/indian-express-bangla/media/post_attachments/wp-content/uploads/2019/08/1-8.jpg)
রাসবাড়ির বাইরে
ভাগীরথীর পারে পাঁচশ বছরের পুরানো হাওড়া শহর। ১৬৯০-এ কলকাতার পত্তনের সময় থেকে বাণিজ্য নগরী হিসাবে হাওড়া প্রাধান্য পেতে থাকে। ডঃ অমিত কুমার বন্দোপাধ্যায় তাঁর লেখায় বলেন, 'হাওড়া' শব্দটি প্রথম ছাপার অক্ষরে উল্লেখযোগ্য হয়ে ওঠে ১৮৫৪ সালে হাওড়া থেকে হুগলী পর্যন্ত রেল পরিষেবা চালু হওয়ার পর থেকে। টিকিটে ছাপা হয় তার নামটি, হাওড়া। তার আগে ১৮৪৩-এ হাওড়া জেলা হিসাবে মর্যাদা পায়।
W.W. Hunter এর বিবরণ অনুযায়ী (১৮৭৬) ফোর্ট উইলিয়ামের বিপরীতে ভাগীরথীর অপর পারে অবস্থিত
শিবপুরে জনবসতি বাড়তে থাকে মূলত সরকারি ও সওদাগরী অফিসের কর্মচারীদের অবস্থিতির কারণে। এই
সময়ে জনৈক প্রিয়নাথ ঘোষ শিবপুর অঞ্চলে নিজের বসতবাড়ির কাছাকাছি অনেকখানি জায়গা জুড়ে প্রতিষ্ঠা করলেন রাধাকৃষ্ণের আটচালার মন্দির, সঙ্গে রাসমঞ্চ, নহবতখানা সহ প্রতিষ্ঠা করা পুষ্করিণী ইত্যাদি। মন্দির প্রতিষ্ঠার তারিখ মন্দিরগাত্রের ফলকে লেখা আছে।
আরও পড়ুন, বাংলার শিকড়: শাহী ইমামবাড়া- নির্বাসিত নবাবের শেষ শয্যায়
/indian-express-bangla/media/post_attachments/wp-content/uploads/2019/08/2-1-2.jpg)
শ্রী শ্রী রাধা কৃষ্ণ জীউর মন্দির
নিত্য পূজার জন্য
সন ১৩০৪ সালে স্থাপিত
শ্রী প্রিয় নাথ ঘোষ কৃত
তবে মন্দির সংলগ্ন বসতবাড়ি এর চেয়েও ৩০-৩৫ বছরের পুরানো। আর প্রিয়নাথ ঘোষের আদি বসতবাড়ি
ছিল এর অদূরেই দক্ষিণ দিকে, যে রাস্তার নাম আজ তাঁরই নামে, প্রিয়নাথ ঘোষ লেন। যেখানে ৩০০-৪০০ বছর আগে থেকে তাঁদের বসবাস। প্রিয়নাথবাবু ছিলেন গভর্মেন্টের সিভিল কনট্রাক্টর। মন্দির প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যেই বর্তমানে যে রাস্তাটা জি টি রোডের মল্লিক ফটক থেকে সোজা রামরাজাতলা রেল ষ্টেশনের দিকে চলে যাচ্ছে, সেই মহেন্দ্র ভট্টাচার্য রোডে নিজের বাসগৃহ তৈরী করেন। আগে এই রাস্তার নাম ছিল সার্কুলার রোড। তিনি রাস্তার দক্ষিণ ধারে তৈরী করেন আটচালার মন্দির, প্রতিষ্ঠা করেন রাধাকৃষ্ণের মূর্তি।
/indian-express-bangla/media/post_attachments/wp-content/uploads/2019/08/3-4.jpg)
কৃষ্ণের মূর্তিটি কষ্টিপাথরের আর রাধার, অষ্টধাতুর। তাঁদের অধিষ্ঠানের সিংহাসনটি সম্পূর্ণ রূপোর তৈরি। রাসমন্দিরের দুপাশে তুলসী মঞ্চ, সামনে একতলা সমতল ছাতের দালান। দালানের দুদিকে গোলাকার জোড়া থাম। অপরদিকে চৌকো থাম, সবগুলি পরস্পর অর্ধচন্দ্রাকার খিলান দিয়ে যুক্ত। প্রবেশপথে রয়েছে বিশাল খিলান বা আর্চ। আর্চ ধরে রেখেছে চৌকো দুটি থাম। আর্চের মাথায় 'কিস্টোন' (keystone) নজরে আসে। দোতলা বসতবাড়ির একতলা থেকে একটি সেতুর মত বারান্দা প্রবেশপথের উপর দিয়ে দালানের ছাদে যুক্ত।
/indian-express-bangla/media/post_attachments/wp-content/uploads/2019/08/4-3.jpg)
/indian-express-bangla/media/post_attachments/wp-content/uploads/2019/08/5-2.jpg)
/indian-express-bangla/media/post_attachments/wp-content/uploads/2019/08/7.jpg)
মন্দিরটি বাঙালি রীতির আটচালা, সাদামাটা লাল বর্ডার ও হলুদ রঙের। স্থাপত্যটি ইটের তৈরি, গাঁথুনি চুন সুরকির। একদিকে মন্দির দালান, তারপরই রয়েছে বসতবাড়ি, নিচে থামযুক্ত খোলা বারান্দা, দোতলা
বারান্দার একদিকে রোদ আটকানোর জন্য পুরানো কাঠের চিক নজরে আসে। বসতবাড়ির আশেপাশে ভেঙে পড়া কাঠামো মনে করিয়ে দেয় প্রাচীন সম্পত্তির কথা, যা আজ যত্নের অভাবে বসবাসের অযোগ্য।
আরও পড়ুন, বাংলার শিকড়: তরু তল ছায়ে
তেমনি কিছু কাঠামো চোখে পড়ে মন্দিরের পশ্চিম দিকেও। সেখানেই একটি অস্থায়ী চালার মধ্যে রয়েছে তিনতলা কাঠের রথ। মাথায় নবরত্ন মন্দিরের মত কারুকার্য। কাঠামোর সামনে পাগড়ি পরা কাঠের সারথি। আশেপাশে অনেকখানি অঞ্চল জুড়়ে রয়েছে প্রিয়নাথ ঘোষের সম্পত্তি। তবে এটি আজ আর তাঁর বংশধরদের নয়, তিনি অর্পণনামা করে সমস্ত সম্পত্তি দেবতা রাধাকৃষ্ণ জিউয়ের নামে সমর্পণ করেছেন, অর্থাৎ দেবত্র। রয়েছে প্রতিষ্ঠিত দুটি পুষ্করিণীও।
রাস্তার অপর পারে পুষ্করিণীটির সামনে এতদিন ছিল তিনতলা উচুঁ ইটের পিলার আর আর্চ দিয়ে ঢাকা একটি সুদৃশ্য নহবতখানা। সংস্কারের অযোগ্য হওয়ায় ২০১৮ সালের ২ অক্টোবর দুর্গাপুজোর আগে কোনও অঘটন যাতে না ঘটে, তাই সেটি ভেঙে দিতে বাধ্য হন প্রিয়নাথ ঘোষের বর্তমান উত্তরাধিকারীরা। এমন বিরল নহবত আজ শুধুই বহু হাওড়াবাসীর ক্যামেরায় বন্দি।
/indian-express-bangla/media/post_attachments/wp-content/uploads/2019/08/9-1.jpg)
/indian-express-bangla/media/post_attachments/wp-content/uploads/2019/08/10-1.jpg)
/indian-express-bangla/media/post_attachments/wp-content/uploads/2019/08/11.jpg)
মন্দির আর দালান পার হয়ে চোখে পড়ে অনেকখানি খোলা বাঁধানো চত্বর। এই প্রাঙ্গণে এক মাস ব্যাপী বসে রাসের মেলা, মঞ্চ তৈরি করে হয় পুতুল নাচ। পুতুল নাচের আসরের শিল্পীরা ১৮৯৭ সাল থেকে আজও দক্ষিণ চব্বিশ পরগণা থেকে বংশ পরম্পরায় এখানে আসেন, কৃষ্ণলীলা ইত্যাদি পালা দেখাতে। রাসের মূল অনুষ্ঠান হয় চার দিন ধরে। মন্দির প্রাঙ্গণের একদিকে রয়েছে একটি সুদৃশ্য রাসমঞ্চ, দুটি তলা, নিচের তলা ধরে রেখেছে পুরু ইটের দেওয়াল আর খিলান, দুতলায় আটটি গোলাকার থাম, মাথায় গ্রিক কোরিন্থিয়ান থামের আদলে ক্যাপিটাল।
আরও পড়ুন, বাংলার শিকড়: ইতি উতি হেস্টিংস
আটকোনা রাসম়ঞ্চটির ছাতেও রয়েছে কারুকার্যকরা পাঁচিল। দেবতাকে মন্দির থেকে এনে এই রাসমঞ্চে বসানোর পর এই রাসের মূল অনুষ্ঠান অর্থাৎ পুতুলনাচ শুরু হয়। পুতুলনাচ শেষ হলে দেবতাকে আবার ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। তবে এই কদিন দেবতা মন্দিরে থাকেন না। সিংহাসন সমেত তাঁকে রাখা হয় দালানে। সমগ্র চত্বর সাজানো হয় রামায়ণ বা শ্রীকৃষ্ণের মূর্তি দিয়ে। রাসের মেলা বসে বাইরের রাস্তায়। বংশ পরম্পরায় ব্যাপারীরা আসেন পসরা নিয়ে, গ্রামীণ মেলার স্বাদ এখানে পাওয়া যায়। জিলিপি, বাদামভাজা থেকে শুরু করে মাটির মূর্তি, সংসারের প্রয়োজনীয় তৈজসপত্র, খেলনাবাটি সবই। ২০ থেকে ২৫ বছর আগে পর্যন্ত নহবতখানায় নহবত বসত।
এখানকার আর একটি প্রধান উৎসব হলো রথ। রাসবাড়ি থেকে দড়ি দিয়ে টেনে নিয়ে যাওয়া হয় হাওড়া ময়দান পর্যন্ত। আগে কৃষ্ণকে নিকটবর্তী মাসির বাড়িতে রেখে আসা হতো। কিন্তু নিরাপত্তার কারণে তা এখন আর সম্ভব হয় না। আগে রথের আকারও অনেক বড় ছিল। রথে কৃষ্ণরাধার মূর্তি বসিয়ে প্রথমে প্রিয়নাথ ঘোষ লেনের আদি বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হতো, তারপর রথ এগোত। কিন্তু একশ বছর আগে এমনই কোনও এক রথে কষ্টিপাথরের কৃষ্ণমূর্তির পা ভেঙে যায়। আবার নতুন এক কষ্টিপাথর এনে তাতে পুনরায় মূর্তি খোদাই করা হয়। তারপর থেকে মূর্তি আদি বাড়ি থেকে ঘুরিয়ে এনে মন্দিরেই রেখে দেওয়া হয়। রথের সঙ্গে পরিভ্রমণ করেন শুধু নারায়ণ। উল্টোরথেও একই প্রথা মানা হয়। পুরনো রথও আর নেই। ১৯২৪ সালের পর রথের কাঠামো ছোট হয়ে গেছে।
/indian-express-bangla/media/post_attachments/wp-content/uploads/2019/08/12-1.jpg)
/indian-express-bangla/media/post_attachments/wp-content/uploads/2019/08/13.jpg)
/indian-express-bangla/media/post_attachments/wp-content/uploads/2019/08/14.jpg)
এই দুটি ছাড়াও প্রিয়নাথ ঘোষ বছরের ৩৬৫ দিন শ্রীকৃষ্ণের যথাযথ পুজোর ব্যবস্থা করে গেছেন। তৈরি করে গেছেন সূচীপত্র, যাতে বারোমাস ধরে কোন মাসে কী পুজো হবে, প্রতিদিনের পুজো কীভাবে হবে, সমগ্রই নিখুঁতভাবে নির্দেশ দেওয়া আছে। অর্থের ব্যবস্থাও করে গেছেন, তবে তা আজকের দিনের তুলনায় অপ্রতুল হয়ে গেছে। প্রজাদের দেওয়া জমি, যা থেকে অতীতে টাকা আসত, তা আজ সমস্তই সরকার অধিগ্রহণ করে সেখানে যাঁরা বাস করতেন তাঁদের নামে বিলি করে দিয়েছে। রয়ে গেছে বসতবাড়ি, কিছু আজও ব্যবহার হয়, কিছু পরিত্যক্ত। আর রয়ে গেছে দেবতার মন্দির, পুকুর ইত্যাদি নিয়ে দেবোত্তর সম্পত্তিটুকু।
দেবীর প্রতিদিন চারবার ভোগ হয়। ভোরে মঙ্গলারতি, তখন মাখন ও মিছরি দিয়ে ভোগ। দুপুরে মধ্যাহ্ন আরতিতে অন্নভোগ, সন্ধ্যায় সন্ধ্যারতির সময় লুচি, সুজি বা হালুয়ার ভোগ। রাতে শয়নের আগে শুধু দুধের একটি ভোগ। বছর শুরুতে বৈশাখে বৈশাখী ফলের ভোগ হয়। এটি সারা বৈশাখ মাস জুড়ে হয়। জ্যৈষ্ঠ মাসে মালসা ভোগ হয়। মালসা ভোগে চিঁড়ে, মুড়ি, দই, খই, মুড়কি, ফল, ডাব বা অন্যান্য ফলের রস ইত্যাদি থাকে। এইভাবেই চলে প্রতি মাস, কিছু নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে। এছাড়াও আছে সারা বছর ধরে চলা উৎসব, যেমন আষাঢ় মাসে স্নানযাত্রা, শ্রাবণে রথযাত্রা, তারপর ঝুলন, ঝুলনের পরে জন্মাষ্টমী, এরপর কালীপূজো, পরের দিন অন্নকূট। অন্নকূটের পর শেষ উৎসব চাঁচড়।
/indian-express-bangla/media/post_attachments/wp-content/uploads/2019/08/16.jpg)
/indian-express-bangla/media/post_attachments/wp-content/uploads/2019/08/17.jpg)
/indian-express-bangla/media/post_attachments/wp-content/uploads/2019/08/18.jpg)
এই সব উৎসব সহ ৩৬৫ দিন ভোগ, নিত্যপূজা, সবই নিষ্ঠার সঙ্গে আজও মানা হয়, কারণ ঠাকুর এখন ঘোষ পরিবারেরই একজন। সংসারের একজন হওয়ার কারণে দেবতার সব দায়িত্ব তাঁরা মনে করেন তাঁদেরই। দীর্ঘ দিন ধরে ঐতিহ্য ধারণ করে রাখা এই রাসবাড়ি আনুষ্ঠানিক ভাবে হেরিটেজ ঘোষণা না হলেও হাওড়া মিউনিসিপ্যালিটির ম্যাগাজিনে হেরিটেজ প্রপার্টির ছবিতে এই রাসমন্দিরের ছবি আছে।