উচ্চমাধ্যমিকের ফল প্রকাশ হল। আজকাল যা ধারা তাতে প্রথম দশটা নম্বরের মধ্যেই কয়েকশো পড়ুয়া থাকে। ধরা যাক পরীক্ষাটা ৫০০ নম্বরের। শূন্য পেলেও আপনি পাঁচশো এক স্থানাধিকারী। কীভাবে? শূন্য থেকে পাঁচশো পর্যন্ত মোট পাঁচশো একটি সংখ্যা। তাই আপনি যদি শূন্য পান তাহলে তার আগে আছে পাঁচশোটি ভিন্ন নম্বর। ফলে আপনি পাঁচশো এক-তম। সেই নিয়মেই প্রথম দশে এখন একশো সাঁইত্রিশ কিংবা নশো নিরানব্বুই, হয়ত বা কিছুদিন পরে এগারো হাজার সাতশো সাতাত্তর জন পড়ুয়া থাকবে।
বিষয়টা শুধু পশ্চিমবঙ্গে নয়, সারা দেশের নিরিখে সত্যি। অন্যান্য সর্বভারতীয় বোর্ডগুলোরও এই একই হাল। প্রচুর সংখ্যায় পড়াশোনায় ভালো ছাত্রছাত্রী তীব্র লড়াই করছে নম্বরটুকু ঘরে আনার জন্যে। একশো তিরিশ কোটির দেশে এই প্রতিযোগিতা থাকবেই। তাই নম্বর বেশি দেওয়া হচ্ছে বলে ক্ষোভপ্রকাশ করে লাভ নেই। বরং এটা বোঝার প্রয়োজন যে চূড়ান্ত প্রতিযোগিতার আবহে অনেক বেশি পরিশ্রম করে নম্বর ছিনিয়ে নিচ্ছেন পরীক্ষার্থীরা। শুধু পড়াশোনায় কেন? বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতানেত্রীরা নিচের সারির কর্মীদের জন্যে কোটা ঠিক করে দেন, যে অমুক বুথে এত ভোট না পেলে জুটবে তিরস্কার। সে জন্যেই তো ভোটলুঠের লড়াইতে জীবন বাজি রাখতে হয় সংসদীয় গণতন্ত্রে। একই অবস্থা সুস্বাদু খাদ্য সরবরাহ করা দ্বিচক্রযান আরোহীদের। সময়ে না পৌঁছতে পারলে কাজ হারানোর ভয়। তাই তীব্র গতিবেগে সর্পিল ভঙ্গিমায় বাস লরির পাশ দিয়ে, রিকশাকে ঠুকে, মানুষকে ছুঁয়ে দিয়ে দিনরাত শহরের বুকে বাইক রেস।
এই তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতার শেষ কোথায় তা জানা নেই। জীবনের প্রতিটি পর্যায়ে এর রূঢ় উপস্থিতি। তবে বিষয়টা যে ভয়ঙ্কর, সমাজের সুস্থ স্বাভাবিক বোধ যে এই পরিস্থিতিতে ধরে রাখা সম্ভব নয়, সেকথা বুঝছেন সবাই। কিন্তু উদ্ধারের কোন পথ নেই। তার প্রধান কারণ বিপুল জনসংখ্যা, আর কাজের ক্ষেত্র সংকুচিত হচ্ছে ক্রমাগত।
গড় হিসেবে আমাদের দেশে পড়াশোনা করলেই সবথেকে বেশি সুযোগ থাকে কোন কাজ পাওয়ার। সেখানে আবার মুশকিল হল ভারতবর্ষে গত প্রায় বিশ বছর ধরে পড়াশোনার সঙ্গে কাজের সম্পর্ক এক অদ্ভুত গোলমেলে জায়গায় গিয়ে পৌঁছেছে। যেমন আমাদের দেশে যে কোন প্রযুক্তি বিভাগের স্নাতকদের মধ্যে একটা বড় অংশ যোগ দেন সফটওয়্যারের কাজে। সেই বৃত্তিতে তাদের ব্রিজ বা বড় তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র বানানো সংক্রান্ত তাত্ত্বিক বা ফলিত শিক্ষা কোন কাজে আসে না।
সারা জীবন ধরে কম্পিউটারের সামনে তারা যে ধরনের বুদ্ধির কাজ করেন তার বেশিরভাগটাই উচ্চমাধ্যমিক স্তরেই শেখা হয়ে যায়। অর্থাৎ কোন কোম্পানি যদি বারো ক্লাস পাশ করা কিছু বুদ্ধিমান পড়ুয়াদের কয়েক মাসের প্রশিক্ষণ দিয়ে এই কাজগুলো করান, তাহলে কোন অসুবিধেই হওয়ার কথা নয়। পৃথিবীর বিভিন্ন উন্নত দেশে একথা সত্যি। ইংল্যান্ডে যারা ভালো অঙ্ক জানেন তারা অনেক সময়েই বারো ক্লাসের পড়াশোনা শেষ করে কোন সংস্থায় কম্পিউটার প্রোগ্রামিং-এর কাজে যোগ দেন। অর্থাৎ উচ্চমাধ্যমিক স্তরের শিক্ষা শেষ করার পর আমরা যে ধরনের বিশেষ দক্ষতার সন্ধানে তার পরের ধাপের পড়াশোনা করে থাকি, অনেক ক্ষেত্রেই কাজের জায়গায় তার কোন প্রয়োজন হয় না। আমাদের দেশে এই বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে ভাবা উচিৎ।
দুর্ভাগ্যবশত যারা দেশ চালান তাদের পক্ষে অনেক সময়েই এতো গভীরে গিয়ে ভাবার অবকাশ কম। উচ্চমাধ্যমিকের ফলপ্রকাশের পর ফেসবুকে রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রীর জনগণের কাছে মতামত চাওয়া তাই খুব কাজে দেবে বলে মনে হয় না। সমস্যা যে কতটা গভীরে সেটা বুঝতে পারলে কার্যকরী শিক্ষা সম্পর্কে অনেক গুরুত্ব দিয়ে ভাবার চেষ্টা করত যে কোন সরকার। ভোটে খারাপ ফল করার পর জনগণকে খুশি করার জন্যে মতামত চাইতে হত না মাননীয় মন্ত্রীকে। রাজ্যকে দুষে লাভ নেই, ঘটনা কেন্দ্রের ক্ষেত্রেও একই। আসলে স্বাধীনতার পর থেকে শিক্ষায় উৎকর্ষ নিয়ে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা খুব বেশি নেওয়া হয় নি। যেটুকু কাজ হয়েছে তা আমাদের দেশের আকার এবং জনসংখ্যার তুলনায় ভীষণভাবে অপ্রতুল। শিক্ষা তাই চলেছে শিক্ষার মতই, সেই পুরনো পথে, সেখানে যা পড়ানো হয় তার সঙ্গে কাজের সম্পর্ক ভীষণ কম। শুধুমাত্র যারা স্কুল শিক্ষক হচ্ছেন তাদের জন্যে হয়ত স্কুলের বিভিন্ন পড়াশোনা কিছুটা কাজে লাগে, বাকিদের ক্ষেত্রে বেশিরভাগটাই জলে।
সুষ্ঠুভাবে দেশ চালাতে গেলে বিপুল সংখ্যক মানুষকে কাজ দেওয়ার দায়িত্ব সরকারের। সবটাই সরকারি চাকরি হতে হবে এমনটা নয়। বেসরকারি পুঁজিকেও ঠিকভাবে ব্যবহার করার জন্যে সরকারি পরিকল্পনার প্রয়োজন। আমাদের দেশে ঘাম না ঝরানো চাকরি পেতে গেলে মূলত যে ধরনের দক্ষতা লাগে তা শেখার একমাত্র উপায় ইস্কুল আর কলেজের পড়াশোনা। খুব সহজ হিসেবে এখন প্রতি বছর দুকোটির ওপর ছেলেমেয়ে দ্বাদশ শ্রেণীর পরীক্ষায় পাশ করে। এদের মধ্যে সম্ভবত কেউই আর শ্রমিক কিংবা কৃষক হতে চায় না। তারা যে কাজ চাইছেন সেই ধরনের কাজে পেশিশক্তির প্রয়োজন কম, মূলত ব্যবহার হয় বুদ্ধি এবং মেধা। দেশে এমন কাজের জন্যে বিপুল প্রতিযোগিতা। সেই নিরিখে যে ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে স্নাতকস্তরে পড়াশোনা করলে ভালো চাকরি পাওয়া সম্ভব সেইরকম আসনের সংখ্যা আমাদের দেশে কোনভাবেই দুলক্ষের বেশি নয়। অর্থাৎ বারো ক্লাসে সফল হওয়া প্রতি একশো জনে একজন পড়তে পারেন নামী বিশ্ববিদ্যালয়ে। মনে রাখতে হবে এটা একটিমাত্র বছরের হিসেব। স্নাতকস্তর পাশ করার পর সাধারণভাবে সকলেই চাকরি পাওয়ার চেষ্টায় থাকেন আগামী দশ বছর মত। সহজ অঙ্কে তাই বাইশ-পঁচিশ থেকে বত্রিশ-পঁয়ত্রিশের মধ্যে প্রায় কুড়ি কোটি শিক্ষিত যুবক যুবতী বসে থাকেন কাজ পাওয়ার অপেক্ষায়।
কিন্তু এতো কাজ দেশে নেই। সহজ নিয়মেই মানুষ বেশি হলে কাজ পাওয়া শক্ত। কিন্তু দেশ যারা চালান তাদের ভাবনাচিন্তা করা উচিৎ কিভাবে চাকরির নিত্যনতুন ক্ষেত্র তৈরি করা যায়। মানুষের জীবনের অনেক প্রয়োজনই রুটি-কাপড়া-মোকানের সীমানা ছাড়িয়ে একটা ফুলদানিতে রাখা ছোট্ট গোলাপ পর্যন্ত পৌঁছে যায়। পরিবহণের ক্ষেত্রে অতি প্রয়োজনীয় সাইকেল-রিক্সা—টোটো—ট্রেন-বাসের চেনা তালিকা ছাড়িয়ে মঙ্গলে ছোটে মহাকাশযান। সভ্যতার অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে কাজের যে ধরনের ক্ষেত্র তৈরি হয় তা আগের থেকে বুঝতে পারলে তবেই সৃষ্টি করা যায় নতুন পেশা, নতুন বৃত্তি। সে ভাবনা কখনই সময় নিয়ে ভাবা হয় নি আমাদের দেশে। বৈদ্যুতিন প্রযুক্তির সাফল্যেই আজ ঘরে ঘরে বোকা বাক্স। তাইতো সন্ধেবেলার টেলিভিশনে চলা সিরিয়ালে যারা অভিনয় করে সংসার চালান, তাদের ক্ষেত্রে সেটাও একটা চাকরি। অর্থাৎ কোন ধরনের প্রযুক্তি যে কোন পথে কোথায় কাজের সৃষ্টি করে তার পূর্বাভাস পাওয়া মুশকিল।
কম্পিউটার বা ইন্টারনেট কাজ কেড়ে নিয়েছে হিসেবরক্ষক বা ডাকহরকরার। আবার সেই প্রযুক্তি সৃষ্টি করেছে ফ্লিপকার্টের মত অন্য ধরনের পরিষেবার। আপাত ভাবনায় মনে হতে পারে যে প্রযুক্তি মানুষের হাতের কাজ কেড়েছে বেশি, দিয়েছে কম। সেই কাজের ক্ষেত্র বিস্তৃত করাটাই আজকে সমাজবিজ্ঞানের চ্যালেঞ্জ। জনগণের মতামতে ভোটে জেতাহারা ঠিক করা যায়। তারা ভোট না দিলে তাদের মতামতকে গুরুত্ব দেওয়ার নাম করে তাদের খুশি করা যায়, কিন্তু শিক্ষার উৎকর্ষতা জনমত দিয়ে ঠিক হয় না। বিষয়টির আশু সমাধান নয়, শিক্ষা এবং কাজের ক্ষেত্রের যোগাযোগের ব্যাপারটি যে কতটা জটিল সেটুকু আগে অনুধাবন করুন রাজনৈতিক নেতারা। তবেই শিক্ষার উৎকর্ষতা সংক্রান্ত আলোচনা শুরু করার সম্ভব।
(শুভময় মৈত্র ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইন্সটিটিউটের অধ্যাপক, মতামত ব্যক্তিগত।)