Advertisment

স্বদেশি রাজনীতি, বিদেশি প্রচার

তৃণমূলের প্রচারে যদি দু-একজন বাংলাদেশের অভিনেতা বক্তব্য রাখেন, তাহলে তৃণমূলের ওপর বিরক্ত সংখ্যাগুরুদের বাম-কংগ্রেসের তুলনায় বিজেপির দিকে যাওয়ার প্রবণতা বাড়বে। খুচরো তর্কে পা বাড়িয়ে রাজ্যের জনগণ তখন উন্নয়নের বিভিন্ন সূচক নিয়ে প্রশ্ন তুলতে ভুলে যাবেন।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
তৃণমূল কংগ্রেস, tmc, bjp,

রায়গঞ্জে তৃণমূল কংগ্রেসের প্রচারে বাংলাদেশের নায়ক ফিরদৌস।

কোনও দেশে ভোট হলে অবশ্যই নজর থাকে আশেপাশের দেশের। আর ভোটপ্রিয় বাঙালির তো এ সব বিষয়ে আগাধ জ্ঞান। নিকারাগুয়া থেকে হনলুলু যেখানেই ভোট হোক না কেন, আমাদের সমীক্ষা প্রস্তুত। আমেরিকা, ফ্রান্স বা ইংল্যান্ডে নির্বাচন হলে তো কথাই নেই, আমাদের হাতের তালু আর বসিরহাট কিংবা যাদবপুরের মত চেনা সব কেন্দ্র। গত মার্কিন দেশের নির্বাচনে ট্রাম্প হিলারির লড়াই নিয়ে প্রচুর আলোচনা করেছি আমরা। সেই ভোটে আবার নাক গলিয়েছিল রাশিয়া। পুতিন শুধু নিজের দেশে আশি শতাংশের কাছাকাছি ভোট পেয়েই তুষ্ট নন, মার্কিন দেশের ভোটে গোলমাল পাকিয়েই তো তিনি প্রমাণ করতে পারেন তাঁর হাত ঠিক কতটা লম্বা।

Advertisment

অল্প কিছুদিন আগে বাংলাদেশের ভোট নিয়ে আমাদের মধ্যে বেশ খানিকটা উত্তেজনা ছিল। তবে সেখানে ভোটলুঠ এমন একটা মাত্রায় গেছে যে কোনও সমীক্ষারই আর প্রয়োজন পড়ে নি। একই নিয়মে আমাদের দেশের নির্বাচন নিয়ে যে পড়শি দেশগুলোর উৎসাহ থাকবে তা বলাই বাহুল্য। এর মধ্যেই যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা শেষের পর ইমরান খান নাকি মোদীকেই আবার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দেখতে চেয়েছেন। বিজেপি আবার বলছে যে মোদী বিরোধীরা পাকিস্তানের প্রতি সহানুভূতিশীল, অর্থাৎ দেশদ্রোহী। সব মিলিয়ে কে কোন দলে বোঝা শক্ত। তবে এটুকু অন্তত বোঝা যাচ্ছে যে এবারের নির্বাচনে পাকিস্তান একটা বড় বিষয়।

আরও পড়ুন, Lok Sabha Election 2019: তৃণমূলের হয়ে প্রচারের অভিযোগ: বাংলাদেশি অভিনেতা ফিরদৌসের ভিসা বাতিল

সত্যিই তো, ভারত শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থান, প্রযুক্তি এসমস্ত বিষয়ে এতটাই এগিয়ে গেছে যে দেশে আর বিশেষ সমস্যা নেই। ফলে পাকিস্তানের সঙ্গে ভাব করা হবে নাকি আড়ি, এবং সেই সূত্রে পাকিস্তানের সার্বিক উন্নয়ন সপ্তদশ লোকসভা নির্বাচনের একটি মূল তর্কের বিষয় হতেই পারে। নেপালের ক্রিকেট দল কেমন হবে তা ইস্যু হতে পারে উত্তরপ্রদেশে সেই হিন্দু রাষ্ট্র সংলগ্ন কিছু লোকসভা আসনে, ভুটানে কমলালেবুর চাষ নিশ্চয় আলিপুরদুয়ারের প্রার্থীদের বক্তব্যে আসবে, দিল্লি থেকে সুন্দরবন সব জায়গাতেই থাকবে রোহিঙ্গাদের নিয়ে আলোচনা। দুখানা বোয়িং বিমান কেন মুখ থুবড়ে পড়ল সে নিয়ে ব্যাপক প্রচার হবে দুর্গাপুরের শিল্পক্ষেত্রে, কারণ আমাদের দেশের শিল্প সমস্যা তো মিটেই গেছে। আপাতত তাই মার্কিন উড়োজাহাজ কোম্পানিটি নিয়ে ভাবার সময় উপস্থিত। এর সঙ্গে হাতে কিছুটা সময় থাকলে দেশের সামান্য কিছু বিষয় নিয়ে ভাবতেও পারি। যেমন বসিরহাট, যাদবপুর বা আসানসোলে ভোট হতে পারে উন্নতমানের চলচ্চিত্রের দাবিতে, হাওড়ায় ফুটবলে ভারতের ভবিষ্যৎ কর্মসূচি নিয়ে, বালুরঘাটে বিষয় হবে গ্রুপ থিয়েটারের আন্দোলন, ইত্যাদি ইত্যাদি।

তবে আবার মনে করিয়ে দেওয়া দরকার যে ভারতের মত এক উপমহাদেশ, যেখানে সমস্যা আর কিছুই নেই, সেখানে নির্বাচনের মূল বিষয় হওয়া উচিৎ বিদেশ সংক্রান্ত আলোচনা। বিদেশনীতি যে রাজনীতির একটা মূল অংশ সে কথা ভুলতে চলেছেন এ দেশের নির্বাচক মণ্ডলী। ইজরায়েল এবং প্যালেস্তাইনের মধ্যে তীব্র হানাহানি নিয়ে বিজেপি নতুন কী বলে সেই আশায় টিভির পর্দার দিকে তাকিয়ে আছি অনেক দিন। কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন দলের টাল যে ইজরায়েলের দিকে সে তো সবাই জানে, তবে তারা তা পরিষ্কার করে বলছে না সম্পর্ক আর কতটা এগিয়েছে। সঙ্গে প্যালেস্তাইনের পক্ষে তৃণমূল বা কংগ্রেসের বক্তব্যও অস্বচ্ছ। আর বিদেশ নিয়ে এতটাই যখন আমরা এই সপ্তদশ লোকসভা নির্বাচনে ভাবছি, তখন ক্রিকেট বা ফুটবলের খেলোয়াড় কিংবা আমদানি করা প্রযুক্তির মত ভাড়া করে অন্য দেশের প্রচারক আনলেই বা ক্ষতি কী? তবেই তো ভারতের লোকসভা নির্বাচন বিশ্বের বৃহত্তম সংসদীয় গণতন্ত্রের আসল মর্যাদা পাবে। সেই জন্যেই তো তৃণমূল বাংলাদেশের দুই অভিনেতাকে ডেকে এনে প্রচার করিয়েছে। বিরোধীরা বলছে এতে নাকি দেশের সার্বভৌমত্ব নষ্ট হবে।

আরও পড়ুন, Lok Sabha Election 2019:পড়াশোনা শেষ করেই রাজনীতিতে আসার ইঙ্গিত দীপা পুত্র প্রিয়দীপের

এর মধ্যেই ফিরদৌসকে ফেরত পাঠানো হয়েছে বাংলাদেশে। কিন্তু এর অন্যদিকটাও তো দেখতে হবে — যা নাকি বামপন্থীদের ভাষায় আন্তর্জাতিকতাবাদ আর ডানপন্থীদের চিন্তাশীলতায় বিশ্বায়ন। প্রখ্যাত অভিনেতা অক্ষয়কুমার তো অনেক সময়েই এ দেশের মুখ, কিন্তু অন্তর্জাল খুঁজলে খবর পাওয়া যায় যে তিনি তো আদতে কানাডার নাগরিক। গত বছর স্বাধীনতা দিবসের ঠিক আগেই কেন্দ্রীয় মন্ত্রী নিতিন গড়করি পথ নিরাপত্তা সংক্রান্ত প্রচারে ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডার করেছেন অক্ষয়কুমারকে। আলিয়া ভাট নাকি ব্রিটিশ নাগরিক, তাতে কি তাঁর এ দেশের সমাজ-সংসার-রাজনীতি সম্পর্কে মন্তব্য করতে আটকায়? আর তার ওপর বিজেপি তো বলেই দিয়েছে যে কে নাগরিক আর কে নাগরিক নয় সেসব সময় মত খুঁজে বার করা হবে। আসামে তো সে প্রক্রিয়া শুরু হয়েই গেছে, যেখানে খবর আসছে যমজ ভাই বোনের একজন ভারতীয় আর একজন নয়। ফলে আজকের দিনে ভারতে যারা ভোট প্রচার করছেন কিংবা ভোট দিচ্ছেন, তাঁরা কিছুদিন পরেই হয়ত ভারতের নাগরিক থাকবে না। সেই হিসেবে তৃণমূলের প্রচার গাড়িতে পশ্চিমবঙ্গের সান্ধ্য সিরিয়ালের আর এক বাংলাদেশি নায়ক না হয় জোড়াফুলের হয়ে দুচারটি শ্লোগান দিলেন। তাতে এতো হইচই কেন?

তবে ভারতের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গেরও একটা আলাদা রাজনীতি আছে। সে রাজনীতিতে আপাতত চারটে মূল দল। তৃণমূল, বিজেপি, বামফ্রন্ট আর কংগ্রেস। বাজারে যা হাওয়া এবং সমীক্ষাগুলো যেমন বলছে তাতে মূল লড়াই তৃণমূল আর বিজেপির মধ্যে। এই জায়গাটা যদি দুটো দল ধরে রাখতে পারে তাহলে সবথেকে সুবিধে কেন্দ্র আর রাজ্যের শাসকদের আর সবথেকে অসুবিধে বামফ্রন্টের। কিন্তু বামফ্রন্টের কথা ভেবে তো আর তৃণমূল আর বিজেপি চোখের জল ফেলবে না। তাদের এক আর দুই থাকতে গেলে সব থেকে ভালো পথ নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতা। সেই দ্বন্দ্বে যদি ধর্ম মিশে থাকে তাহলে বামপন্থী চিন্তাভাবনাগুলোকে অনেক নিশ্চিন্তে বর্জন করা যায়।

আরও পড়ুন, নির্বাচনী ইস্তেহার ও মানবাধিকার

তাই তৃণমূলের প্রচারে যদি দু-একজন বাংলাদেশের অভিনেতা বক্তব্য রাখেন, তাহলে তৃণমূলের ওপর বিরক্ত সংখ্যাগুরুদের বাম-কংগ্রেসের তুলনায় বিজেপির দিকে যাওয়ার প্রবণতা বাড়বে। খুচরো তর্কে পা বাড়িয়ে রাজ্যের জনগণ তখন উন্নয়নের বিভিন্ন সূচক নিয়ে প্রশ্ন তুলতে ভুলে যাবেন। বিজেপিকেও উত্তর দিতে হবে না যে ভারতে শেষ পাঁচ বছরে ঠিক কত মানুষের চাকরি হল, কারণ বাংলাদেশি অভিনেতা ততক্ষণে অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থানের পরিপূরক। নির্বাচন কমিশন হতচকিত, কারণ এই নিয়ে কী করা হবে তা নাকি খাতায় লেখাই নেই। সর্বভারতীয় সংবাদমাধ্যমগুলো হাঁউমাঁউ করে আলোচনা করবে বিষয়টি নিয়ে। সে খবর অন্তর্জালে পৌঁছবে এ রাজ্যের ভোটারদের কাছে, কারণ রাজ্যের সংবাদপত্র কিংবা টেলিভিশন চ্যানেলগুলো ঠিক করে উঠতে পারবে না এর কতটা প্রচার করলে তাদের চেনাপরিচিত নেতানেত্রীরা কতটুকু গোঁসা করবেন। তৃণমূল নেত্রী আরও তীব্র প্রচার করবেন যেন বিজেপি বিরোধী ভোট ভাগ না হয়। এর একদিকে যেমন অতি স্বাভাবিক নিজের দলের স্বার্থে প্রচার, অন্যদিকে বুঝিয়ে দেওয়া যে বিজেপিই দ্বিতীয় শক্তিধর দল। কংগ্রেস দেশজুড়ে কাকে বেশি শত্রু মনে করছে, বিজেপি, তৃণমূল নেতৃত্বাধীন তৃতীয় পক্ষ নাকি শুধুমাত্র কেরল আর পশ্চিমবঙ্গের বামফ্রন্ট সেটা বুঝতেই সাধারণ মতদাতারা হিমশিম। সব মিলিয়ে এই পরিস্থিতিতে তৃণমূল আর বিজেপির পোয়াবারো, বিশেষ করে আমাদের রাজ্যের প্রেক্ষিতে। কে কতটা ভোট পাবেন সে অঙ্ক ফলপ্রকাশের পরে সম্পূর্ণ বোঝা যাবে। তবে সঠিক রাজনৈতিক বিষয়বস্তু থেকে সঠিক সময়ে জনগণের দৃষ্টি একশো আশি ডিগ্রিতে ঘুরিয়ে দেওয়া যাচ্ছে। সেখানেই বাংলাদেশের গায়ে লেগে থাকা রাজ্যে তৃণমূল আর বিজেপির রাজনৈতিক সাফল্য।

(শুভময় মৈত্র ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইন্সটিটিউটের অধ্যাপক, মতামত ব্যক্তিগত।)

tmc General Election 2019 election commission bjp
Advertisment