‘আমাদের বাগানকে ঘনিষ্ঠ বাঁধনে জড়িয়েছে পত্রপল্লবের অবাধ পাথার,
তবে সে সাগর নয় বৈচিত্র্যবিহীন সবুজের রাজ, একঘেয়ে নীরস বিস্তার!’
উপরের কবিতাটি কার ইংরেজি কবিতার অনুবাদ – এ প্রশ্নে প্রায় শতকরা একশো ভাগ লোকই সঠিক অনুমান করতে পারতে পারবেন না। পুরো দুটো শতক পিছিয়ে ১৮০০ সালের মাঝামাঝি গেলে স্মৃতিপটে উঠে আসবে অল্পবয়সী এক সুন্দরী তরুণীর নাম। তরু দত্ত। প্রথম বাঙালি মহিলা যিনি ফরাসি ও ইংরেজি দুই ভাষাতেই সমান দাপটের সঙ্গে লিখেছেন।
আরও পড়ুন, বাংলার শিকড়: শাহী ইমামবাড়া- নির্বাসিত নবাবের শেষ শয্যায়
১৮৫৬ সালের ৪ মার্চ রামবাগানের দত্ত পরিবারে তরু দত্তের জন্ম। পিতা গোভিন চন্দ্র দত্ত। মা ক্ষেত্রমোহিনী। গোভিন চন্দ্রের তিন সন্তান, অরু, তরু ও পুত্র অব্জু। সবাই ছিলেন স্বল্পায়ু। অব্জু বেঁচে ছিলেন মাত্র চোদ্দ বছর। অরু দত্ত মারা যান কুড়ি বছর বয়সে। আর তরু ৩০ আগস্ট ১৮৭৭, একুশ বছর বয়সে।
সেযুগে রামবাগানের দত্ত পরিবার ছিল শিক্ষিত ও ধনী। এই পরিবারের রমেশচন্দ্র দত্ত ছিলেন ঐতিহাসিক, ভাষাবিদ, রাজনীতিজ্ঞ এবং আইএএস হয়ে আলিপুর কোর্টে সহকারী ম্যাজিস্ট্রেট পদানসীন। তাঁরই নামানুসারে তরু দত্তের বাসভবনের সামনের মানিকতলা স্ট্রিট আজ রমেশ দত্ত স্ট্রিট।
তরুর পরিবার ডেভিড হেয়ার, আলেকজান্ডার ডাফ, উইলিয়াম কেরী প্রমুখ তৎকালীন খ্রীষ্টধর্মের পৃষ্ঠপোষকদের সংস্পর্শে এসে ১৮৬২ সালে সপরিবারে খ্রীষ্টধর্ম গ্রহণ করেন। বর্তমানে স্কটিশ চার্চ কলেজের উল্টোদিকে যে গির্জা, সেখানেই তাঁদের ধর্মান্তরণ ঘটেছিল।
আরও পড়ুন, বাংলার শিকড়: ইতি উতি হেস্টিংস
একমাত্র পুত্র অব্জুর মৃত্যুর পর তরুর বাবা ইউরোপে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। ১৮৬৯ সালে ফ্রান্সে আসেন, তরু এবং অরুকে ভর্তি করেন দক্ষিণ ফ্রান্সের এক আবাসিক স্কুলে। সেখানে দুই বোন ফরাসি ভাষায় বিশেষ পারদর্শিতা লাভ করেন। শুরু হয় দুজনের কবিতা লেখা। ১৮৭১ সালে তাঁরা চলে আসেন কেমব্রিজে। সেখানে শুরু ইংরেজি ভাষার চর্চা। সেখানে তাঁরা কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘হায়ার লেকচারস ফর উইমেন’-এ যোগদান করেন। ১৮৭৩ সালে তাঁরা দেশে ফিরে আসেন মূলত ভগ্ন স্বাস্থ্যের কারণে। ১৮৭৪ সালে অরু মারা যান। তরু দত্ত বোনের মৃত্যুতে ভীষণ আঘাত পান, কারণ সর্বদা দুই বোন মিলেমিশে সাহিত্যচর্চা করে গেছেন। দুজনে যুগ্মভাবে অনুবাদ করেছিলেন বেশ কিছু ফরাসি কবিতা। আবার বেশ কিছু কবিতা তরু লিখেছেন, অরু অলংকরণ করেছেন।
জীবনের অধিকাংশ সময় ইউরোপে কাটালেও তরুর অন্তরে গভীর ভালোবাসা ছিল দেশের প্রকৃতি, গাছপালা, পুরান, মহাকাব্যের ওপর। নদী মাঠ ক্ষেত ছিল তাঁর প্রকৃতিপ্রেম সম্পর্কিত কবিতার বিষয়। তিনি যেমন লিখেছেন ফরাসি কৃষিজমির কথা, তেমনই লিখেছেন দেশের পুকুর, বড় বড় ছায়াভরা গাছের কথা। তাঁর কবিতায় ভিড় করেছে তাল, তমাল তরু, শিমুল ফুল, বাঁশ বাগান। চাঁদের জ্যোৎস্না খেলা করেছে তাঁর কবিতার ছন্দে। ঝাউবন তাঁর মনে, কবিতায় অনুরণন তুলতো অনুক্ষণ। তাঁর সবচেয়ে বিখ্যাত কবিতাটি ‘Our Casurina Tree’। পদ্মফুলও ধরা দিয়েছে তাঁর কবিতায়, কবিতার নাম ‘Lotus’। তরু দত্তের লেখায় মানবজীবনের সমস্যা যেমন উঠে এসেছে, পুরান, রামায়ণ, মহাভারতও ছুঁয়ে গেছে তাঁর সৃষ্টি। তৈরি হয়েছে সাবিত্রী, একলব্য, সীতা। মৃত্যুর এক বছর আগে ১৮৭৬-এ ফরাসি থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করা তাঁর ১৫০টি কবিতার সংকলন ‘A Sheaf Gleaned in French Field’ (ফরাসি ক্ষেতে কুড়ানো এক আঁটি ফসল) প্রকাশিত হয়। তাঁর বাবা মৃত্যুপথযাত্রী মেয়ের প্রতি ভালোবাসায় নিজ ব্যয়ে কবিতা সংকলনটি প্রকাশ করেন ভবানীপুরের সাপ্তাহিক সংবাদ প্রেস থেকে। এর মধ্যে চারটি কবিতা দিদি অরু দত্তের অনুবাদ। ১৮৭৭ এ সমালোচক এডমন্ড গুজ এটি পড়েন এবং ভূয়সী প্রশংসা করে রিভিউ প্রকাশ করেন। তাঁর মৃত্যুর পর বইটির আরো সংস্করণ বের হয়। কিগান পল লন্ডন থেকে এর তৃতীয় সংস্করণ প্রকাশ করেন।সংস্কৃত সাহিত্য থেকে নেওয়া ‘Ancient Ballads and Legends of Hindustan’ তাঁর মৃত্যুর পর ছাপা হয়। ১৮৭৭ এ তাঁর বাবা এর পাণ্ডুলিপি আবিষ্কার করেন।
আরও পড়ুন, যখন বর্গী এসেছিল দেশে
তাঁর মৃত্যুর পর প্রকাশিত হয় তাঁর ফরাসি ভাষায় ডায়রির আকারে লেখা উপন্যাস ‘মাদমোয়াজেল দ্যারভারের দিনপঞ্জী’ (La Journal de Mademoiselle d’Arvers). এটি কোনো ভারতীয় লেখকের ফরাসি ভাষায় লেখা প্রথম উপন্যাস। উপন্যাসটি অনুবাদ করে বসুমতী পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করা হয়। এই উপন্যাস এতটাই প্রাসঙ্গিক যে বহু বছর পর ১৯৫৬ সালে এটি বই আকারে বের হয়, যার ভূমিকা লেখেন প্রখ্যাত সাহিত্যিক প্রেমেন্দ্র মিত্র। তেমনি তাঁর মৃত্যুর পর প্রকাশিত ‘Bianka’ বা ‘Young Spanish Maiden’ ও প্রথম ভারতীয় মহিলা লেখিকার ইংরেজিতে লেখা উপন্যাস।
তরু দত্তের চিঠির সংকলনও প্রকাশ পায়। তাতে আছে তাঁর বিদেশি বন্ধুদের লেখা চিঠি এবং বিদেশ থেকে দেশে আত্মীয়দের লেখা চিঠি। চিঠিগুলো থেকে তৎকালীন জীবনযাত্রা, তরুর প্রকৃতিপ্রেম, মানবচেতনা, তাঁর ভাবনা জানা যায়। এই সব লেখা থেকে তাঁর ভাষার দক্ষতা প্রকাশ পায়। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মেলবন্ধন ঘটেছে তাঁর লেখনীতে। মনেপ্রাণে ভারতীয় হয়েও এক হাতে ফরাসি অন্য হাতে ইংরেজি সাহিত্যকে ছুঁয়েছিলেন। প্রাচীন ভারতের ঐতিহ্য, ফরাসি কোমলতা ও ইংরেজি আভিজাত্য – এই তিন নিয়েই তরু দত্ত।
আরও পড়ুন, হাওড়ার জানবাড়ী: তন্ত্রসাধনার গর্ভগৃহ
তরুর মৃত্যুর পর কলকাতার বাস উঠিয়ে যে বাড়ি ছেড়ে পাকাপাকিভাবে বিদেশে চলে যান গোভিন চন্দ্র দত্ত, সে বাড়ি কেনেন জনৈক বসু পরিবার। সেই বিশাল বাড়ি, ক্যাসুরিনা গাছঅলা সেই বাগান আজ ১২এ, বি ও সি তিনটি আলাদা নম্বরে বিভক্ত। রমেশ দত্তের বাড়ি প্রোমোটারের হাতে পড়ে এখন মধ্যবিত্তের বাক্সবাড়ি। ১২বি ও ১২সি’র বাসিন্দা এ বাড়ি হেরিটেজ ঘোষনার দাবী জানিয়েও পরবর্তীকালে নিজেদের অংশ বিক্রি করে দিয়েছেন। ১২এ অংশের মালিকানা দেবকুমার বসু এবং তাঁর স্ত্রী শোভাবাজার রাজপরিবারের কন্যা শ্রীমতী অপর্ণা দেবীর। তাঁরা জানান, তরু দত্তের কোনো অস্থাবর সম্পত্তি বা ছবি নেই আর এখানে। কিন্তু দত্ত পরিবারের ব্যবহৃত কাঠের সিঁড়িটি তাঁরা রেখে দিয়েছেন অবিকল।
দেবকুমারবাবুর বাবা ঐ সিঁড়ির সাথে সাযুজ্য রেখে বারান্দায় যাবার ছোট কয়েক ধাপের সিঁড়িও পরবর্তীকালে বানিয়ে নিয়েছিলেন। ভাগাভাগির ফলে আমূল বদলে গেলেও নজরে পড়ে কড়িবরগা, কাঠের দরজা, খড়খড়িওলা জানলা। রয়েছে তরু দত্তের লাইব্রেরি ঘরটিও। লম্বা স্নানঘর দ্বিখণ্ডিত হয়ে গেলেও তার ওপরের লফটটি আছে অপরিবর্তনীয়। বাড়ির বাইরে নজরে আসে একটি ছদ্ম জানলা। উনিশ শতকে মন্দির, মসজিদে এমন ছদ্ম জানালা ও দরজা বানানো হত, বসতবাটির ক্ষেত্রে তা খুবই বিরল। খড়খড়ি ও ফ্রেম যুক্ত জানলাটি দেখলে একেবারেই আসল বাতায়ন মনে হয়।
একুশ বছরের মেয়েকে স্নেহময় পিতা সমাহিত করেন মানিকতলার খ্রীষ্টান সিমেটারিতে। পরিবারের অনেকেই সমাধিস্থ হয়েছেন ওখানে। সমাধি ক্ষেত্রের উত্তরপশ্চিম প্রান্তে রয়েছে সপরিবার তরু দত্তের সমাধি। ছোট কালো পাঁচিলের ঘেরাটোপে একে একে অব্জু দত্ত, অরু দত্তের পাশে সমাধিস্থ তরু দত্ত।
তরুর ওপরের দিকে চিরনিদ্রায় শায়িত বাবা ও মা। প্রত্যেক কবরের ওপর একটি মার্বেল স্ল্যাব ও তার ওপর একটি ক্রশ। তরুর কবরও একই রকম দেখতে, তাতে লেখা
TORU DUTT
YOUNGEST DAUGHTER OF
GOVIN CHUNDER DUTT
BORN 4 MARCH 1856
DIED 30 AUGUST 1877
ET THOU FAITHFUL UNTO DEATH AND
WILL GIVE THEE CROWN OF LIFE
তরু দত্তের ১৫০ তম জন্মবার্ষিকীতে ৪ মার্চ ২০০৭-এ তাঁর সমাধির চারপাশে কিছু সংস্কার হয়। অব্জু, তরু , অরু ও তাঁদের বাবা-মায়ের সমাধিকে ঘিরে দেওয়া হয়। একটি পাথরের ফলকও লাগানো হয় তৎকালীন মন্ত্রী এবং একটি সমাজকল্যাণমূলক সংস্থার উদ্যোগে।
তারপর আরো বারো বছর গড়িয়ে গেছে। এখন তাঁদের কবরকে ঘিরে স্থানীয় মানুষ কাপড় শুকোয়, পথকুকুররা নির্বিবাদে ঘোরাফেরা করে। আগাছার জঙ্গল ক্রমে বড় হয়। কদিন পর হয়তো আগাছায় মুখ ঢেকে চিরতরে আবার বিস্মৃতির অন্ধকারে তলিয়ে যাবেন ‘বাংলার কিটস’, বিদেশি ভাষায় কবিতা রচয়িতা প্রথম ভারতীয় তথা বাঙালি মহিলা কবি।