ভারতের স্বাধীনতার মাত্র কয়েকদিন আগে, ১৯৪৭ সালের ২২ জুলাই, সাংবিধানিক সভায় বর্তমান ত্রিবর্ণ রঞ্জিত জাতীয় পতাকার রূপ গৃহীত হয়। তবে এই পর্যায়ে আসার আগে ভারতের জাতীয় পতাকাকে পেরিয়ে আসতে হয়েছে বেশ কয়েকটি ধাপ। কেমন ছিল আমাদের জাতীয় পতাকার নকশা তৈরির সেই ইতিহাস? এই নকশার আগে কি আরও ভিন্ন কোনও রূপে তৈরি হয়েছিল ভারতের জাতীয় পতাকা? যদি তাই হয় তাহলে কে বা কারা তৈরি করেছিল সেই নকশাগুলো? ভারতের স্বাধীনতার ৭৫ তম বর্ষ উদযাপনের এই ঐতিহাসিক সময়ে আসুন একবার ফিরে দেখা যাক আমাদের জাতীয় পতাকার সেই ইতিহাস।
ভারতে প্রথম জাতীয় পতাকার চাহিদা তৈরি হয় পরাধীন ভারতবর্ষে ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে। এই বছরে লর্ড কার্জন যখন বঙ্গভঙ্গ ঘোষণা করেন তখন বাঙালির মধ্যে জেগে ওঠা সুপ্ত জাতীয়তাবোধ ভারতের প্রথম জাতীয় পতাকার জন্ম দেয়। যদিও এর আগের বছর ১৯০৪ সালে ভগিনী নিবেদিতা জাতীয় পতাকার একটি নকশা তৈরি করেন। সেই নকশায় ছিল দুটো রঙ, হলুদ আর লাল। এর মাঝখানে ছিল ইন্দ্রদেবের বজ্রের ছবি এবং দুপিঠে বাংলায় লেখা 'বন্দে মাতরম্'। এখানে লাল রঙের তাৎপর্য ছিল দেশের স্বাধীনতার সংগ্রাম, হলুদ রাখা হয়েছিল জয়যাত্রার কথা মাথায় রেখে আর ইন্দ্রদেবের বজ্রকে রাখা হয়েছিল শক্তি বা পরাক্রমের ইঙ্গিত হিসাবে।
ভারতের মাটিতে প্রথম জাতীয় পতাকাটি উত্তোলিত হয় ১৯০৬ সালের ৭ আগস্ট; পারসি বাগান স্কোয়ারে (বর্তমানে গিরিশ পার্ক)। এই পতাকাটিকে 'দ্য ক্যালকাটা ফ্ল্যাগ'ও বলা হয়ে থাকে। এই পতাকাটির নকশা তৈরি করেছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামী শচীন্দ্র প্রসাদ বোস এবং হেমচন্দ্র কানুনগো। এই পতাকায় ছিল তিনটে রঙ, একদম উপরে সবুজ তারপর হলুদ আর তারপর লাল। এরই সঙ্গে সবুজ রঙের মধ্যে ছিল আটটা অর্ধ প্রস্ফুটিত পদ্ম, হলুদে ছিল দেবনাগরী হরফে লেখা 'বন্দে মাতরম্' আর লালে ছিল একটি অর্ধচন্দ্র এবং একটি সূর্য। যদিও এটি ছিল একটি আনঅফিসিয়াল পতাকা উত্তোলন।
'দ্যা ক্যালকাটা ফ্ল্যাগ'-এর উপর ভিত্তি করে ১৯০৭ সালে বার্লিনে সোশ্যালিস্ট কনফারেন্সে ভারতের একটি জাতীয় পতাকার প্রদর্শনী হয়। এই পতাকাটির নকশা তৈরি করেছিলেন ম্যাডাম ভিকাজি কামা, বিনায়ক দামোদর সাভারকার এবং শ্যামজি কৃষ্ণ ভার্মা। এই পতাকাটিকে 'দ্য কামা ফ্ল্যাগ'ও বলা হয়ে থাকে। 'দ্য ক্যালকাটা ফ্ল্যাগ'-এর মতোই এখানে তিনটে রঙ ছিল। তবে এখানে উপরে ছিল গেরুয়া, মাঝে হলুদ এবং তলায় সবুজ। উপরের হলুদ রঙে আটটা পদ্মের স্থানে ছিল সাতটা তারা যা আকাশের সপ্তর্ষিমণ্ডলকে ইঙ্গিত করে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল, মাঝের হলুদে আগের মতোই দেবনাগরী হরফে লেখা ছিল 'বন্দে মাতরম্' আর সবশেষে সবুজের মধ্যে ছিল একটা সূর্য আর একটা অর্ধচন্দ্র যার উপর ছিল একটা তারা। ১৯০৭ সালে এই পতাকাটি ম্যাডাম কামা এবং কয়েকজন ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামীদের দ্বারা বার্লিনেই উত্তোলিত হয়। ঐতিহাসিকভাবে এটি বিদেশে উত্তোলিত হওয়া ভারতের প্রথম জাতীয় পতাকা।
এরপর ১৯১৬ সালে হোমরুল আন্দোলন চলাকালীন আরও একটা ভারতীয় পতাকার নকশা দেখতে পাওয়া যায়। ডঃ অ্যানি বেসান্ত আর লোকমান্য তিলক হোমরুল আন্দোলনের প্রতীক হিসাবে ব্যবহার করার জন্য এই পতাকাটিকে মান্যতা দেন। এই পতাকায় পাঁচটা লাল আর চারটে সবুজ লাইন ছিল, উপরে ডানদিকের কোণে ছিল একটা অর্ধচন্দ্রর উপরে একটা তারা আর বাঁ দিকে উপরের কোণে আঁকা ছিল 'ইউনিয়ন জ্যাক' এবং তার ঠিক তলায় ছিল সপ্তর্ষিমণ্ডলের সাতটা তারা। তবে হোমরুল আন্দোলনের সঙ্গে এই পতাকার অস্তিত্বও লোপ পায়।
জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের পর ১৯২০ সালে নাগপুর কংগ্রেসে মহাত্মা গান্ধির পরিচালনায় অসহযোগ আন্দোলন আরম্ভ করার প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। এই সময়ে মহাত্মা গান্ধি প্রবলভাবে একটা জাতীয় পতাকার অভাব অনুভব করেন। এর প্রতিক্রিয়া স্বরূপ ১৯২১ সালের ১৩ এপ্রিল তিনি 'ইয়ং ইন্ডিয়া'তে লেখেন- "সমস্ত জাতিরই একটি পতাকা দরকার। লক্ষ লক্ষ লোক ইহার জন্য প্রাণ বিসর্জন করিয়াছে।…ভারতীয়দেরও ঐরূপ একটি পতাকা থাকা দরকার, যাহাকে অবলম্বন করিয়া আমরা বাঁচিয়া থাকিব, যাহার জন্য প্রয়োজন হইলে আমরা জীবন দিতেও কুণ্ঠিত হইব না।" (অনুবাদ: সুধেন্দুশেখর দাশগুপ্ত)। ঐ বছরেই বেজওয়াড়ায় সর্বভারতীয় কংগ্রেসের কমিটি মিটিং-এ পিঙ্গালি ভেঙ্কাইয়া মহাত্মা গান্ধীর কাছে জাতীয় পতাকার একটা নকশা প্রস্তাব করেন যেখানে ছিল লাল এবং সবুজ এই দুটো রঙ। মহাত্মা গান্ধী সেই নকশা দেখে তাঁকে বলেন সেখানে সাদা রঙ এবং চরকাকে অন্তর্ভুক্ত করতে।
পি. ভেঙ্কাইয়া এই প্রস্তাব অনুসারে উৎসাহের সঙ্গে কাজে লেগে পড়েন এবং গান্ধীজির পরামর্শ অনুযায়ী একটা পতাকার নকশা পেশ করেন। গান্ধিজির ব্যাখ্যা অনুযায়ী এই পতাকার একদম তলায় দেশের হিন্দু সম্প্রদায়কে বোঝাতে ব্যবহার করা হল লাল রঙ, যেহেতু তারা ছিল সংখ্যাগরিস্ট, তারপরে মুসলিমদের বোঝাতে ব্যবহার করা হল সবুজ রঙ যেহেতু তাঁরা হিন্দুদের চেয়ে সংখ্যালঘু এবং একদম উপরে ব্যবহার করা হল সাদা রঙ যা দেশের অন্যান্য সংখ্যালঘু ধর্ম সম্প্রদায়ের মানুষদের প্রতীক। সবশেষে অন্ন ও বস্ত্রের জন্য ভারত যে বহির্জগতের উপর নির্ভর করবে না- এই বার্তা পৌঁছনর জন্য গান্ধীজী পতাকায় স্থান দিলেন চরকাকে। এবং এই সময় থেকেই চরকার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে জাতীয় পতাকা খদ্দরে তৈরি হওয়া শুরু হয়।
এর ঠিক দশ বছর পর ১৯৩১ সালে শ্রী পি. ভেঙ্কাইয়া জাতীয় পতাকার নকশা আবার পাল্টান। হিন্দু সম্প্রদায়কে ইঙ্গিত করা লাল রঙ পাল্টে হয় গেরুয়া এবং স্থান পায় পতাকার একদম উপরে। শুধু তাই নয় এর তাৎপর্যও পরিবর্তন হয়। গেরুয়া ব্যবহার করা হয় শক্তির অর্থে । পূর্বে উপরে থাকা সাদা রঙ চলে আসে মাঝখানে এবং তা ব্যবহার করা হয় সত্যকে ইঙ্গিত করার জন্য। আগের মতোই পতাকার মাঝখানে চরকা বজায় থাকে। সবশেষে মুসলমান সম্প্রদায়কে ইঙ্গিত করা সবুজ রঙ চলে আসে একেবারে তলায় এবং এরও তাৎপর্য পরিবরতন হয়। সবুজ ব্যবহার করা হয় উর্বরতার কথা মাথায় রেখে। সেই সময়ে কংগ্রেস কমিটিতে এই পতাকাকেই দেশের সরকারি পতাকা হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়ার প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়।
অবশেষে, আসে সেই ঐতিহাসিক দিন। ১৯৪৭ সালের ২২ জুলাই ভারতের সাংবিধানিক সভার সদস্যরা দিল্লির সংবিধান ভবনে একত্র হন। পণ্ডিত জহরলাল নেহেরু প্রস্তাব দেন স্বাধীন ভারতের একটি জাতীয় পতাকা তৈরি করার। প্রস্তাব হয় সেই পতাকায় সমান্তরালভাবে তিনটে রঙ থাকবে। উপরে গেরুয়া, মাঝে সাদা এবং তলায় গাঢ় সবুজ রঙ সমান পরিমাণে থাকবে। মাঝখানের সাদা রঙের মধ্যে থাকবে অশোকের ধর্মচক্র। তাৎপর্যের ক্ষেত্রে ১৯৩১ এর পি.ভেঙ্কাইয়া নির্মিত পতাকার রঙের তাৎপর্যগুলোকেই বজায় রাখা হয় শুধুমাত্র চরকার স্থানে আসে অশোকের ধর্মচক্র।
স্বাধীন ভারতে ১৯৪৭ সালের ১৬ আগস্ট দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত জহরলাল নেহেরু লালকেল্লায় এই পতাকাই উত্তোলন করেন। যে পতাকা আজ ৭৫ বছর ধরে তার গৌরব অক্ষুণ্ণ রেখে উত্তোলিত হয়ে চলেছে।