মিউজিয়াম- একটা আদ্যোপান্ত রহস্যে মোড়া জায়গা যার ভেতরে যুগ যুুগ ধরে জমা হচ্ছে হাজার বছরের পুরোনো মমি, রাজারাজড়ার ঢাল- তলোয়ার, দুর্লভ সব পেইন্টিং বা সেলিব্রিটিদের মোমের পুতুল। যাদুঘর জিনিসটার আকর্ষণ এতটাই অদম্য যে সাহিত্য থেকে শুরু করে সিনেমা- সবেতেই এর অবাধ বিচরণ। স্বয়ং শার্লক হোমসের স্রষ্টা স্যার আর্থার কোনান ডয়েল যেমন মিউজিয়মের রহস্য নিয়ে লিখেছেন কিংবদন্তী গল্প দ্য রিং অফ থোথ, তেমনি আমাদের প্রায় প্রত্যেকের মনেই হলিউডখ্যাত "নাইট অ্যাট দ্য মিউজিয়াম" ছবিটা গেঁথে আছে। শুধুই কি ইতিহাস? পৃথিবীতে এমন সব আজগুবি যাদুঘর আছে যাদের কালেকশনের বহর শুনলে আপনারা ব্যোমকে যাবেন! আইসল্যান্ডের একটা মিউজিয়াম যেমন বিখ্যাত পৃথিবীর সমস্ত স্তন্যপায়ী প্রাণীদের পুরুষাঙ্গ সংগ্রহ করার জন্যে, আবার নেদারল্যান্ডসে রয়েছে মধ্যযুগীয় টর্চার ইনস্ট্রুমেন্টসের সমস্ত রকমের হিসেব। মাদাম তুঁস্যো বা ল্যুভরের কথা আর আলাদা করে নাই বললাম। বিদঘুটেপনায় পিছিয়ে নেই আমাদের ভারতও- এই দিল্লিতেই রয়েছে "সুলভ ইন্টারন্যাশনাল মিউজিয়াম অফ টয়লেটস"। অবশ্য জার্মানির গুবেনে অবস্থিত প্লাস্টিনেরিয়ামের কাছে এই সমস্ত জাদুঘর নিতান্তই বাচ্চা! কী রয়েছে এখানে? ধরা যাক আপনি একটা জাদুঘরে ঢুকলেন যার মধ্যে অজস্র মানুষ। কেউ ঘোড়ার পিঠে বসে তো কেউ আপনমনে তাস খেলছে বন্ধুদের সাথে। অথচ এদের কারো দেহে প্রাণ নেই। কী ভাবছেন, মোমের মূর্তি? আজ্ঞে না, এরা প্রত্যেকেই প্লাস্টিনেশন নামের এক উপায়ে কৃত্রিমভাবে মমিফায়েড মানুষ যারা আজ থেকে কিছুকাল আগেও আমার- আপনার মতই বেঁচে ছিল। অবশ্য আমি আজ এই মিউজিয়ামের গল্প বলতে বসিনি, বলতে বসেছি এক আধাপাগলা হিমোফিলিক বৃদ্ধের কথা যিনি এই মুহুর্তে সম্ভবত পৃথিবীর সর্বাপেক্ষা বিতর্কিত ডাক্তার। যাঁর আবিষ্কার অ্যানাটমি সংক্রান্ত গবেষণাকে যেমন হাজার বছর এগিয়ে দিয়েছে তেমনই প্রশ্ন তুলেছে প্রাণের গুরুত্ব নিয়ে, মানুষ জানতে চেয়েছে একটা মৃতদেহ নিয়ে বিজ্ঞানের নামে ঠিক কতদূর বাড়াবাড়ি করা যায়! হাজার হাজার লোক তাঁকে একজন বিখ্যাত শিল্পীর তকমা দিয়েছেন, বাকিরা বলেছেন বদ্ধ উন্মাদ। মনে রাখুন, ভদ্রলোকের নাম গান্থার ভন হ্যাগেন্স- তাকে আপনি ভগবান বলবেন না শয়তান, সেসব আপনার ব্যক্তিগত ইচ্ছে।
আরও পড়ুন, অমরত্বের প্রত্যাশা
১৯৪৫'এর জানুয়ারি, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ প্রায় শেষ। এমন লন্ডভন্ড অবস্থায় জার্মান অধিকৃত পোল্যান্ডে এক রুগ্ন শিশুর জন্ম হল। খুশি হলনা কেউ, তখন তো পালানোর সময়! সদ্যোজাত গান্থারকে নিয়ে তাই পাঁচদিনের মাথায় তার বাবা আর মা পালালেন বার্লিনে, সেখানে তখন সোভিয়েতের শাসন। অতঃপর কিছুদিন আবার পালিয়ে গ্রেইজ নামের এক ছোট্ট শহরে। কোনো এক অলুক্ষুণে সময়ে জন্মেছিলেন বলেই হয়তো দুর্ভাগ্য তাদের পেছন ছাড়ল না, একটা ক্ষুদ্র অ্যাক্সিডেন্টের পরে জানা গেল গান্থার হিমোফিলিয়ার রুগী যে রোগে একবার রক্তপাত শুরু হলে থামতে চায়না। শুরু হল ট্রিটমেন্ট। টানা ছয় মাস ধরে হাসপাতালের বিছানায় পড়ে থেকে থেকে কিশোর গান্থারের চিকিৎসাবিজ্ঞানের প্রতি একটা আশ্চর্য আকর্ষণ শুরু হল।
এই রক্ত, এই শিরা- উপশিরা, মাংস, হৃৎপিণ্ড, ফুসফুস এরা সবাই নিজের নিয়মে চলবে। তারপর একদিন একটা বোমারু বিমান বা দু- তিনটে বুলেট এদের সবাইকে চিরকালের জন্যে থামিয়ে দেবে। এ যেন মেশিনে মেশিনে লড়াই! ১৯৬৫ সালে একইসঙ্গে গান্থারের জীবনে দুটো জিনিস শুরু হল- ডাক্তারি পড়াশোনা এবং কমিউনিস্ট বিদ্বেষ। তখন উনসত্তরের শেষ, যুবক গান্থারের গরম রক্ত, গোটা জার্মানি ঠান্ডা যুদ্ধ আর চেকোস্লোভাকিয়ার আক্রমণের সঙ্গে যুঝছে। গান্থার ডাক্তারি পড়াশোনা শিকেয় তুললেন, তারপর ছুটি কাটাতে আসা ছাত্রের বেশে স্লোভাকিয়ার বর্ডার ক্রস করে অস্ট্রিয়া ঢুকতে গেলেন। কিন্তু যুবা বয়স তো, তেজ যত বেশি বুদ্ধি তত নয়, ধরা পড়লেন গান্থার। অতঃপর টানা দু বছর শ্রীঘরে। মৃত্যু ততদিনে তার কাছে নতুন কিছু নয়, তাও, এখানে এসেই সবাই হেরে যায়। গান্থার বদ্ধ জেলখানায় বসে ভাবতে থাকলেন- মৃতদেহদের পচে যেতেই হবে? যদি কোনো উপায়ে এই ফুরিয়ে যাওয়া আটকে দেওয়া যায়? সেই আদ্যিকালে মিশরীয়রা পারলে তিনি পারবেন না? অবশেষে অনেক যুদ্ধের পরে ১৯৭৫ সালে গান্থার তাঁর ডক্টরেট শেষ করলেন, বিষয়- প্লাস্টিনেশন। মৃতদেহ সংরক্ষণ করার এক অভিনব পদ্ধতি যেখানে দেহের ভেতরের সমস্ত ফ্যাট আর ফ্লুইড সরিয়ে সিলিকন পলিমার ভরে দেওয়া হয়। লেম্যানের ভাষায় বললে প্লাস্টিকের মানুষ, যার শেষ নেই!
আরও পড়ুন, কিচিরমিচিরের ভাষান্তর
প্লাস্টিনেশনের আবিষ্কারের সাথে সাথে গোটা পৃথিবীতে সাড়া পড়ে গেল! অ্যানাটমিতে এত্ত বড় আবিষ্কার তো আগে হয়নি! গান্থারের পদ্ধতি ব্যবহার করে ধীরে ধীরে তৈরি হতে থাকল বিভিন্ন প্রাণীর মমি- গোরু, ঘোড়া, গোরিলা, কুকুর, বেড়াল, মানুষ কে নেই সেই লিস্টে! ৩৪০ জন কর্মচারীর অক্লান্ত পরিশ্রমে প্রথম জানা গেল জিরাফের হৃৎপিণ্ড ঠিক কীভাবে কাজ করে! অ্যানাটমি শেখার জন্যে আর তাজা মৃতদেহেরও প্রয়োজন রইল না। অমুক মানুষের তমুক তন্ত্র দেখতে চাও? যাও অত নম্বর স্পেসিমেনকে দেখে এসো। যত দিন বাড়তে থাকল গান্থারের গবেষণাগারে একের পর এক বাড়তে থাকল লাশ। দিনের পর দিন পরম যত্নে তাদের সংরক্ষণ করা চলতে থাকল পাল্লা দিয়ে। কিন্তু গান্থারের তাতে মন ভরল না! যে জ্ঞান তিনি আহরণ করেছেন তা কি শুধু তাঁর একারই থাকবে? ২০০২ সালে গান্থারের মাথায় এক নতুন ঝোঁক চাপল। তিনি পাঁচশজন বিশিষ্ট মানুষকে লন্ডনের থিয়েটারে নিমন্ত্রণ করলেন অটোপ্সি দেখানোর জন্যে। আবার বিতর্ক, এভাবে সবার সামনে পোস্টমর্টেম? ভগবান কী বলবে? যারা মানসিকভাবে দুর্বল তাদের কী হবে? আইন ভেঙে এমন প্রদর্শনী হলে সরকার কী বলবে? নির্দিষ্ট দিনে সমস্ত প্রশ্ন, এক হল লোক, টিভি রিপোর্টার এবং গাদা পুলিশকে নিয়ে গান্থার শুরু করলেন লাইভ পোস্ট মর্টেম। কই, ঘেন্না তো লাগছে না! অসোয়াস্তিও তো হচ্ছেনা! গোটা হলভর্তি মানুষ সেদিন ঘন্টার পর ঘন্টা হাঁ করে দেখে গেল আমরা ঠিক কী কী দিয়ে তৈরী। মানুষ ঠিক কতটা মেশিন! গোটা শোয়ের লাইভ টেলিকাস্টের পরে শুরু হল আরেক বিপত্তি- গোটা পৃথিবী থেকে ১৩০ টার মত অভিযোগ জমা পড়েছে টিভি চ্যানেলের বিরুদ্ধে। সঙ্গে গোঁড়া ক্যাথলিক এবং ইহুদিদের অভিসম্পাত। গান্থার এদের সক্কলের উত্তর দিলেন ২০০৬ সালে, "প্লাস্টিনেরিয়াম" নামের আস্ত একটা মিউজিয়াম খুলে যার মধ্যে শয়ে শয়ে মৃতদেহ আবার নতুন করে বাঁচছে।
একজন মানুষের মৃত্যুর আগে যে পরিচয়ই থাকুক না কেন, মৃত্যুর পরে সে লাশ। ছিটিয়াল, আধাপাগলা গান্থার ভন হ্যাগেন্স এক তুড়িতে এই ধারণাকে হাওয়া করে দিলেন। তাঁর তৈরি প্লাস্টিনেরিয়ামের মমিরা তাই বাক্সবন্দি নয়, কেউ তার প্রেয়সীকে আঁকড়ে ধরে দাঁড়িয়ে আছেন তো কেউ আড্ডায় মশগুল তার বাল্যবন্ধুদের সাথে, কেউ তার পোষা বাছুরের পিঠে চেপে ঘুরে বেড়াচ্ছে তো কেউ পরম স্নেহে আদর করছে তার সদ্যোজাত শিশুকে। শিল্পী? পাগল? বৈজ্ঞানিক? যে নামে ডাকুন, শুধু আসল ব্যাপার, শুধু নামটা মনে রাখবেন- গান্থার ভন হ্যাগেন্স।