হবে না? ওঁদের জন্য একটা মিছিল হবে না? সেই শহরে, যেখানে আধঘন্টার নোটিশে পেল্লায় সাইজের মোমবাতি নিয়ে নানা ইস্যুতে মিছিল বেরিয়ে পড়ে রাজপথে? ওঁদের জন্য হবে না?
'ওঁরা' মানে সেই শ'আড়াই কর্মপ্রার্থী, যাঁরা স্কুল সার্ভিস কমিশনের (এসএসসি) পরীক্ষায় ছয় বছর আগে উত্তীর্ণ হয়েও এখনও চাকরি পাননি, যাঁরা ধর্মতলায় প্রেস ক্লাবের সামনে মঞ্চ-ছাউনি বেঁধে অনশন চালিয়ে যাচ্ছেন কুড়ি দিন ধরে, ঝড়-জল-রোদ্দুরের চোখরাঙানি সহ্য করে। ত্রিপল টাঙানোর অনুমতি পাওয়া যায় নি বলে ঝড়বৃষ্টিতে মাথার ওপরে প্লাস্টিকের চাদর হাতে ধরে দাঁড়িয়ে থাকছেন।
আরও পড়ুন: কলকাতার রাজপথে দশ দিন না খেয়ে ৩৫০ স্কুল সার্ভিস চাকরিপ্রার্থী
আর কী কী সহ্য করছেন ওঁরা? চাকরির পরীক্ষায় পাশ করেও কর্মহীনতার গ্লানি ছেড়ে দিন। আত্মীয়-পরিজন বন্ধুবান্ধবদের কাছে সামাজিক সম্মানহানি বা পাড়াপড়শির গঞ্জনার কথাও না হয় বাদই দেওয়া গেল। কুড়ি দিনের অনশন-ধর্নায় ওঁদের কেউ কেউ কী চরম শারীরিক প্রতিকূলতার সঙ্গে যুঝছেন অনমনীয় সংকল্পে, তার দু-একটা মাত্র নমুনা পেশ করা যাক।
বেশ কয়েকজন গর্ভবতী মহিলা আছেন অনশনকারীদের মধ্যে। যাঁদের মধ্যে একজনের গর্ভপাত ঘটে গেছে অনশন চলাকালীন। ছিলেন আরও দু'জন অন্তঃসত্ত্বা। সতীর্থরা যাঁদের জোর করে বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছেন। অনশন চালাতে চালাতে একজনের ডেঙ্গু হয়েছে, একজনের রক্তআমাশা, অসুস্থ হয়ে পড়েছেন আরও অনেকে। একজন অনশন চালিয়ে গেছেন কোলে দুধের শিশু নিয়ে। উদাহরণ আরও দেওয়া যায়।
এভাবেই চলবে? কুড়ি থেকে তিরিশ দিন, তিরিশ থেকে চল্লিশ? সমাধান নেই? অনশনকারীরা বিকাশ ভবনে দেখা করেছিলেন শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে। সমাধানসূত্র মেলেনি আলোচনায়। মুখ্যমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ দাবি করে রিলে অনশন চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন অনশনকারীরা।
অতঃকিম? এভাবেই চলবে? অনশনকারীদের দাবি, নিয়োগ পদ্ধতিতে স্বচ্ছতা নেই সরকারের, তাঁদের প্রাপ্য চাকরি থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে অন্যায়ভাবে। সরকার এই অভিযোগ অস্বীকার করে নিজের অবস্থানে অনড়।
আরও পড়ুন: রক্ত আমাশা-ডেঙ্গু-গর্ভপাত, কিন্তু এসএসসি প্রার্থীদের অনশন চলছেই
কে ঠিক, কে ভুল, সে তর্কে যাওয়া এই লেখার উদ্দেশ্য নয় আদৌ। উদ্দেশ্য শুধু এই প্রশ্নটা তোলা, রাজ্যের দু-তিনশো শিক্ষিত যুবক-যুবতী একটা বঞ্চনাবোধ নিয়ে রাস্তায় যখন দিনের পর দিন, রাতের পর রাত কাটাচ্ছেন, সরকারের কি উচিত নয় সমস্যা সমাধানে আরও একটু সক্রিয় হওয়া, আরও একটু সদিচ্ছা দেখানো? আন্দোলনকারীদের দাবিতে যৌক্তিকতা না থাকলে সে দাবির কাছে নতিস্বীকার করতে কেউ বলছে না, কিন্তু মানবিকতার দাবি বলেও তো একটা বস্তু আছে। অন্তত সেই দাবিকে শিরোধার্য করে সরকারের পক্ষে কি আদৌ সম্ভব নয় সমাধান খোঁজার পরিসরটিকে আরও একটু বিস্তৃত করা? শখ করে কি আর এতগুলো মানুষ বাড়ি ঘরদোর ছেড়ে রাস্তায় দিন কাটায় এভাবে?
সরকারের নিয়মনীতির কথা যদি ছেড়েও দিই, শহরের তথাকথিত 'সুশীল সমাজ'-এর তরফেও তো কোন সাড়াশব্দ নেই বিষয়টি নিয়ে। কথায় কথায় যাঁরা নানা ইস্যুতে রাস্তায় বেরিয়ে পড়েন হাতে মোমবাতি আর বুকে কালো ব্যাজ ঝুলিয়ে, চ্যানেলে চ্যানেলে বাণী বিতরণ করেন জ্ঞানগর্ভ, তাঁরাই বা কোথায় গেলেন? ইস্যু সে যা-ই হোক, ঠিক হোক ভুল হোক, দাবি যৌক্তিক হোক বা অযৌক্তিক, শহরের প্রাণকেন্দ্রে রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা এতগুলো শিক্ষিত মানুষের অনশন চোখে পড়ছে না?
অবশ্য কারোরই চোখে পড়ে নি তা নয়। রাজ্যের প্রায় প্রতিটি উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি মঞ্চে এসে হাজিরা দিয়ে গেছেন, বেশ কয়েকবার। শাসকদল থেকে শুরু করে বিখ্যাত বাম নেতা, দক্ষিণপন্থী দলের একাধিক তালেবর, প্রাতিষ্ঠানিক রাজনীতির বাইরে থাকা প্রখ্যাত কবি, গীতিকার, এসেছেন সকলেই। কিন্তু মঞ্চে রাজনীতির সরাসরি প্রবেশ ঘটে নি এখনো। বিক্ষোভকারীরা জানিয়েছেন, নেতৃবৃন্দ অবশ্যই এই আন্দোলন নিয়ে রাজনৈতিক বক্তব্য রাখুন, কিন্তু মঞ্চের তথা অনশনের পরিধির বাইরে, নিজেদের মতো করে।
রাজনীতির প্রবেশ নিষেধ বলেই কি তেমন মর্যাদা পাচ্ছে না এই ধর্মঘট? নাকি মন্ত্রীর কথায় এঁরা "অকৃতকার্য" বলেই এই অনশন অর্থহীন? কারণ যাই হোক, প্রয়োজনে প্রাণত্যাগ করতে প্রস্তুত এই চাকরিপ্রার্থীদের দাবি যথাযথ কর্তৃপক্ষের কানে পৌঁছয় নি বলেই মনে হচ্ছে।
ওঁদের জন্য একটা মিছিল হবে না?