মাগো, তোমায় ভালো করে দেখার আগেই চোখ বন্ধ হল আমার। চলে গেলাম পৃথিবী ছেড়ে। বাবার স্নেহ-ভালোবাসা? সে তো দূর, বরং উল্টোটাই জুটলো কপালে। তোমার গর্ভ থেকে পৃথিবীতে আসার পর কিছুক্ষণ মাত্র বেঁচে থাকা মা! তারপরই নেমে এল মৃত্যুর কালো ছায়া। বাবা তুমি! তুমি আর আমার দাদু-ঠাকুমা-পিসি...তোমরাই দিলে আমায় মৃত্যুদণ্ড! কিন্তু কোন অপরাধে? বাবা গো, আমার এই পৃথিবীতে আসা কি আমার ইচ্ছায়? তা তো নয়! তোমাদের পুত্রসন্তান জন্ম দেবার আকাঙ্খা যে পূর্ণ হলো না, সে কি এই কন্যার দোষ?
মৃত্যুনিথর শরীরও কখনও কখনও বাঙ্ময় হয়ে ওঠে এভাবেই। জীবন ছেড়ে চলে গেলেও অন্তরাত্মা হাহাকার করে অব্যক্ত যন্ত্রনায়। এক প্রাণের আর্ত কান্না বহুগুণ হয়ে ছড়িয়ে পড়ে অনন্ত আকাশে। প্রতিধ্বনিত হয় প্রাণ হতে প্রাণে।
আরো পড়ুন: বাঁচিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে
সদ্যোজাত কন্যা সন্তানের মুখে নুন ঢুকিয়ে হত্যা করেছে তার পরিবার। তারপর বাড়িতেই মাটিতে পুঁতে রেখেছে শিশুটির দেহ। লিলুয়ায় ঘটা সাম্প্রতিক এ খবরে আরও একবার শিউরে উঠি আমরা। হৃদয় মথিত করে দীর্ঘশ্বাস ওঠে। লজ্জায় মুখ ঢাকি। এ লজ্জা আমার, আপনার, সকলের ! গোটা সমাজেরই মুখে কালিমা লেপে দেয় এই ধরনের ঘটনা। এই পরিবারটির বিরুদ্ধে অভিযোগ, এর আগেও আরও তিন কন্যাসন্তানকে এভাবেই হত্যা করেছিল তারা। অর্থাৎ এরা এই হত্যাকাণ্ডে রীতিমতো রেকর্ড সৃষ্টি করেছে এবং দিব্যি বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে।
যদিও শুধুই আইন করে এই প্রবণতা বন্ধ করা যাবে না। সমাজ সচেতন না হলে, আইনও চোখ বাঁধা হয়েই থাকবে। পরিসংখ্যান বলছে, নারী-পুরুষ আনুপাতিক হিসেবে সমাজে মেয়ের সংখ্যা কমতে কমতে বিপজ্জনক সীমায় পৌঁছেছে। এর ফলে কোনও এক সময় মানুষের জন্মচক্রের গতিটাই থমকে যাবে। এ নিয়ে আলোচনা, লেখালেখি, সচেতনতার প্রচারও চলছে। কিন্তু ফল এখনও নেতিবাচক। শুরুতেই যে নৃশংস ও মর্মান্তিক ঘটনার উল্লেখ করলাম, তা প্রমাণ করে আজও কন্যাসন্তান কতখানি অনাকাঙ্ক্ষিত।
নৈতিক, মানবিক কোনও ভাবনা বা যুক্তিই যে এখানে গ্রাহ্য নয়, তা বোঝা যায় পরিবারের লোকেদের এই পর্যায়ের নিষ্ঠুর হয়ে ওঠায়। কন্যাসন্তানের ভরণপোষণ পুত্রের তুলনায় ব্যয়সাধ্য, এটা তাদের যুক্তি। কারণ তাকে পাত্রস্থ করতে হবে। অন্যদিকে পুত্র না হলে বংশের গতি থেমে যাবে। কোনও নিরিখেই কি এই তত্ত্ব বা যুক্তি মানা যায়?
আজকের মাগগিগণ্ডার বাজারে সংসার পালনে একটি/দুটির বেশি সন্তান কাম্য নয়, সেকথা সবাই জানেন। সরকারি স্তরে জন্ম নিয়ন্ত্রণের পক্ষে প্রচার চলছে বহু যুগ ধরে। অথচ বহু পরিবারেই কন্যার দ্বারা বংশ রক্ষা হবে না, এই বদ্ধমূল ধারণা থাকায় ছেলের আশায় সন্তানের জন্ম দিয়ে চলেন। এরপর কার্যকারণে এমন যদি ঘটে, ছেলের আশা অপূর্ণই থেকে গেল ও একের পর এক মেয়ের জন্ম হলো, তখনও সেই মেয়েদের কপালেই যত দুর্ভোগ ও লাঞ্ছনা!
আরো পড়ুন: ডাক্তার পেটানো? আড়ালে রাজনীতিটা বুঝুন
ছেলে বা মেয়ে জন্মানোর পিছনে যে কিছু বৈজ্ঞানিক কারণ, যুক্তি বা ব্যাখ্যা আছে, সেসব জানা, শোনা এবং বোঝায় বহু তথাকথিত শিক্ষিত মানুষের মধ্যেও অনাগ্রহ লক্ষ্য করেছি। অন্যদিকে তাদের ঘরে যে কন্যারা এসেছে ঘটনাচক্রে, সেটাও যে সেই অভাগা কন্যাদের নিজের ইচ্ছেতে নয়, তাও কি মনে রাখেন অভিভাবকরা? মোদ্দা কথা, সব ক্ষেত্রেই অভিযোগের তিরটা কন্যাসন্তানের দিকে।
ছেলে বা মেয়ের মধ্যে বিভাজনের ক্ষেত্রে আর একটি ভাবনা কাজ করে, বুড়ো বয়সে দেখবে কে? অথচ একটি ছেলের মতো করেই মেয়েরাও বৃদ্ধ বাবা-মায়ের প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করেন। বিশেষত মেয়েরা স্বনির্ভর হওয়ার পর থেকে তো এর হারও বেড়েছে। উল্টোভাবে, ছেলে হলেই সে বাবা-মাকে বৃদ্ধ বয়সে দেখবে এমন গ্যারান্টি দেওয়া যায় কি? যদি বা দেখে, সেখানেও তো তাঁদের পুত্রবধূর একটি ভূমিকা থাকে। সেও তো কোনও পরিবারের কন্যা!
আমাদের শৈশবে বহু ঘরেই দেওয়ালে টাঙানো একটি শিল্পকর্ম চোখে পড়তো, 'সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে'। বাড়ির কোনও মহিলার হাতেই সৃজিত হতো সেই শিল্পকর্ম। তাঁরা এটা বিশ্বাস করতেন অন্তর দিয়ে। নিজেদের উজাড় করে দিতেন সংসারে। মেয়েরা তো কোনও কালেই সংসারে বহুল পরিমানে আদরণীয় ছিলেন না। তবু, সেকালের ওঁরা সংসারের জন্যই বাঁচতেন। আজও অধিকাংশ মেয়ে তাঁদের জন্ম সার্থক করে কন্যা, বধূ, মা, ভগিনী - এমন নানা পরিচয়ে বেঁধে রাখে সংসার। এগিয়ে নিয়ে চলেন পুরুষের জীবনচক্র।
আরো পড়ুন: শবরীমালার তাণ্ডবেও অম্লান নারীশক্তির আরাধনা
অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই তার চিরকালের। ঘটা করে মাতৃপূজা আর অন্দরে মায়ের অপমান, এই কি আমাদের গর্বের ঐতিহ্য? প্রতিটি কন্যাই তো মায়ের আর এক রূপ। কন্যা ঘরে না এলে, মা কোথা থেকে আসবেন? কেমন করে পাওয়া যাবে বোন, স্ত্রী, প্রেমিকা বা আরও নানা সম্পর্কের অনুষঙ্গ? কন্যা জন্মের পর, কখনও কখনও ভ্রূণ অবস্থাতেই তাকে হত্যা করে এই সমাজ মেয়েদের কাছে কোন বার্তা দিতে চাইছে? এরপর কি শুধু পুরুষই থাকবে এ সমাজে? লজ্জা হয় ভাবতে, অনেক মা-ও শুধু পুত্রবতী হওয়াকেই গৌরবজনক মনে করেন, মেয়েসন্তানের জন্য লজ্জিত তাঁরা। পরোক্ষে এই চরম অন্যায়, অবিচারের বৈষম্যকে তাঁরাও কি প্রশ্রয় দিচ্ছেন না?
সমাজ 'পুরুষশাসিত', শুধু এই 'কমফোর্ট জোন'-এ আর কতদিন থাকবেন মেয়েরা? মা-ও যদি কন্যাকে না চান, তাহলে অভিমানে মুখ ফেরাবে না সে? এই অভিমান পাহাড়প্রমাণ হয়ে গেছে ইতিমধ্যেই। পার হয়ে গেছে সাবধানতার সময়সীমা। বিশ্বের কথা জানি না। এদেশে, এরাজ্যে অভিমানী কন্যারা পৃথিবীর আলোর মুখ দেখা বন্ধ করলে পুরুষের কী হবে, সমাজ ভাবুক একবার। কল্পনা করে নিক সেই পৃথিবীর কথা, যেখানে মা-বোন-স্ত্রী-বান্ধবী নেই ! আর নতুন জন্মের উন্মেষ? মায়ের গর্ভ না থাক! বিকল্পে প্রাণহীন রোবটিক কিছু? জানি না, কতজন কন্যাসন্তান বিদ্বেষী এ প্রাণহীন পৃথিবীর বাসিন্দা হতে চাইবে।