Advertisment

ভালোবাসা, ভ্রাতৃ্ত্ববোধ এবং এক আলফা জঙ্গির পরিবর্তন

এখনও লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন প্রাক্তন আলফা জঙ্গি মণি গগৈ। জেল থেকে বেরিয়ে তিনি প্রথম ফোন অবশ্য পুরনো সংগঠনের কাউকে করেননি, করেছিলেন নিজের গ্রামে।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
NULL

মণি গগৈ

সংগঠনের ছেলেরা যখন স্থির করে জঙ্গলের একটি গাছে গুলি চালানো হবে, মণি মানিক গগৈ বলেন, তিনি গুলি চালাবেন একদম শেষে। সবাই লক্ষ্যভেদ করল, গগৈয়ের বুলেটে একটা পাতাও নড়ল না।

Advertisment

সবচেয়ে ভয়ানক বলে খ্যাত নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন ইউনাইটেড লিবারেশন ফ্রন্ট অফ আসাম (আলফা)-এর ২৮ নং ব্যাটালিয়নের একটা গুলিও সে সময়ে লক্ষ্যচ্যুত হত না। কিন্তু গগৈয়ের এই ব্যর্থতা নিয়ে সবাই হেসেছিল, মজা করেছিল সেদিন।

ওঁদেরই একজন বলছিলেন, মণি যদি করে থাকে, ঠিকই আছে। কারণ মণি যা করত, সেগুলো সব ঠিক। ১৯৯৫ সালের মত সময়ে, ক্যডাররা যখন পিকনিকে যেত, মণি বন্দুক নিয়ে যেতে রাজি হতেন না। আবার ওই বছরেই মায়নমারের ঘন জঙ্গলে, যা বহু বিদ্রোহী বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীর হটস্পট ছিল, সেথানে একটি শিবিরে গেরিলা প্রশিক্ষণ নিতে অস্বীকার করেছিলেন মণি।

আরও পড়ুন, এক দিনের এক বিয়ে

উজান আসামের ডিব্রুগড় জেলার টিংখাং শহরের সালমারা দিঘোলিয়া এলাকার বাসিন্দা মণি গগৈ। তাঁর যখন ২১ বছর বয়স, সে সময়ে তিনি আলফার সংস্পর্শে আসেন। একটা আবেদনপত্র বিলি করা হয়েছিল আলফার রফ থেকে। তাতে লেখা ছিল, মুক্ত ও স্বাধীন আসামের জন্য, দারিদ্র্যহীন আসামের জন্য, সমৃদ্ধ আসামের জন্য আলফায় যোগ দিন।

১৯৮৮ থেকে ১৯৯৮, এই সময়ের মধ্যে মণি শুধু আলফার সবচেয়ে ভয়ংকর ব্যাটালিয়নের ক্যাডারই ছিলেন না, তিনি জনমানসে আলফার ভাবমূর্তি বাড়িয়ে তুলছিলেন, শয়ে শয়ে ক্যাডারকে যোগ দেওয়াচ্ছিলেন সংগঠনে। পুরো সময়কাল জুড়ে তিনি পলাতক জীবন কাটাচ্ছিলেন, ভারতীয় সেনার তল্লাশি এড়িয়ে বেড়াচ্ছিলেন, বন্দি হচ্ছিলেন ডিব্রুগড়ের জেলে, নিজের এলাকার মানুষদের ভালবাসা আর শ্রদ্ধা অর্জন করছিলেন।

বছরখানেক পর তাঁকে যখন ছেড়ে দেওয়া হয়, রঞ্জন গগৈ তাঁর সামর্থ্য অনুসারে যা করা সম্ভব তাই করেছিলেন, বা যা করা সম্ভব নয়, তাই করেছিলেন। তিনি পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করেননি, এবং তিনি আলফাতে যোগও দেননি। টিংখাংয়ে নিজের বাড়িতে ফিরে গিয়েছিলেন তিনি, তাঁর বিশ্বাস অনুযায়ী কাজ শুরু করতে। সোশাল ওয়ার্ক করতে।

গান্ধী প্রেমিক এক জঙ্গি

গগৈ যখন বড় হচ্ছিলেন, তখন, সেই আটের দশকে টিংখাংয়ে দারিদ্র্য ছিল ভয়াবহ। আলফা তাদের ডানা মেলার মাত্র কয়েক বছর আগে, আসামের বিদেশি বিরোধী আন্দোলন পূর্ণতা পায় কেন্দ্রের সঙ্গে চুক্তির মাধ্যমে। তা শুধু রাজ্যকে বিদেশিমুক্ত করার বিষয় ছিল না, ছিল রাজ্যের উন্নয়নেরও বিষয়। কিন্তু কিছুই ঘটছিল না। "আমাদের গ্রাম সালমারা দিঘোলিয়া একটা বড়লোক তৈল শহরের মধ্যে অবস্থিত। আমাদের কয়লা রয়েছে, চা রয়েছে, কিছু তেল রয়েছে, কিন্তু আমাদের কোনও সুযোগ সুবিধে নেই। কোনও রাস্তা নেই, কোনও কাজ নেই, আমরা গরিব, এত গরিব যে আমার মাকে রাস্তায় বেরিয়ে ভিক্ষেও করতে হয় মাঝে মাঝে।" বলছিলেন মণি গগৈ।

এই অসন্তোষ থেকেই গগৈয়ের মত বহু অল্পবয়সী ছেলে আলফার দিতে ঝুঁকে পড়ে, যে আলফা বিশ্বাস করতে ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্র থেকে বেরিয়ে যেতে পারলেই আসামের উন্নতি হবে। অসমিয়া জাতীয়তাবাদ চিরকালই সবচেয়ে বেশি জলহাওয়া পেয়ে এসেছে উজান আসামে। মণি গগৈয়ের গ্রামে প্রত্যেক পরিবারের অন্তত একজন করে আলফার সদস্য ছিলেন।  "সে সময়ে ওই একমাত্র বিকল্প ছিল, সংগঠন পরের দিকে খারাপ হতে শুরু করে, সব আলফা খারাপ ছিল না।" গগৈ বলছিলেন, বিভিন্ন গ্রাম ও শহরে সংগঠন মানুষের কল্যাণেক জন্য কাজ করত- বেআইনি মদের ঠেক ভাঙা, চোর পাকড়ানো, মেডিক্যাল ক্যাম্প সংগঠিত করা. এবং আসামের মানুষের আর্থিক স্বনির্ভরতা এবং আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের উপর জোর দিত তারা।

আরও পড়ুন, “ভারত নাকি নিরাপদ?” রাগ জমছে বরাকের হিন্দু অধ্যুষিত এলাকায়

এই সমস্ত উদ্যোগের সামনের সারিতে থাকতেন মণি। "আমার উদ্দেশ্য ছিল মানুষের সেবা করা, তখন আমার কাছে এসে যেত না যে আমি আলফার মাধ্যমে সে কাজ করছি কিনা।" তার মানে তিনি যে সংগঠনের সামরিক দিক থেকে রেহাই পেয়ে গিয়েছিলেন তা কিন্তু নয়। ১৯৯৪ সালে জঙ্গলে যান মণি। মায়নমারের আলফার ট্রেনিং ক্যাম্পে যোগ দেবার উদ্দেশ্যে। কিন্তু ক্যাম্পে পৌঁছে তিনি গেরিলা ট্রেনিং নিতে অস্বীকার করেন, জেদ ধরে থাকেন বন্দুকের প্রাথমিক প্রশিক্ষণ ছাড়া আর কোনও ট্রেনিং নেবেন না।

৯-এর দশকের শেষের দিকে আলফার কাজের পদ্ধতি নিয়ে হতাশা ও স্বপ্নভঙ্গ গ্রাস করে তাঁকে। তিনি বুঝতে পারেন আসামের এই বদলের স্বপ্ন তিনি দেখেননি। "আমি আলফার আর্থিক স্বনির্ভরতা এবং সমাজবাদের নীতিতে বিশ্বাস করতাম, কিন্তু আমি বুঝতে শুরু করি যে ভারতের সঙ্গে সশস্ত্র যুদ্ধে জেতা কোনও দিন সম্ভব হবে না।"

জেল থেকে বেরোনোর পর তিনি প্রথম ফোন করেন গ্রামের সমাজসেবী সংগঠনে। আলফায় নয়।

এর পরেই সালমারা দিঘোলিয়ার উন্নতির জন্য কর্মসূচি গ্রহণের উদ্দেশ্যে টাকা তুলতে শুরু করেন মণি গগৈ। কৃষি খামার তৈরি করা হয়, যেখানে কিছু প্রাক্তন আলফা কর্মীসহ কয়েকশ যুবক কাজ করতে শুরু করেন, কাঁচা রাস্তা পাকা হয়, বনসৃজন প্রকল্পের কাজ শুরু হয়, তৈরি হয় সেতু ও স্কুল।

"সব গ্রামবাসীরা আমাকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসেন। সম্ভবত এ কারণেই যে আমি আলফা করার সময়েও সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভাজন করিনি, সে মাড়োয়ারি হোক কি নেপালি, হিন্দু হোক কিংবা মুসলিম।"

২০০৩ সালে তিনি স্থাপন করেন টিংখাং কলা কেন্দ্র, যেখানে শিশুরা গান, নাচ, অভিনয় ও আঁকা শিখবে। গগৈ নিজে একজন শিল্পী, বাচ্চাদের তিনি আঁকা শেখান। তাঁর নিজের ফেভারিট হল মহাত্মা গান্ধীর এক পোর্ট্রেট। গান্ধীকে গুরু মানেন মণি গগৈ।

আজ প্রাক্তন আলফা জঙ্গির আঁকা গান্ধীর ছবি ডিব্রুগড়ের ডেপুটি কমিশনারের অফিস, ধুলিয়াজানে অয়েল ইন্ডিয়া লিমিটেডের দফতর, এবং এলাকার ৩০টি গ্রাম পঞ্চায়েতের অফিসে শোভা পাচ্ছে।

পরিবর্তনের এক কাণ্ডারী

বছরের পর বছর ধরে গান্ধীর সামাজিক কাজের ছোঁয়া গ্রামের প্রতিটি কোণে পৌঁছিয়ে গিয়েছে। কিছুদিনের মধ্যেই অয়েল ইন্ডিয়া লিমিটেড নিজেদের কর্পোরেট সোশাল রেসপনসিবিলিটি (সিএসআর) উদ্যোগের প্রধান মুখ হিসেবে মনোনীত করে মণি গগৈকে। তাঁরই সাহাযেযে বেশ কিছু স্বনির্ভর গোষ্ঠী তৈরি হয় যা হাজার হাজার পরিবারকে সাহায্য করতে সক্ষম হয়েছে।

মণি গগৈয়ের টাটা সুমো টিংখাংয়ের কোনও গ্রামে পৌঁছলে মানুষজন দৌড়ে আসেন, কেউ আসেন শ্রদ্ধাবশত, কেউ তাঁর বা তাঁর স্ত্রী দীপালির সঙ্গে সৌজন্য বিনিময় করতে। সেরকমই এক সফরের সময়ে গ্রামবাসীরা তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করেন নাহারানি স্বাস্থ্যকেন্দ্রের দিকে। টিংখাং ও নাহারকাটিয়া বিধানসভা কেন্দ্রের একমাত্র সরকারি হেলথ সেন্টার যা ওই এলাকার সবচেয়ে বড় চিকিৎসাকেন্দ্রও বটে। মণি গগৈ বলেন, "সেখানে বিদ্যুৎ ছিল না, বেড ছিল না, ঘর ছিল না, এমনকি জলের সাপ্লাইও ছিল না।" মণি গগৈ টাকা তুলে হাসপাতাল নতুন করে বানান। গ্রামবাসীরাও সাহায্য করেছিল, কেউ বেড দিয়েছিল, কেউ নিজেরা বিশ্রামের হল বানিয়েছিল গতরে খেটে। ২০০৫ সালে টিংখাং হাসপাতালও গগৈয়ের উদ্যোগে একইভাবে তৈরি হয়।

তাঁর সম্ভবত সবচেয়ে বড় প্রকল্প হল চলমান সাসোনি-মার্বিল প্রকল্প। আসামের প্রথম বড় বাজেটের ইকো টুরিজম প্রকল্প যা নাহারকাটিয়ার সাসোনি এলাকার মারবিল লেক ঘিরে গড়ে উঠছে। এখানকার কাজ এগোচ্ছে ধীর গতিতে, কিন্তু মণি গগৈয়ের উপর ভরসা আর বিশ্বাসের কারণেই গ্রামবাসীরা পিছু হঠছেন না।

৫০ বছরের মণি গগৈ এখন সারা আসামে ঘুরে ঘুরে পরিবর্তন ও সংস্কার সম্পর্কে ভাষণ দেন। তিনি নিজে বিশ্বাস করেন, ভালবাস, ভ্রাতৃত্ব ও সততার আদর্শ তাঁকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করেছে। আর আলফার বন্দুকের দিনগুলো? "আমি কখনও কোনও মানুষের উপর গুলি চালাইনি। কারও কাছে বন্দুক চালানোর ক্ষমতা থাকা মানেই সে ক্ষমতা ব্যবহার করতে হবে, এমন নয়।"

Read the Full Story in English

ULFA
Advertisment