একদিকে ইদের উৎসব, অন্য়দিকে ভারতের বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচে অনায়াস জয়- আনন্দে আবেগে ভারতের অধিকাংশ বাসিন্দাই দিশেহারাপ্রায়। তবে মানবাধিকার কর্মীদের কাছে জুন মাসটি তত আনন্দের তো নয়ই, বরং ভয়ংকর স্মৃতির। জুন মাস ভয়াবহ অভিজ্ঞতার স্মৃতিগুলি মনে করিয়ে দেয়- দানা বেঁধে ওঠে ক্ষোভ ও বিষণ্ণতা।
আরও পড়ুন, এলগার পরিষদ কাণ্ডে বাংলার বিদ্বজ্জনদের হিরণ্ময় নীরবতা
জরুরি অবস্থা জারি হয়েছিল জুন মাসেই। আর গত বছরের ৬ জুন ভীমা কোরেগাঁও মামলায় গ্রেফতার করা হয় দেশের পাঁচজন বুদ্ধিজীবী-সমাজকর্মীকে। ২০১৭ সালের ৩১ ডিসেম্বর মহারাষ্ট্রের ভীমা কোরেগাঁওয়ে দলিতদের অনুষ্ঠান ও ২০১৮ সালের ১ জানুয়ারি সে অনুষ্ঠান ঘিরে হিংসাত্মক ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে মহারাষ্ট্রের পুলিশ মানবাধিকার কর্মী, সাংস্কৃতিক কর্মী এবং দলিত সংগঠকদের গ্রেফতার করে। গ্রেফতার হন সিআরপিপি-র প্রচার সচিব রোনা উইলসন, কবীর কলা মঞ্চের সুধীর ধাওয়ান, আইনজীবী ও মানবাধিকার কর্মী সুরেন্দ্র গ্যাডলিং, অধ্যাপিকা তথা নারী আন্দোলনের নেত্রী সোমা সেন এবং দলিত সংগঠক মহেশ রাউত। বিস্ময়ের কথা ওই দিনের হিংসার ঘটনায় মূল দুজন অভিযুক্ত, স্থানীয় হিন্দুত্ববাদী ব্যক্তি - এ কথা পুলিশ নিজেই কিন্তু সুপ্রিম কোর্টে স্বীকারও করেছিল। সুপ্রিম কোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি ও বম্বে হাইকোর্টের এক প্রাক্তন বিচারপতির যৌথ উদ্যোগে এলগার পরিষদের আহ্বানে ডিসেম্বরের অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন মাত্র দুজন - সুধীর ধাওয়াল এবং সোমা সেন। বাকিরা নন। অনুষ্ঠান শেষ হয় সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণভাবেই।
আরও পড়ুন, নির্বাচনী ইস্তেহারে যেসব নাগরিক অধিকারের কথা নেই
আশ্চর্যের সঙ্গে দেখা গেল, মূল অভিযুক্ত রেহাই পেল, আর উক্ত সামাজিক কর্মীদের গ্রেফতার করা হল। পরের দফায় অগাস্টের শেষে গ্রেফতার করা হল অশীতিপর বৃদ্ধ, বিপ্লবী কবি ও সাংস্কৃতিক সংগঠক ভারভারা রাও, আইনজীবী অরুণ ফেরেরা, ভার্নন গনজালভেজ এবং আইনজীবী সুধা ভরদ্বাজকে। গৌতম নওলাখা, আনন্দ টুলটুম্বে ও স্ট্যান স্বামীকে গ্রেফতারের চেষ্টার পর হাইকোর্টের হস্তক্ষেপে তাঁরা এখনও পর্যন্ত মুক্ত।
সরকার এখানেই থেমে থাকেনি। পরাধীন ভারতের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে ধ্বংস করার জন্য় রচিত হয়েছিল কুখ্যাত রাওলাট বিল/আইন- যাকে গান্ধীবাদীরা বলেছিলেন বিষধর সাপ। এরই উত্তরসূরী হল বেআইনি কার্যকলাপ নিরোধক আইন বা সংক্ষেপে ইউএপিএ। এই আইনেরই নানা ধারায় অভিযুক্ত করা হল এঁদের। সংবাদমাধ্যমের একাংশ জোরালো প্রচার চালাল - এরা সব শহুরে নকশাল, সন্ত্রাসবাদী- ইত্যাদি। দেশ জুড়ে এর প্রতিবাদও হল। নাগরিক সমাজের একাংশ সুপ্রিম কোর্টে মামলা দায়ের করলেন। অভিযোগ উঠল, নথি জাল করা হয়েছে। এতেও যখন অভিযুক্তদের জব্দ করা যাচ্ছে না, তখন মারাত্মক অভিযোগ আনল পুলিশ- এরা নাকি প্রধানমন্ত্রীকে হত্যার ষড়যন্ত্রে অভিযুক্ত। কিন্তু সুপ্রিম কোর্টে এর সপক্ষে কোনও প্রমাণ পেশ করতে পারেনি সরকার পক্ষ- এমনকি এত বড় অভিযোগ নিয়ে কোনও এফআইআর পর্যন্ত হয়নি।
আরও পড়ুন, সাধ্বীর বেলায় আঁটিশুটি!
এ লেখার মুহূর্ত পর্যন্ত এসব মামলায় কেউ জামিন পাননি। মাসের পর মাস শুনানির তারিখ পড়ছে, কোনওদিন শুনানি হচ্ছে, কোনওদিন হচ্ছে না। শুনানির সব দিনে সব অভিযুক্তকে আদালতে হাজির করা হচ্ছে, ভারতের নানা প্রান্ত থেকে মানবাধিকার কর্মীরা, গণ আন্দোলনের কর্মীরা কোর্ট চত্বরে এসেও দেখা পাচ্ছেন না বন্দি সাথীদের।
একই সঙ্গে আদালতের আদেশকে পুলিশ সচেতনভাবে অমান্য় করে চলছে। গত ১৮ মে আদালত আদেশ দিয়েছিল অভিযুক্তদেরকে যাবতীয় দলিলের অনুলিপি ৪ জুনের মধ্যে দিতে বাধ্য থাকবে পুলিশ। ৪ জুন পর্যন্ত সেসব দলিল জমা পড়েনি। উল্টে নতুন দায়রা বিচারক পুলিশকে এ ব্যাপারে আরও সময় মঞ্জুর করেছেন।
শুধু তাই নয়, বিশেষ আদালতের পূর্ববর্তী দায়রা বিচারক কে ডি ভাদানে কয়েক মাস ধরে জামিন সংক্রান্ত উভয় পক্ষের যুক্তি শুনেছিলেন- প্রত্যাশিত ছিল মে মাসের শেষ সপ্তাহে তিনি এ সম্পর্কিত রায় প্রদান করবেন। হঠাৎই জানা গেল, ২০ মে থেকে ৪ জুন পর্যন্ত ছুটিতে গিয়েছেন তিনি। এই ছুটির মধ্যেই তিনি বদলি হয়ে গেলেন। নতুন বিচারক ৪ জুন এই মামলার বিচারের দায়িত্ব পেয়েছেন। তার মানে, আবার নতুন করে জামিন সংক্রান্ত যাবতীয় যুক্তির শুনানি চলবে, এবং বলা বাহুল্য তা চলবে দীর্ঘদিন ধরে।
একে তো জামিন এতদিনেও পাওয়া যায়নি। উপমহাদেশে ন্য়ায়বিচার পাওয়াটা দুর্লভ। তকমা মেরে দিয়ে বিরোধীদের কণ্ঠস্বরকে, মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে সদা সরব অগ্রগণ্য কর্মীদের মিথ্যা মামলায় কারাগারে বন্দি করে পচিয়ে মারতে পারলে ভয় ও সন্ত্রাসের শাসন কায়েম করা যাবে এমনটাই মনে করা হয়। সংবিধান ও আইনের শাসনের অন্তর্জলি যাত্রা আজ ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। তবু প্রতিবাদ একেবারে হচ্ছে না, তা নয়। উদাহরণ- মে-জুনে দিল্লিতে সভার কর্মসূচি।
সুলেখক, আইনজীবী অরুণ ফেরেরা জেলে বসেই স্কেচ পেন্সিলে এঁকেছেন এক অসহায় বন্দির ছবি। গারদে শীর্ণকায় বন্দি বসে আছেন- দেখছেন বাইরের মুক্ত প্রকৃতিকে। মুক্তির বাসনা, আর বাস্তবত নিরপরাধ হয়েও বন্দিদশা, ইদের দিনে এ ছবি দেখলে মন আরও ভারাক্রান্ত হয়ে পড়ে।
(সুজাত ভদ্র মানবাধিকার আন্দোলনের সংগঠক। মতামত ব্য়ক্তিগত।)