ছোটবেলায় ইতিহাসের প্রথম পাঠ ছিল, যে কোনও সাম্রাজ্যের উত্থান হলে সে সাম্রাজ্য একদিন চরম শিখরে আরোহণ করে, তারপর একদিন তার পতন অনিবার্য। এ হলো 'ল অফ নেচার', যাকে বলে প্রকৃতির সূত্র। পশ্চিমবঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজ্যপাট সেই ঐতিহাসিক বাস্তবতার ব্যতিক্রম হয় কী করে!
এবারে ভোটের সময় পশ্চিমবঙ্গে গিয়েই বুঝতে পেরেছিলাম, বাতাসে এক অন্যরকম উত্তাপ। হাওয়ার চরিত্রটাও অন্যরকম। দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার ডায়মন্ড হারবার এলাকায় আমাকে এক মধ্যবয়স্কা বাঙালি চা-বিক্রেতা রমণী বলেছিলেন, "সিপিএম যখন চলে গেল আর তৃণমূল চলে এল, তখনও বুঝতে পারেন নি যেমন, তেমন আজ এ রাজ্যে বিজেপি ঢুকছে আর তৃণমূল কংগ্রেস বিদায় নিচ্ছে, সেটাও আপনি আজ বুঝতে পারছেন না।"
কী সাংঘাতিক এক রাজনৈতিক রূপান্তরের কথা বলেছিলেন ওই মহিলাটি। সমাজতত্ত্বের কথা। আসলে আমরা অনেকেই শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ঘরে বসে নিজেদের মহাপন্ডিত বলে মনে করি, কিন্তু বহু ক্ষেত্রে মাটির সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ থাকে না। অথচ অর্ধশিক্ষিত এক গ্রামবাসী, বাস স্ট্যান্ডের কন্ডাক্টরদের মাছ-ভাতের প্লেট পরিবেশন করতে করতে আমাকে কী অমোঘ ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন। তৃণমূল কংগ্রেস জেলায় জেলায় দিদিকে প্রধানমন্ত্রী করার স্লোগান দিয়েছিল, কিন্তু সর্বভারতীয় রাজনীতিতে মোদী কিভাবে ফিরে এলেন, তাও তো আজ সকলের সামনে উন্মোচিত।
আরও পড়ুন: মোদী আবার কেন?
প্রশ্ন হচ্ছে, মমতার এমন হলো কেন? সাধারণভাবে বলা হচ্ছে, ওঁর অত্যাধিক মুসলিম বা সংখ্যালঘু তোষণ নীতির ফলেই এহেন পরিস্থিতি। আমার মনে হয়েছে, মুসলিম তোষণের বিরুদ্ধে বিজেপির হিন্দুত্ববাদী মেরুকরণ একটা কারণ হতে পারে, কিন্তু মমতা-বিরোধী রাজনৈতিক মেরুকরণও কিন্তু ছিল খুবই তীব্র। পশ্চিমবঙ্গের আর্থ-সামাজিক প্রকৃত চিত্রটি খুবই দুঃখজনক। বেকারি তীব্র। রাজ্যে কোনও বড় শিল্প নেই। কলকারখানা নেই, মাথাপিছু আয় কম, জাতীয় মূল স্রোত থেকে বাঙালি পিছু হটছে। বাঙালি মানেই ভারতের বামপন্থী কমিউনিস্ট। কেন্দ্র ও দিল্লি বিরোধী।
চিত্তরঞ্জন দাস থেকে শুরু করে সুভাষ বোস গান্ধীর সঙ্গে মতাদর্শগত লড়াই লড়েছেন। বিধান রায়ের সঙ্গেও নেহরুর সম্পর্কটা ঠিক প্রভু-ভৃত্যের, এমনকি গুরু-শিষ্যেরও ছিল না। বিধান রায়কে তো নেহরু রাজ্যপাল করার প্রস্তাবও দিয়েছিলেন। তা সেই দিল্লি বিরোধিতা আজও পশ্চিমবঙ্গবাসী বাঙালির ডিএনএ-তে। কিন্তু এহেন দিল্লি বিরোধিতা, এ হেন 'নেহি চলেগা নেহি চলেগা'র নেতিবাচক রাজনীতিতে এখন পশ্চিমবঙ্গবাসী মানুষও ক্লান্ত। বরং ত্রিপুরার মত ছোট রাজ্যে বিজেপি ক্ষমতায় আসায় কেন্দ্র-রাজ্য সংঘাত ঘুচেছে। ফলে কেন্দ্রের সমস্ত প্রকল্পের আর্থিক সহায়তা যা উত্তরপ্রদেশ পাচ্ছে, তা ত্রিপুরার মত ছোট রাজ্যও পাচ্ছে।
আসলে কংগ্রেস ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর যখন সিপিএম ১৯৭৭ সালে ক্ষমতাসীন হয়, তারপর থেকে রাজ্যের প্রতি বঞ্চনা এক মস্ত বড় প্রচারের হাতিয়ার হয়। কেন্দ্র-বিরোধী এক বিদ্রোহের রাজনীতির রাজনৈতিক উত্তরাধিকার সিপিএমের কাছ থেকে মমতা গ্রহণ করেছেন। মমতার রাজনীতি সম্পর্কে অনেকে বলেন, তৃণমূল কংগ্রেস হলো 'খারাপ সিপিএম'-এর পরিবর্ধন। সিপিএমের মৌলিক নীতি দেখেই মমতার রাজনীতি পরিপক্কতা পেয়েছে। তাই মমতা নিজেও কিন্তু পশ্চিমবাংলায় কোনওদিনই দক্ষিণপন্থী রাজনীতি করেন নি।
আরও পড়ুন: বিরোধী পক্ষের ভুলের কারণেই মোদী অ্যাডভান্টেজ পেয়ে গেছেন
আবার কংগ্রেসের জাতীয় অবক্ষয়ের পর আঞ্চলিক স্বার্থপূরণ বা খন্ড জাতীয়তাবাদের পক্ষে বহু রাজনৈতিক দল গঠিত হয়েছে। কিন্তু সেসব রাজনৈতিক দলগুলি অন্য রাজ্যে গঠিত হলেও পশ্চিমবঙ্গে হয় নি। অর্থাৎ অন্ধ্রপ্রদেশে তেলুগু দেশম বা তামিলনাড়ুতে ডিএমকে বা এআইএডিএমকের মত আঞ্চলিক স্বাতন্ত্র্য রক্ষাকারী দল গঠিত হয়েছে। কিন্তু পশ্চিমবাংলায় 'আমরা বাঙালি' বলে কোনও রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় আসতে পারে নি। কেন পারে নি? পারে নি তার কারণ হলো, সিপিএম যতই নিজেদের আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট পার্টির শাখা বলে দাবি করুক না কেন, আসলে পশ্চিমবঙ্গে একটি বাঙালি পার্টি বলেই পরিচিত। আবার মমতার তৃণমূল কংগ্রেসও হলো বিশেষভাবে পশ্চিমবাংলার দল। আর এবার ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে তো বিজেপির দাপটে তৃণমূল কংগ্রেস বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভাঙ্গার বিরোধিতা করে আরও বাঙালি পার্টি হয়ে উঠল।
আমার আরও মনে হচ্ছে, 'জয় শ্রী রাম' স্লোগান দেওয়ার জন্য বিজেপি কর্মীকে গ্রেপ্তার করা অথবা কার্টুনিস্ট গ্রেপ্তারের মত স্যোশাল মিডিয়ায় সমালোচনা করার জন্য এক মহিলাকে গ্রেপ্তার করা, এধরনের পদক্ষেপ শাসকদলের বিরুদ্ধেই গেছে। কারণ এসব ক্ষেত্রে সমালোচনাকে অবজ্ঞা করাটা হয়তো বেশি ভাল রণকৌশল হত। উত্তরপ্রদেশে যে ভাবে জাতপাতের ভিত্তিতে ভোট হয়, পশ্চিমবঙ্গে সেভাবে কোনোদিন ভোট হয় নি, যদিও মমতা নমঃশুদ্র মতুযা সম্প্রদায়, ওবিসি এবং নানা নিম্নবর্গ সম্প্রদায়কে সঙ্গে নিয়ে একটা নিজস্ব ভোটব্যাঙ্ক তৈরি করেছিলেন। কিন্তু এবার সেটাও অবক্ষয়ের শিকার। মতুয়া প্রার্থী বিজেপির হয়ে তৃণমূলের মতুয়া প্রার্থীকে হারিয়ে দিয়েছেন। সবচেয়ে বড় কথা হলো, এবার মোদী নামক ব্যক্তিত্ব এত বড় একটা ফ্যাক্টর হয়েছিলেন যে অন্য সব জাতপাতের বিষয়গুলি অপ্রাসঙ্গিক হয়ে গিয়েছিল।
তাছাড়াও এবার পশ্চিমবঙ্গে সিপিএম এবং কংগ্রেসের ভোট যেভাবে বিজেপির বাক্সে পড়েছে, তা অভাবনীয়। দিল্লিতে আমার বাড়ির পাচক অসীম মন্ডল থাকেন দক্ষিণ চব্বিশ পরগণায়। ভোট দেওয়ার জন্য ছুটি নিয়ে কলকাতা এসেছিলেন। তা সেই অসীম ফলাফলের পর বেশ নির্ভয়েই বললেন, "গ্রামে আগে সিপিএম করতাম। এখন জেলায় তৃণমূলের অত্যাচারে বিজেপিকে ভোট দিয়েছি। কারণ সিপিএম শেষ। সিপিএমকে ভোট দেওয়া মানে তো ভোটটা নষ্ট করা।" ঠিক একই কথা আমি কলকাতার শহুরে উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্ত বাবু সমাজের মুখ থেকেও শুনেছিলাম। এমনকি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা পর্যন্ত বলছিলেন বিজেপিকেই ভোট দিতে হবে। তৃণমূল তো বিশ্ববিদ্যালয়গুলির বাম সংগঠনকেই ভেঙে দিচ্ছে। এই গণতন্ত্র বিরোধিতার জবাব বামপন্থীরা দিতে পারছেন না। তাই বিজেপি।
আরও পড়ুন: ক্ষমতায় ফিরল বিজেপি, এবার তাহলে কী?
প্রকৃতি শূন্যস্থান পছন্দ করে না। বামপন্থীদের রাজনৈতিক পরিসর দখল করছে বিজেপি। তবে এই পরাজয়ের পর বাংলার ভবিষ্যৎ কোন পথে এগোবে সেটাই দেখার। প্রথমত, তৃণমূলে ভাঙনের সম্ভাবনা। দ্বিতীয়ত, রাষ্ট্রপতি শাসন নয়, কিন্তু চাপ বাড়বে রাজ্য সরকারের ওপর। কেন্দ্র পদে পদে রাজ্যকে বিব্রত-বিধ্বস্ত করতেই থাকবে। তবে মমতাও বুদ্ধি রাখেন। ধাক্কা খাওয়ার পর মমতাও সম্পুর্ণ নতুন রণসাজে প্রস্তুত হবেন। মনে রাখতে হবে, লোকসভা ভোটটা ছিল মোদী থাকবেন কি থাকবেন না তা নিয়ে। কিন্তু এবার বিধানসভা ভোটটা হবে মমতাকে রাজ্যবাসী রাখতে চান কি চান না, তার ওপর।
এবার লোকসভা ভোটের ময়না তদন্ত করতে গিয়ে দেখা যাচ্ছে, মমতার প্রায় ১২ জন মন্ত্রী এবার বিধানসভা কেন্দ্রগুলিতে হেরেছেন। মমতা তাঁদের টিকিট দেবেন কিনা, সেটা প্রশ্ন। মমতার দল থেকে সুব্রত মুখোপাধ্যায়, শুভেন্দু অধিকারীর মত নেতাদের বিজেপি তাদের সঙ্গে পেতে চাইছে অনেকদিন থেকেই। মমতা এই অভ্যন্তরীন সমস্যাগুলি কীভাবে সামলাবেন, সেটাও বিবেচনার বিষয়। তবে ভোটের পরিসংখ্যান পর্যালোচনা করলে এটাও বেশ বোঝা যাচ্ছে, রাজ্যের মুসলমান সমাজ কিন্তু এককাট্টা মমতাকেই ভোট দিয়েছেন। বসিরহাট, ডায়মন্ড হারবার এবং কৃষ্ণনগরের মত আসন জেতার কারণ সাম্প্রদায়িক ভোটাভুটিই।
সব মিলিয়ে কোনও সন্দেহ নেই, ভারতবর্ষের সমগ্র জনসমাজের কাছে এখন পশ্চিমবঙ্গ এক গুরুত্বপূর্ণ রাজ্য হয়ে উঠল।
(লেখক বর্ষীয়ান সাংবাদিক, বর্তমানে ইন্ডিয়া টিভির সঙ্গে যুক্ত। মতামত ব্যক্তিগত)