীন ছুটি বেড়ে গেল একাধারে প্রচণ্ড গরম এবং ঘূর্ণিঝড়ের কারণে। কিন্তু একটা ঘটনাও ঘটল না। বরং আবহাওয়া বেশ মনোরম। আসলে বাঙালির বেশিটাই এখন ফাঁপা, গভীরে গিয়ে ভাবার সুযোগ কম। শুধু রাজনীতিকে দোষ দিয়ে লাভ নেই, বিষয়টা সামাজিক। হুজুগে বাঙালি তাই মেতে উঠল ঘূর্ণিঝড়ে, আর অবিমৃশ্যকারিতার ঠেলায় এ যাত্রায় ব্যর্থ বিজ্ঞান।

(শুভময় মৈত্র ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইন্সটিটিউটের অধ্যাপক, মতামত ব্যক্তিগত।)

kolkata Cyclone Fani
Advertisment