Advertisment

হাওড়ার জানবাড়ী: তন্ত্রসাধনার গর্ভগৃহ 

এ রাজ্যের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে আছে এমন অনেক স্থাপত্য, যারা নিত্য চোখের সামনে থাকে বটে, কিন্তু তাদের ইতিহাস ও তার সঙ্গে বিজড়িত কাহিনিগুলি অজ্ঞাতই থাকে। এমনই কিছু স্থাপত্যের কথা তুলে আনছেন দুই স্থপতি, সুতপা যতি ও সায়ন্তনী নাগ। 

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
Howrah Jaanbari

হাওড়ার জানবাড়ী (ছবি- লেখক)

হাওড়ার ইতিহাস কলকাতার থেকেও প্রাচীন, শহর কলকাতার বয়স তিনশ বছর ধরলে হাওড়ার পাঁচশ বছর। দুই যমজ শহরের মাঝখান দিয়ে বয়ে চলা গঙ্গার কাছেই গচ্ছিত আছে শহরের ইতিকথা। কলকাতার নামের মতই হাওড়ার নামের উৎস নিয়েও আছে বহু বিতর্ক। উনবিংশ শতাব্দীতে শব্দটা ছিল হাবড়া, তারপর কখন হাবিরা, কখনও হাবড়। অর্থাৎ খানাখন্দময় কর্দমাক্ত জলাভূমি।

Advertisment

ইতিহাসে বেশ কিছু নাম পাওয়া গেছে যা আজ হাওড়ার অন্তর্ভুক্ত যেমন বাগনান, সালকিয়া, উলুবেড়িয়া, ডোমজুর, শিবপুর, বেতড় ইত্যাদি। তখন হাওড়া জেলার কোন সীমারেখা ছিল না, ছিল কিছু পরগণা। প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন বলে হাওড়া পাল যুগে পাল রাজাদের অধীনস্থ ছিল, আবার সেন বংশের লক্ষ্মণসেনের তাম্রশাসনে বেতড় গ্রামের উল্লেখ আছে। পাঠান যুগে এর বেশ কিছু অঞ্চল উড়িষ্যা রাজ্যের দখলে ছিল। তবে হাওড়া নাম চালু হবার আগেই এখানে এসেছিল পর্তুগিজ, আর্মেনিয়ান, ডাচ বণিকেরা। নৌকায় ব্যবসা বাণিজ্য হতো লবণ, চাল ইত্যাদির। তার জন্য ছিল গঙ্গা, দামোদর এবং সরস্বতী নদী।

সরস্বতী নদীর বুকে বন্দর ছিল বেতড়। যে নদী এখানে এখন আর নেই। গঙ্গার তীরে ছিল সালকিয়া হরগঞ্জ ঘাট, রামকৃষ্ণপুর ঘাট। লস্টলির লেখা থেকে জানা যায়, বেতড় ছিল অস্থায়ী বন্দর। মুঘলদের আসার আগে থেকেই এখানে পণ্যবোঝাই জাহাজের মাল খালাস হতো। তখন হাওড়া ও হুগলী ছিল বর্ধমান রাজার অধীনস্থ। ১৭৯৫ সালে তৈরি হয় হুগলী জেলা। আরো পরে ১৮৪৩ সালে হাওড়া জেলার মর্যাদা পায় এবং ১৯৩৮ এ হাওড়া পূর্ণাঙ্গ জেলার মর্যাদা পায়। উনবিংশ শতাব্দীর গোড়ায় হাওড়ায় জাহাজ নির্মাণও হতো। শুধু বাণিজ্য নয়, টোল সংস্কৃতিচর্চা, সংগীতচর্চা, পূজার্চনা ইত্যাদি কাজেও হাওড়ার খ্যাতির কথা জানা যায়। একসময় শিল্পবাণিজ্য সমৃদ্ধ হাওড়া খ্যাত ছিল ভারতের ম্যাঞ্চেস্টার নামে।

আরও পড়ুন, এ এক অন্য লাল বাড়ির গল্প

মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের (১৭১০-১৭৮৩) দরবারে এক শাস্ত্রজ্ঞ ছিলেন। তাঁকে রাজা দুশো বিঘে নিষ্কর জমি দান করেছিলেন হাওড়ার বেলকুলি অঞ্চলে, যার বর্তমান নাম চক্রবেড়িয়া। তাঁর বংশধর অচ্যুতপঞ্চানন ছিলেন জ্ঞানী পুরুষ। বাস করতেন বালীতে। ওখানে নদী থেকে একটি চারহাত বিশিষ্ট পাথরের কালী মূর্তি পান। বালীতেই তার পুজো করা শুরু করেন। তাঁর উত্তরপুরুষ রামকুমার ভট্টাচার্য এবং নবকুমার ভট্টাচার্য এই মূর্তি নিয়ে অধুনা চক্রবেড়িয়া অঞ্চলে চলে আসেন এবং মূর্তি প্রতিষ্ঠা করেন। হাওড়ায় রামকুমার ভট্টাচার্যের নামে রাস্তাও আছে, রামকুমার ভট্টাচার্য লেন।

এই পরিবারকে 'জান' বলা হতো। হাওড়ায় এই পরিবারের বসতবাড়িটি জানবাড়ী বলে পরিচিত। আসলে জান শব্দটি ব্যবহৃত হত শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিতদের বোঝাতে, অর্থাৎ যারা সর্বজ্ঞ, সব বিষয়ে জ্ঞানী। জ্ঞান থেকে অপভ্রংশ হতে হতে জান, যে সব জানে। রামকুমার ভট্টাচার্য, তাঁর ছেলে উমাচরণ, পরবর্তীকালে অন্যান্য বংশধর রাজেন্দ্রপ্রসাদ, ধীরেন্দ্রনাথ, হরপ্রসাদ সহ বর্তমানের রামপ্রসাদ ভট্টাচার্য পর্যন্ত সকলেই 'জান'।

আরও পড়ুন, ময়নাগড়ের ময়নামতী

অতীতে সমাজে এঁরা সবাই জ্ঞানী বলে পরিচিত ছিলেন। সবাইকে প্রয়োজনে সঠিক বুদ্ধি, শলাপরামর্শ দিতেন। ক্রমে এঁরা হয়ে ওঠেন ভবিষ্যৎ বক্তা, পেশা হিসাবে বেছে নেন জোতিষচর্চাকে। বংশের ধারা অক্ষুণ্ণ রেখে আজও জান উপাধি নিয়ে শতাব্দী প্রাচীন জানবাড়ী দাঁড়িয়ে আছে। আজ সে প্রাচীন বংশ বহু বিভক্ত, ফলে পাশাপাশি বহু পুরানো বাড়িই আজ জানবাড়ী হিসাবে খ্যাত। কুড়িয়ে পাওয়া কালীশিলাটি একটি দেবী মূর্তি তৈরী করে তার বুকে স্থাপিত করা হয়েছিল। এই মূর্তিটি বহুবার পরিবর্তিত হয়েছে।  প্রথমে ছিল মাটির, পরে সিমেন্টের। কিন্তু শিলাটি মূর্তির মধ্যেই স্থাপিত আছে।

Howrah Jaanbari এই সেই কালীমূর্তি। ছবি: লেখক

আজ বহু শরিকে বিভক্ত জানবাড়ী। হাওড়া থেকে যে রাস্তা হাওড়া ময়দান, জিটি রোড ছুঁয়ে রামরাজাতলার দিকে চলেছে, যার পুরোনো নাম সার্কুলার রোড, বর্তমানের সেই মহেন্দ্র ভট্টাচার্য রোডের দুধারে রয়েছে বহু পুরাতন অনেকগুলি জানবাড়ী। একদিকে নতুন রাস্তার মোড়, ডুমুরজলা স্টেডিয়াম, বেশকিছু সংস্কারহীন মজে যাওয়া পুকুর। এসবই একসময় জানেদের দুশো বিঘে জমির অন্তর্গত ছিল। তখন পাশ দিয়ে বয়ে যেত সরস্বতী খাল, আজ সেখানে একশ ফুট চওড়া ড্রেনেজ ক্যানাল রোড। বহু জমি হাওড়া ইমপ্রুভমেন্ট ট্রাস্ট (HIT) অধিগ্রহণ করেছে। কিছু জমি মামলা লড়ে বেহাত। অনেক জমি, বাড়ি আবার পড়ে আছে সংস্কারহীন অবস্থায়।

Janbari Howrah জীর্ণ এক জানবাড়ী। ছবি: লেখক

কিন্তু একসময়ে এই বাড়িতে এসেছেন বহু গুণী মানুষ। এসেছেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। এখানে নিজের পাদুকা খুলে রেখে হেঁটে গেছেন রামরাজাতলার রামঠাকুর দর্শন করতে। শোনা যায়, সারদাদেবীর পদধূলিও পড়েছে এই বাড়িতে। তিনিও এসেছিলেন রামঠাকুর দর্শন করতে। এঁদের এক পূর্বপুরুষ ছিলেন রাজেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য। তিনি তৎকালীন ছোটলাটের অনুবাদক ছিলেন। তখন আস্তাবলে ছিল ঘোড়া, সেই ঘোড়ায় চেপেই তিনি চাকরী করতে যেতেন। কিন্তু তিনি বাদে বাকি প্রায় সবাই, এমনকি অন্যান্য বৈবাহিক আত্মীয়রাও, জান উপাধি ব্যবহার করে জোতিষচর্চা, কোষ্ঠীবিচার ইত্যাদিকে পেশা হিসাবে গ্রহণ করেন।

Jaanbari Howrah পেশায় সুবিধা। ছবি: লেখক

বংশের আদি বাড়িটি কালের গর্ভে বিলীন। বর্তমানের বাড়িগুলির মধ্যে একটির প্রবেশদ্বারে রয়েছে একটি সিংহ।

Howrah Jaanbari সিংহ সমন্বিত প্রবেশদ্বার। ছবি: লেখক

থামের উপর দুদিকে দুটি ফুলদানি বৃটিশরাজের প্রতি আনুগত্যের প্রতীক। প্রবেশদ্বারে জোড়া দুটি থাম দুপাশে, থামের মাথায় উল্টানো পদ্মের পাপড়ি। ভেতরে উঠোন, তাকে ঘিরে ইংরেজি ‘এল’  আকৃতির দোতলা বাড়ি। চারদিকে ঘেরা বারান্দা, সামনে আয়োনিক থাম, থামের মাথায় অল্প কারুকার্য। তার মাথায় ছাতের নিচের বিমে ফুল লতাপাতার নকশা, ছাদের পাঁচিলেও কারুকার্য।

Howrah Janbari ছাদের পাঁচিল। ছবি: লেখক

কড়িবরগার ছাদ, খড়খড়ি লাগানো দরজা জানালা।

Howrah Janbari খড়খড়িগুলি পুরনো দিনের স্মৃতির বাহক। ছবি: লেখক

একপাশের একতলার জানালার মাথায় খিলান, খিলানের মাঝে কারুকার্য। রাস্তার উপর বাড়িকে ঘিরে যে পাঁচিল, তার থামে লেখা “JOHN OF HOWRAH”।

Howrah Janbari ওরা জানকে বলত জন। ছবি: লেখক

রাস্তার উল্টোদিকের জানবাড়ীটির খানিক সংস্কারহীন দশা। ইট বেরিয়ে আছে এই বক্ররেখায় তৈরি বাড়ীটির।

Howrah Janbari যে জানবাড়ীটি বাঁকা। ছবি: লেখক

এটিও দোতলা, তবে দেওয়াল জুড়ে বটগাছ প্রমাণ দিচ্ছে বাড়িটির জীর্ণতার। আরও এক জানবাড়ী ঠিক এর পাশে। এটিও ভগ্নদশায় বটঅশ্বত্থের জালে আবদ্ধ। উল্টোদিকে রয়েছে পুকুর, ঘাটে যাবার সিঁড়ি। এর পাশে যে জানবাড়ীটি, তার ভেতরে রয়েছে সেই কালী মূর্তির মন্দির। এ বাড়ির দরজার দুপাশে দুটি সিংহ। এটিও দোতলা, সামনে পিছনে বারান্দা।

Jaanbari Howrah আরেক জানবাড়ী। ছবি: লেখক

ছাদে এক সময়ে ছিল কিছু পুতুল। এই বাড়ির মধ্যে রয়েছে একটি পুকুর, তবে প্রায় মজে গিয়েছে। আগে এই পুকুরে শুদ্ধ হয়ে তবেই কালী মন্দিরে প্রবেশ করা যেত। আর রয়েছে জানবাড়ীর প্রধান আকর্ষণ, বিরল রহস্যময় গা ছমছমে ভয়জাগানো পঞ্চমুণ্ডীর আসন। তান্ত্রিকদের কাছে এই আসন সাধনার বস্তু। খুব কম জায়গায় এই আসন রাখা থাকে। যেমন আছে কালীঘাটে, তারাপীঠে। তন্ত্রমতে পঞ্চমুণ্ডীর মাথার আসনে যে পাঁচটি মাথা থাকে সেগুলি হল সাপ, শিবা অর্থাৎ শেয়াল, বেজি, হনুমান এবং পঞ্চমটি হলো চণ্ডালের মাথা। অমাবস্যার রাতেই এই আসন নির্মাণ করা হয়।

Howrah Janbari পঞ্চমুণ্ডীর আসন। ছবি: লেখক

জানবাড়ীতে এই আসনের সঙ্গে আছে আরো পাঁচটি মানুষের মাথা। এই আসনে বসে চারদিকে চারটি মানুষের মাথা আর সামনে একটি মাথা রেখে সাধনা করা হতো। বর্তমান পুরুষের আগের পুরুষ অবধি এই আসনে বসতেন, সাধনা করতেন, এবং বিভিন্ন মানুষের সমস্যার সমাধান করতেন। আজ আর এই আসন ব্যবহৃত হয় না, শুধু এর সামনে যজ্ঞ হয়। মাথাগুলিও কালের নিয়মে ক্ষয়প্রাপ্ত, নষ্ট হয়ে যেতে বসেছে। এখন একটিমাত্র মানুষের করোটি দৃষ্টিগোচর হয়।

Howrah Janbari একটি করোটিই বাকি। ছবি: লেখক

কিছু বিশেষ তিথিতেই জনসাধারণ এই মন্দির ও পঞ্চমুণ্ডীর আসন দর্শন করতে পারেন। বাকি সময়ে এক অজানা রহস্যময় গা ছমছমে ভয় এই বাড়িগুলোকে ঘিরে থাকে। বয়সের প্রাচীনত্ব, অতীত হাওড়ার সঙ্গে এর যোগ, বহু ঘটনার সাক্ষী জানবাড়ী আজও তার অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে। নিজেদের ভবিষ্যৎ জানতে, জীবনের কোনও জটিল সমস্যার সমাধান খুঁজতে, এখনো প্রতিদিন বহু মানুষ ভিড় করেন এখানে, কিছুটা ভয়ে, কিছুটা আবার সংস্কারাচ্ছন্ন হয়ে। ভবিষ্যৎ যাই বলুক, বর্তমানের জানবাড়ী অতীতের স্মৃতি নিয়ে জেগে আছে, কিঞ্চিৎ রহস্যেমোড়া পরিবেশ আজও ধরে রেখেছে তার আধিভৌতিক মহিমা।

heritage
Advertisment