Advertisment

বাংলার শিকড়: শাহী ইমামবাড়া- নির্বাসিত নবাবের শেষ শয্যায়

"শাহী ইমামবাড়ার ঠিক পাশেই শাহী মসজিদ। এখন সেখানে পাকাপাকিভাবে বাস করেন নবাবের বংশধর কিছু মানুষ।" বাংলার বিভিন্ন ঐতিহ্যের কথা লিখছেন ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলায় নিয়মিত লিখছেন দুই স্থপতি। এবার নবাব ওয়াজেদ আলী শাহের শেষ শয্যার কথা।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
Imambara, Bengal Heritage

শাহী ইমামবাড়া

১৮৫৬ সালের ৬ মে। শহর কলকাতার পশ্চিমে, গঙ্গার তীরে বিচালিঘাটে এসে ভিড়ল জেনারেল ম্যাকলয়েড নামে এক স্টিমার। মেটিয়াবুরুজে পা রাখলেন অওধের পঞ্চম তথা শেষ নবাব ওয়াজেদ আলী শাহ।

Advertisment

Imambara, Bengal Heritage নবাব ওয়াজেদ আলী শাহ – ইমামবাড়ার তৈলচিত্র

সিপাহি বিদ্রোহ চলাকালীন ইংরেজদের নজরবন্দি হয়ে ছিলেন ফোর্ট উইলিয়ামে। বিদ্রোহ মিটে যাবার আট মাস পর মুক্তি পেয়ে নির্বাসিত নবাব মেটিয়াবুরুজে গড়ে তুললেন ‘ছোটা লক্ষ্ণৌ’। ব্রিটিশ সরকার প্রদত্ত পেনশন মাসে এক লাখ টাকার সাহায্যে তিনি মেটিয়াবুরুজে একের পর এক প্রাসাদ বানাতে শুরু করেন – মুরাসা মঞ্জিল, নুর মঞ্জিল, অদালত মঞ্জিল। তাঁর পৃষ্ঠপোষকতায় ক্রমে শিল্প সংস্কৃতির পীঠস্থান হয়ে ওঠে এ অঞ্চল। ব্রিটিশ সরকার শুধুমাত্র  এই তথ্যই পরিবেশন করে গেছে যে তাঁর ৩৭৫ জন স্ত্রী ছিল। নবাবের সংস্কৃতিমনষ্কতার কথা বিশেষ উল্লেখ করেনি। অথচ সে সময় গুরুত্বপূর্ণ কবি, গায়ক, বাদকদের কাছে মেটিয়াবুরুজ হয়ে উঠেছিল এক অবধারিত গন্তব্য। লক্ষ্ণৌ ঠুমরির টানে পাথুরিয়াঘাটা থেকে রাজা সৌরীন্দ্রমোহন ঠাকুর পাড়ি দিতেন মেটিয়াবুরুজ। ধ্রুপদী ধারার কণ্ঠ ও যন্ত্রসঙ্গীতের এই কেন্দ্রে হামেশাই আসতেন যদুভট্ট, অঘোরনাথ চক্রবর্তী। নবাব স্বয়ং কত্থক শিখেছিলেন মহারাজ ঠাকুর প্রসাদজীর কাছ থেকে। শোনা যায় ১৮৬৭ তে হোলির সময় মেটিয়াবুরুজের দরবারে তিনি নিজে নর্তকীর বেশে নৃত্য পরিবেশন করেন, ঠুমরিও শোনান। তাঁকে আবার আধুনিক উর্দু নাটকের পথিকৃৎও বলা যায়। নবাব হওয়ার আগে ১৮৪৩ সালে তিনি স্বরচিত নাটক ‘রাধা কানহাইয়া কি কিসসা’ মঞ্চস্থ করেছিলেন। ১৮৫৯ থেকে ১৮৭৫-এর মধ্যে অন্তত তেইশটি জলসার আয়োজন করেছিলেন, তাতে নিয়মিত ঐ নাটকের পরিণত, পরিমার্জিত অভিনয় হতো। কবি, সাহিত্যিক, প্রবন্ধকার হিসেবেও নবাবের খ্যাতি কিছু কম নয়, কত্থক নিয়ে লিখেছিলেন সচিত্র বই ‘মুসাম্মি কি বানি’। নিজে সেতার শিখেছিলেন ওস্তাদ কুতুব আলী খানের কাছে। মেটিয়াবুরুজে রবাব ও সুরশৃঙ্গার যন্ত্রদুটির প্রবর্তকও তিনিই। সানাই, এসরাজ, সুরবাহার, সরোদের সাথেও জড়িয়ে তাঁর নাম। কুস্তি, ঘুড়ি ওড়ানো, মুরগী লড়াই, পায়রা পোষা – এ সবে নবাবের আসক্তি ছিল প্রচুর। কলকাতার প্রথম চিড়িয়াখানাও তাঁর সৃষ্টি। বাঘ, হরিণ, উটপাখি, ময়ুর তো ছিলই, ‘ওপেন এয়ার’ এই চিড়িয়াখানায় ছিল সাপে ভর্তি চৌবাচ্চাও। আর খাদ্যরসিক নবাবের হাত ধরে মেটিয়াবুরুজে প্রবেশ করে ‘দমপক্ত’ খাবার। নিয়মিত পাচকদের নানা নতুন স্বাদের রান্নার পরীক্ষানিরীক্ষা করতে উৎসাহ দিতেন তিনি। পোলাও, কোর্মা, বিরিয়ানি, শিরমল, শাহী টুকরা থেকে শুরু করে জর্দা – কলকাতাবাসীর জিভে এসব সুখাদ্যের অনুপ্রবেশ ঘটে ওয়াজেদ আলী শাহের হাত ধরেই। তাঁর খিদমতগার, নাপিত, ধোপা, ওস্তাগর প্রমুখের সাথে সাথে লক্ষ্ণৌ থেকে মেটিয়াবুরুজ এসে পৌঁছোয় জারদৌসি শিল্প, মুশায়েরা ও মুজরো।

আরও পড়ুন, বাংলার শিকড়: ইতি উতি হেস্টিংস

১৮৮৭ সালে নবাব যখন মারা যান, সমাজের নানা স্রোতের, নানা জাতের প্রায় দশ হাজার শোকাহত মানুষ ভিড় করেন তাঁর শেষ যাত্রায়। নবাবের মৃত্যুর পর ব্রিটিশ সরকার বহু প্রাসাদ, অট্টালিকা ধ্বংস করে ফেলে। কলকাতা পোর্ট ট্রাস্ট তৈরির সময় নবাবীর শেষ চিহ্ন প্রায় মুছে যায়। তবু অওধের তহজীব বা আদবকায়দা এখনো টিকে আছে মেটিয়াবুরুজে। তারই নিদর্শন মেলে শাহী ইমামবাড়ায় পদার্পণ করলে সাদর উদাত্ত আমন্ত্রণে। ইমামবাড়া হল এমন এক উপাসনালয় যেখানে ধর্ময়ালোচনা, পাঠ, এমনকি ছেলেদের শিক্ষাদানের কাজও চলে। সার্কুলার গার্ডেনরিচ রোডে (অতীতের আয়রন গেট রোড) অবস্থিত শাহী ইমামবাড়ায় (অন্য নাম সিবতাইনাবাদ ইমামবাড়া) শুয়ে আছেন হতভাগ্য নবাব, তাঁর দুই পুত্র ও অন্যন্য বংশধরেরা। স্বয়ং ওয়াজেদ আলী শাহ নির্মিত এই ইমামবাড়া লক্ষ্ণৌ ইমামবাড়ার ক্ষুদ্র সংস্করণ, অথচ সত্যিই শাহী অর্থাৎ রাজকীয়। অওধের নবাবেরা কিন্তু সরাসরি মুঘল বংশজাত নন, তাঁদের উৎস ইরানের নাইশাপুর। তাঁদের স্থাপত্যকলা মানেই প্লাস্টারের ওপর ফুলেল কারুকার্য। ‘বিদরি’ অর্থাৎ পেতল ও রূপোর কাজ, পোশাকশিল্প ও অভিনব ক্যালিগ্রাফির কারণে তাঁদের জগতজোড়া খ্যাতি। শাহী ইমামবাড়ার নীল সাদা দরজা মসজিদের মত, প্রথমে একটি পয়েন্টেড আর্চ, তারপর চারটি স্তরে খিলান। মূল দরজার ওপর রয়েছে একটি হাতের ডিজাইন, যাকে শিয়া মতে বলে ‘হামসা হ্যান্ড’ যা ইসলামের পাঁচ পবিত্র ব্যক্তিত্বের প্রতীক। ভেতরে ঢুকলে প্রশস্ত উঠোন, লম্বা বারান্দা, সেখানে ওয়াজেদ আলী শাহ ও বেগম হজরত মহলের প্রপৌত্র নায়েজ কাদেজ ওয়াসিফ আলি মিরজা’র কবর।

Imambara, Bengal Heritage প্রশস্ত উঠোন, লম্বা বারান্দা

তারপর সুসজ্জিত আর্চ ও কড়িবরগার সমতল ছাদের বিশাল হলঘর। বাঁদিকে নবাবের সমাধি। ছাদের উচ্চতা দোতলার সমান। ১৮৬৪ সালে তৈরি এই ইমামবড়ার হলে প্রবেশ করলে দেখা যায় যত্নে সংরক্ষিত নবাবের ঢাল, তরোয়াল, সিংহাসন।

Imambara, Bengal Heritage নবাবের ব্যবহৃত নানা সামগ্রী

আছে রূপোয় নির্মিত মহরমের তাজিয়া। ক্রিস্টাল পাথরখচিত রাজসিক ঝাড়বাতি, রঙিন কাঁচের লণ্ঠন, মার্বেল পাথরের মেঝে, স্টেইনড গ্লাসের জানলা।

Imambara, Bengal Heritage রঙিন কাঁচের লণ্ঠন

দরজাগুলি গোল থামের ওপর গোল খিলানযুক্ত, তার ওপর আর এক স্তর ছোট ছোট আর্চ দিয়ে তৈরি বড় খিলান।  ঘোরানো সিঁড়ি ছাদে উঠে গেছে এক কোণ দিয়ে, গম্বুজের পাঁচিলে উলটানো পদ্মপাপড়ির নকশা। ইমামবড়ার স্থাপত্যধারায়  নবাবেরর ধর্মনিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গীর নজির মেলে, যেমন তাম্রনির্মিত রাজকীয় প্রতীকটি সূর্যমুখী ফুলের আকৃতির এবং তাতে মৎসপ্রিয় নবাবের পছন্দ মাছের ছবি খোদাই করা।

Imambara, Bengal Heritage সূর্যমুখী ফুলের আকৃতির রাজকীয় প্রতীক

প্রবেশদ্বারে, ছাদের পাঁচিলে ও অন্যান্য নানা জায়গায় মোটিফ রূপে মাঝেমাঝেই মাছের উপস্থিতি। রয়েছে নবাবের স্বহস্তে লিখিত কোরান। দেওয়ালে নবাবের তৈলচিত্র, তাঁর রচিত কবিতার পংক্তি ও শিয়া ধর্মমতের বাণী।

Imambara, Bengal Heritage নবাবের স্বহস্তে লিখিত কোরান

ডানদিকে একটি আলাদা ঘরে রয়েছে নবাবের পুত্র বিরজিশ কাদির ও প্রপৌত্র আনজুম কাদেরের সমাধি। বারান্দায় কিছু ঐতিহাসিক ছবি, বংশতালিকা, নবাব ও বেগমকে নিয়ে প্রকাশিত ডাকটিকিট ইত্যাদি সযত্নে সংরক্ষিত। উঠনে রয়েছে একটি ধাতব পেটা ঘণ্টা।

Imambara, Bengal Heritage বংশধরদের সমাধি

শাহী ইমামবাড়ার ঠিক পাশেই শাহী মসজিদ। এখন সেখানে পাকাপাকিভাবে বাস করেন নবাবের বংশধর কিছু মানুষ। উনিশ শতকের মধ্যভাগে নির্মিত এ মসজিদের স্থাপত্যধারায় ইঙ্গ-ভারতীয় প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। স্বয়ং নবাব এটি বানিয়েছিলেন নিজের ব্যক্তিগত ব্যবহারের জন্য। সম্ভবত মেটিয়াবুরুজে নবাবের বানানো প্রথম বাড়ি এটি। সাধারণ মসজিদের স্থাপত্য বৈশিষ্ট এতে অনেকটাই অনুপস্থিত, যেমন এতে কোনো গম্বুজ (ডোম) বা মিনারেট নেই। এর অন্যতম বৈশিষ্ট অন্দরের দেওয়ালে অপূর্ব মিনাকারির কাজ। ফুল, পাতা ও নকশায় হিন্দু প্রভাব সুস্পষ্ট। তাজমহলের দেওয়ালে এমনই মিনাকারির কাজ নজরে আসে, যদিও সূক্ষতা ও উপকরণের গুণগত বিচারে তা অনেক বেশি ভালো। চোখ টানে কারুকার্য করা বাতিদান, বারান্দায় কাঠের ঝালর, সরু থাম। আর মসজিদটি ইটনির্মিত হলেও এর পশ্চিম দেওয়ালে রয়েছে মার্বেল পাথরে তৈরি মিহরাব। মিহরাব হল মসজিদের অর্ধগোলাকার অংশ যেখানে বসে ইমাম নমাজের প্রার্থনা করেন এবং তাঁর গঠনশৈলী এমনই হয় যে বিনা মাইকে সেই স্বর ভিড়ের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। শাহী মসজিদে ঈদ উপলক্ষ্যে বেশ বড় জমায়েত হয়, তবে মূলত শিয়া সম্প্রদায়ের মানুষেরই। মসজিদটিতে নিয়মিত রঙ হলেও সংলগ্ন বাগানে অযত্নের ছাপ, একটি অকেজো ফোয়ারা রয়েছে যেখানে বর্তমানে নমাজীরা অজু করেন।

Imambara, Bengal Heritage কারুকার্য করা বাতিদান

বড় বেদনায় একদিন মসনদ হারা নবাব রচনা করেছিলেন গান ‘যব ছোড় চলে লক্ষ্ণৌ নগরী’। আশা করেছিলেন, একদিন ফিরতে পারবেন তাঁর ‘নইহার’ অর্থাৎ বাপের বাড়ি লক্ষ্ণৌতে। কিন্তু তা আর কোনোদিন সম্ভব হবে না বুঝে নিজের চারপাশে গড়ে তুলেছিলেন অওধের আবহাওয়া।( ব্রিটিশ তথ্যসূত্র নবাবকে ঠিক ভাবে বিবৃত করেনি কোনোদিন, উলটে প্রচার করতে চেয়েছে তিনি ছিলেন খানিকটা নারীসুলভ, মদ্যপায়ী, নারীআসঙ্গলিপ্সু। অথচ জীবনে এক ফোঁটা মদ ছোঁন নি নবাব। ‘সতরঞ্জ কি খিলাড়ি’ ছবিতে সত্যজিত রায় মনে রেখেছিলেন তাঁকে। মৃত্যুকালে ২৫৭ বিঘা জমি এবং ১৯ টি বাড়ি ছিল নবাবের। কিছু ধর্মীয় স্থাপত্য ছাড়া অন্য সব প্রাসাদই আজ নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে শহরের বুক থেকে। মেটিয়াবুরুজের ব্যস্ত রাস্তা এখন কাপড় ও অন্যান্য ব্যবসায় সদাই সরগরম। সকলে অবশ্য ভোলেননি, তাই মেটিয়াবুরুজের পানের দোকানে আজও ঝোলে তাঁদের প্রিয় নবাব ওয়াজেদ আলী শাহের আংরাখা পরা ছবি!

heritage
Advertisment