Advertisment

বাংলার শিকড়: ইতি উতি হেস্টিংস

স্থানীয় মানুষের অজ্ঞতা এমনই যে ফুটপাথের চা বিক্রেতা মহিলাকে নন্দকুমারের ফাঁসি কোথায় দেওয়া হয়েছে জিগ্যেস করলে তৎক্ষণাৎ সন্ত্রস্ত উত্তর, ‘আমি জানি না, আমি সেদিন ছিলাম না!’

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
Heritage of Bengal, Hastings

কলকাতার হেস্টিংস

 হেস্টিংস-এর মোড়ে দাঁড়ালে একটি রাস্তা বিদ্যাসাগর সেতু বা দ্বিতীয় হুগলি সেতুর দিকে নিয়ে যায়, আর একটি যায় রবীন্দ্রসদন। একদিকে হাতছানি দেয় খিদিরপুর তো অন্যদিকে ফোর্ট উইলিয়াম। ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধের পর এই ফোর্ট উইলিয়ামের পুনর্নির্মাণে নিযুক্ত শ্রমিকদের বসতি ছিল এখানে, জায়গাটার নাম ছিল কুলীবাজার। তারও আগে গোটা অঞ্চল ছিল মুসলিমদের কবরখানা। কুলীবাজারও উঠে গিয়ে হেস্টিংস হয়ে গেল অর্ডন্যান্স এবং কমিশারিয়েট ডিপার্টমেন্টের লোকেদের টাউনশিপ। গঙ্গাতীরবর্তী গোটা অঞ্চল জুড়েই এখনো ব্রিটিশদের নিদর্শন ছড়ানো।

Advertisment

এমন সব নিদর্শনের অন্যতম হেস্টিংস নামাঙ্কিত চার্চ, হেস্টিংস চ্যাপেল।

Heritage of Bengal, Hastings হেস্টিংস চ্যাপেলের প্রবেশপথ

ছোট চার্চ বা কোন চার্চের অধীনস্থ চার্চকে চ্যাপেল বলে। বহুদিন পরিত্যক্ত অবস্থায়  থাকার পর ১৯৫৬ সাল থেকে হেস্টিংস চ্যাপেল উত্তর ভারতের ইউনাইটেড মিশনারী চার্চ এর অধীনে। এই চ্যাপেলটি প্রতিষ্ঠার সময়কাল খুব নির্ভরযোগ্যভাবে না জানা গেলেও সম্ভবত এটি ১৮৪০ সালে স্থাপিত হয়, ভাইসরয় লর্ড বেন্টিঙ্ক এর স্ত্রী লেডি বেন্টিঙ্ক এর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। তখন শহরের পশ্চিম দিক দিয়ে বয়ে যাওয়া গঙ্গার তীরে বহু জাহাজঘাটা ও বন্দর ছিল। যেমন খিদিরপুর, গার্ডেনরীচ প্রভৃতি। তাই আনাগোনা ছিল নাবিক, জাহাজীদের। ১৮৫৭-র সিপাহী বিদ্রোহের পর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অফিসারদেরও আনাগোনা ছিল এই চার্চে। সে সময় চার্চ চত্বর আরো বিশাল ছিল। আশেপাশে ছিল সামরিক অফিসার এবং উচ্চপদস্থ ব্রিটিশ নাগরিকদের বসবাস। তেমনই একজন স্বনামধন্য মানুষ হেস্টিংসের ঘনিষ্ঠ রিচার্ড বারওয়েল সাহেব। যিনি পুরানো সেন্ট অ্যান্স চার্চের জমি টমাস লিওনকে লিজ দিয়েছিলেন রাইটার্স বিল্ডিং বানানোর জন্য।

বাহুল্যবর্জিত সুন্দর চ্যাপেলটির স্থাপত্য বড়ই সোজাসাপটা। আটটি ডোরিক থাম রয়েছে সামনে, মাথার উপর ত্রিভুজাকৃতি অলঙ্কারবিহীন পেডিমেন্ট।

Heritage of Bengal, Hastings ত্রিভুজাকৃতি অলঙ্কারবিহীন পেডিমেন্ট)

তারপর একটি লম্বা পোর্টিকো।

Heritage of Bengal, Hastings পোর্টিকো

চার্চটি হলুদ রঙে রং করা। ভেতরের প্রার্থনা কক্ষে রয়েছে মার্জিত ছিমছাম সরু থাম আর মাথার বিম ধরে রেখেছে সমতল ছাদটিকে।

Heritage of Bengal, Hastings থাম ও বিম

অল্টারটিও কারুকার্যবিহীন। শুধু রয়েছে একটি কাঠের ক্রস।  সম্প্রতি ২১ অগাস্ট ২০১৮য় সংস্কার ও মেরামত করার ফলে চার্চটির প্রাচীনত্ব খানিক হ্রাস পেয়েছে। দেওয়ালে লেগেছে সস্তার টালি, পুরানো কাঠের প্রার্থনার বেঞ্চের বদলে ঠাঁই পেয়েছে টিনের চেয়ার,  মেঝের মার্বেল বদলে গেছে আধুনিক সিমেন্টে। দেওয়ালের একটি ফলকের লেখা থেকে জানা যাচ্ছে চার্চের সদস্যরা সোনা, রুপো ও অর্থ দিয়ে সংস্কারের কাজে সাহায্য করেছেন। দরজার বাঁদিকে রয়েছে চারটি স্মৃতিফলক। চারজনের মধ্যে তিনজন পুরুষই ছিলেন মিশনারি। একজন মহিলা যিনি এই চ্যাপেলের যাজক রেভারেন্ড টি. ই. স্ল্যাটারের স্ত্রী মেরী সোফিয়ার,  যিনি ২৭ বছর ২ দিন বয়সে মারা যান ১১ই অগাস্ট ১৮৭০-এ জাহাজে করে তার স্বদেশে ফেরার পথে। তাঁর দেহ সলিল সমাধি দেওয়া হয় স্পেনের বে অফ ক্যাডিজ-এ।

Heritage of Bengal, Hastings স্মৃতিফলক

স্ল্যাটার বার্মিংহামে অধ্যাত্মবাদের শিক্ষা নিয়ে লন্ডন মিশনারি সোসাইটিতে যোগদান করেন। ১৮৬৬ সাল থেকে তাঁদের হয়ে তিনি কলকাতা, মাদ্রাজ আর ব্যাঙ্গালোরে কাজ করেছেন। দ্বিতীয় ফলকটি রেভারেন্ড জন হেনরি পার্কারের। তিনিও লন্ডন মিশনারি সোসাইটিতে ১৫ বছর ধরে কাজ করেছেন। তিনি জন্মগ্রহণ করেন ১৪ই নভেম্বর ১৮১৬ সালে হ্যাকনেতে। মারা যান ভবানীপুরে। ৯ সেপ্টেম্বর ১৮৫৮য়। তিনি যাজকের ভুমিকায় খ্রীষ্টধর্ম প্রচারের কাজে জীবন অতিবাহিত করেন। ভবানীপুরের মিসেস মুলেন্স মারা যান ২১ নভেম্বর ১৮৬১ সালে ৫৫ বছর বয়সে। ফলকটি তাঁর কুলীবাজারের প্রিয় বন্ধুরা এখানে লাগান। চতুর্থ ফলকটি রেভারেন্ড জেমস এডওয়ার্ড পেইন-এর। তিনিও চার্চের যাজক ছিলেন। জন্মগ্রহণ করেন অ্যাভেনবারি হেয়ারফোর্ডশায়ারে। সাধারণ মানুষের সামাজিক উন্নতির জন্য বহু জনসেবামুলক কাজ করে গেছেন তিনি। ছাব্বিশ বছর ধরে কলকাতায় মিশনারির কাজ করে গেছেন। মারা যান ভবানীপুরে ৩০ অগাস্ট ১৮৮৬ সালে।

হেস্টিংস চ্যাপেল থেকে বেরিয়ে সেন্ট জর্জ রোড ধরে কয়েক পা পেছনের দিকে অর্থাৎ রবীন্দ্রসদনের দিকে কিছুটা হাঁটলেই আর একটা জায়গায় পৌছানো যাবে সেখানেও জড়িয়ে আছে হেস্টিংসের নাম। ব্রিটিশ ইন্ডিয়ার প্রথম গভর্নর জেনারেল হিসাবে অনেক কাজ করলেও ওয়ারেন হেস্টিংসের নাম করলেই স্মরণে আসে দুটি ঘটনা। একটি ফিলিপ ফ্র্যান্সিস-এর সঙ্গে ডুয়েল লড়া। আজকের আলিপুরের ডুয়েল এভিনিউতে হয়েছিল সেই লড়াই, যাতে ফ্রান্সিস আহত হয়েছিলেন। আর দ্বিতীয়টি ভারী অমানবিক, এক বিচারজাত হত্যা (জুডিশিয়াল মার্ডার) - মহারাজা নন্দকুমারের ফাঁসি।

আরও পড়ুন, যখন বর্গী এসেছিল দেশে

১৭৭৩ সাল, কলকাতার দেখভাল, আইনকানুন গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস আর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির তৈরি সুপ্রিম কাউন্সিল-এর হাতে। জমিদার নন্দকুমার নবাবী আমল শেষ করে ইংরেজদের রাজপাট প্রতিষ্ঠা করতে সাহায্য করে তাদের নেকনজরে পড়েন। তাঁকে বর্ধমানের কর সংগ্রাহক হিসাবে  নিযুক্ত করা হয়। তিনি ১৭৬৪ সালে রাজা শাহ আলম (দ্বিতীয়)-এর থেকে মহারাজা উপাধি পান। একটি ঘটনায় তিনি হেস্টিংসের বিষনজরে পড়েন। নন্দকুমার অভিযোগ আনেন যে মীরজাফরের বিধবা পত্নী মুন্নী বেগমকে তার নাবালক সন্তান নবাব মুবারকউদদৌল্লার অভিভাবকত্ব পাইয়ে দেবার জন্য হেস্টিংস সাড়ে তিন লাখ টাকা উৎকোচ নেন। হেস্টিংস এই অভিযোগ থেকে প্রমাণাভাবে বেঁচে গেলেও প্রতিশোধস্পৃহায় নন্দকুমারের বিরুদ্ধে দুটি মিথ্যা জালিয়াতির অভিযোগ আনেন। নন্দকুমার নাকি একজন মহাজন বোলাকি দাস শেঠের সত্তর হাজার টাকা আত্মসাৎ করেছেন। দ্বিতীয় অভিযোগ কামালউদ্দিন বলে এক ব্যক্তিকে হেস্টিংসের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনার জন্য প্ররোচিত করেছেন। এই সাজানো মামলায় নন্দকুমারকে ফাঁসির আদেশ দেন হেস্টিংসের ঘনিষ্ঠ বন্ধু সুপ্রিম কোর্টের প্রথম প্রধান বিচারপতি এলিজা ইম্পে। এদেশে সুপ্রিম কোর্টের সুদীর্ঘ ইতিহাসে নন্দকুমারের বিচার সবচেয়ে বেশি আলোড়ন তুলেছিল। এই কলঙ্কিত অধ্যায়টির নামই হয়েছিল ‘মিসক্যারেজ অব জাস্টিস’। যদিও ব্রিটিশ আইনে দেশীয় লোকদের জালিয়াতির সাজা ফাঁসিই ছিল তবু এই মিথ্যে প্রহসনমুলক মামলায় যে হেস্টিংসের সম্পূর্ণ হাত ছিল এটি সেযুগেও সবাই স্বীকার করে। এর ফলে হেস্টিংসকে দেশে ফিরে যেতে হয় ও সেখানেও তাকে অভিযুক্ত করে প্রায় সাত বছর মামলা চলে।

আরও পড়ুন, সেন্ট জনস চার্চ: যেন এক জাদুঘর

নন্দকুমার সম্ভ্রান্ত জমিদার। ফাঁসির হুকুম শুনেও বিচলিত হন নি। শুধু চেয়েছিলেন আদি গঙ্গার কাছেই যেন তার ফাঁসি হয়। যাতে আজকের টালি নালা অর্থাৎ আদি গঙ্গার কোনও ঘাটে তাঁর শেষকৃত্য সম্পন্ন হতে পারে। কিন্তু জায়গাটি বর্তমানে ঠিক কোথায় জানা যায়নি। দিনটা ছিল ৫ অগাস্ট ১৭৭৫, প্রায় ২৫০ বছর আগে। তারপর গঙ্গা দিয়ে অনেক জল বয়ে গেছে, কলকাতার চালচিত্র বহু পাল্টে গেছে। তাই সঠিক স্থানটি অনুমানসাপেক্ষ এবং বিতর্কিত। খিদিরপুরে আদি গঙ্গার উপর যে ব্রিজ তার হেস্টিংস দিকের প্রান্তে একটু এগোলেই পশ্চিমদিকে রাস্তা গেছে গঙ্গার দিকে, সংযোগে একটা ছোট ত্রিভুজাকৃতি অঞ্চল। এখন সেখানে বেড়া দিয়ে ঘেরা একটি কুয়ো।

Heritage of Bengal, Hastings জনশ্রুতি অনুসারে নন্দকুমারের ফাঁসি হয়েছিল এখানেই

কোন ফলক নেই, শোনা যায় একসময় ছিল। নন্দকুমারের ফাঁসি এখানেই হয়েছিল বলে শোনা যায়। রাস্তার পাশে ঘোড়ায় চড়া হেস্টিংসের মূর্তি (সম্ভবত), সেটিও ফলকহীন।  স্থানীয় লোকেরা আজও জায়গাটিকে বলে ফাঁসিঘর। কলকাতার যে মানুষেরা সেদিন নন্দকুমারের ফাঁসি দেখতে জড়ো হয়েছিল, ব্রহ্মহত্যার পাপ ধুতে গঙ্গাস্নান করে কুলীবাজার থেকে বাড়ি ফিরেছিল সবাই। বহু সম্ভ্রান্ত মানুষ নাকি কলকাতা ছেড়েছিলেন কারণ এ শহরে ব্রহ্মহত্যার পাপ লেগে গেছিল।

Heritage of Bengal, Hastings ফলকহীন এ মূর্তিটি ওয়ারেন হেস্টিংসের বলেই মনে করা হয়

তবে মজার ঘটনা, বর্তমানে স্থানীয় মানুষের অজ্ঞতা এমনই যে ফুটপাথের চা বিক্রেতা মহিলাকে নন্দকুমারের ফাঁসি কোথায় দেওয়া হয়েছে জিগ্যেস করলে তৎক্ষণাৎ সন্ত্রস্ত উত্তর, ‘আমি জানি না, আমি সেদিন ছিলাম না!’

মহারাজ নন্দকুমারের একটি জিনিস ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের গ্যালারিতে রাখা আছে, একটি হালকা খয়েরি আর ক্রিম রঙের জরির পাগড়ি। কী অদ্ভুত, যে নন্দকুমারকে সবাই ভুলে গেছে অথচ ষড়যন্ত্রকারী বিদেশি ওয়ারেন হেস্টিংসের স্মৃতি রয়ে গেছে এ অঞ্চলের নামে। এখন এখানে প্রবাহিত কালো দুর্গন্ধযুক্ত জল বুকে নিয়ে ক্ষীণতোয়া আদি গঙ্গা নামক খাল, যার স্রোতে একসময় ভাসত পালতোলা নৌকার সারি। অপবিচারের ক্লেদ জমেই তার এ হাল কিনা, কে বলতে পারে!

heritage Banglar Shikor
Advertisment