ক্ষমতায় থাকা সরকার এবং শাসকদল - এই দুইয়ের মধ্যে পার্থক্য খুঁজে বের করা খুব কঠিন। মাঝখানে উল্লম্ব সরলরেখা টেনে তার বাঁ আর ডান দিকে বিষয়ভিত্তিক গরমিল সংক্রান্ত তথ্য পেশ করে পরীক্ষার নম্বর জুটে যেতে পারে। কিন্তু বাস্তবে সে সীমারেখা ঝাপসা। প্রতিটি মানুষের ব্যক্তি ইচ্ছার সমষ্টিগত প্রকাশ ঘটে জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে। সেইরকমই একটি সমষ্টিগত অভিব্যক্তি সরকার, আর একটি দল। ব্যক্তি এক, কিন্তু তা সমষ্টির অংশবিশেষ। গুরুত্বপূর্ণ এবং অনন্যসাধারণ ব্যক্তিগত চরিত্র অধিক উজ্জ্বলতায় ফোটে গিজগিজে ম্যাদামারা সমষ্টির আধারে। সে জন্যেই তো নেতা কিংবা নেত্রী অল্প কজন, বাকি 'জনগণ'।
এবার সবটাই যদি ব্যক্তিগত ইচ্ছা অনিচ্ছার ওপর চলতে থাকে, তাহলে ক্ষমতাশালীর সুবিধে প্রচুর, কিন্তু 'জনগণের হাতে হারিকেন'। সেই হারিকেন যাতে একেবারে নিভে না যায়, সেই জন্যেই তো বিভিন্ন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা, গাদাগাদা পাতায় ছাপানো সংবিধান, বৈঠকখানা উপচে পড়া আইনের বই। এসব সত্ত্বেও সাধারণভাবে বিশ্বের বেশির ভাগ দেশের মতই আমাদেরও জোর যার মুলুক তার।
আরও পড়ুন: ইভিএম কারচুপি শুধু কঠিনই নয়, বৈজ্ঞানিকভাবে অসম্ভবও
তবে এদেশে নিয়ম করে নির্বাচন হয় এবং সর্বাধিকারীরা (দেশ, রাজ্য বা পঞ্চায়েতের নেতা অর্থে) খুব জ্বালাতন করলে তাঁদের সংসদীয় গণতন্ত্রের নিয়ম মেনে ভোটের মাধ্যমে বিদায় দেওয়াটাই কাম্য। তার ফলে যে জায়গা ফাঁকা হয় সেই আসনে কেউ না কেউ বসেই পড়েন। এভাবেই বাদ্যযন্ত্রের চলমানতা এবং যদ্দৃচ্ছ বিরতির জটিল দোলগতিতে স্থির আসনে অস্থির মানবমানবীর অধিষ্ঠান। এটাই ওয়েস্টমিনিস্টার মডেল, যা আমাদের সংসদীয় গণতন্ত্রের পথিকৃৎ।
এবার সরকার আর দলকে আলাদা করে বুঝতে চাইবেন কে? যার বোঝার মতো বুদ্ধি আছে, এবং বুঝে প্রতিবাদ করার মতো শক্তি আছে। আমাদের দেশে দরিদ্র অসহায় মানুষের সংখ্যা বিপুল, এবং তাঁদের এই সমস্ত বোধ, প্রতিবাদ ইত্যাদি বিমূর্ত চেতনার চচ্চড়ি রাঁধার সুযোগ কম। অর্থাৎ ভারতবর্ষে বিপুল সংখ্যক মানুষকে সবসময়েই অন্যের দয়ায় বেঁচে থাকতে হয়। এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ একশো দিনের কাজ, যে সামান্য টাকার কিছুটা অংশ অবশ্যই নিজের কাছে আসে। বাকি অংশটা পৌঁছে দিতে হয় ক্ষমতাশালী মানুষের হাতে।
এই পিছিয়ে থাকা জনতার জন্যেই ভোটপূর্বক প্রতিশ্রুতি শোনা যায় সার্বজনীন ন্যূনতম আয়ের (ইউনিভার্সাল বেসিক ইনকাম, বা ইউবিআই - ব্যাঙ্ক বলে ভুল করবেন না কিন্তু)। অর্থাৎ কাজ না পেলেও অল্প কিছু টাকা পাওয়া যাবে সরকারের কাছ থেকে। এ কিন্তু 'কাজ করব এবং খেতে পাব', শ্রমের বিনিময়ে সমানুপাতিক মূল্য ধরা হবে কৃষক-শ্রমিকদের জন্যে, এমনটা নয়। শ্রমের মূল্যটা কমই থাকবে, শ্রম নিংড়ে যে সম্পদ সৃষ্টি হবে, তার সত্তর শতাংশ ভোগ করবেন এক শতাংশ মানুষ। দয়া করে সরকার কিছু টাকা বিলোতে পারে। কিন্তু সেটা পেতে গেলে সবসময় নির্ভর করে থাকতে হবে ক্ষমতায় থাকা রাজনৈতিক দলের দয়া দাক্ষিণ্যের ওপর। বুদ্ধিজীবীদের সংজ্ঞায় একেই বলে সংস্কারমুখী আধা-সমাজতান্ত্রিক জনগণমনতন্ত্র।
আরও পড়ুন: রাজ্যে তৃণমূলের কোনও বিকল্প নেই: সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়
আর এইখানেই দল আর সরকার একাকার হয়ে যায়। খেটে রোজগার নয়, সামন্ততান্ত্রিক সরকারের ঝোলা থেকে চুঁইয়ে পড়া ঝোলাগুড় পেতে গেলে শাসক দলের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখা জরুরি। কারণ দলই সেখানে সরকার। তাই সরকারের দলদাস হওয়াটা আসলে ঠিক কথা নয়, এতে অকারণে দলকে ঢ্যাঙা আর সরকারকে খাটো করে দেখানো হয়। মূল দর্শন হলো, দল বা সরকার দুজনেই এক মাপের, সবাই ক্ষমতাশালী নেতানেত্রীর দাস।
প্রসঙ্গত, সংবিধানের নিয়মে ভোটে জেতার হিসেবটাও মজার। আমাদের দেশে সাধারণত প্রদত্ত ভোট ৮০ শতাংশের আশেপাশে, যেখানে জয়ী দল পায় আন্দাজ ৪৫ শতাংশ। অর্থাৎ মোট ভোটারের ৩৬ শতাংশের সমর্থন পেয়ে খুব সহজেই ক্ষমতায় আসা যায়। সহজ শতকরার অঙ্কে, এ দেশের প্রায় সব সরকারই সংখ্যালঘু সরকার। বিষয়টিকে আসনে হিসেব করে সংখ্যার গুরুত্ব দেখানো হয় - অর্থাৎ জোর করে জারিত হয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা। ফলে যে দল ক্ষমতায় আসে সে জানে যে নির্বাচকমন্ডলীর বেশিরভাগটাই তার সমর্থক নয়।
সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচিত ক্ষমতাশালী নেতানেত্রী সরকারের দোহাই দিয়ে সবাইকে নিজের প্রজা বলে মেনে নেবে, এটা কিছুটা কষ্টকল্পিত। তাই ক্ষমতায় এসেও সরকারের চেয়ে দলের টান বেশি থাকে। তার ওপর বহুদলীয় গণতন্ত্রে একদলীয় স্থায়ী শাসন হলে তো কথাই নেই, যা কিনা ভারতের অন্যান্য রাজ্যের থেকে পশ্চিমবঙ্গে অনেক বেশি প্রতীয়মান। এখানে একবার ক্ষমতায় এলে বাঙালির স্থিতিজাড্যে অল্প সময়ে আর নড়াচড়ার প্রয়োজন নেই। তাই সময় যত গড়ায়, তত দলের চিনি সরকারের জলে মেশে ভালো। ঘোঁটার সময় পাওয়া যায় অনেক বেশি।
ধরুন, সিপিএম যখন ক্ষমতায়, তখন পাড়ায় কংগ্রেসের সঙ্গে মারামারি হলে লোকাল কমিটির কথা থানার বড়বাবু বেশি শুনতেন, না গুরুত্ব দিতেন কংগ্রেস নেতার দাবিকে? লোকাল কমিটির অফিসে বসে পঞ্চায়েতের কর্মপদ্ধতি নিয়ে যে গভীর আলোচনা হয়, তাহলে সেটা কি সরকারি কাজ না দলীয় নীতি নির্ধারণ? ঠিক এই জায়গাতেই দল আর সরকারের জমির মাঝখানে আল খুঁজে পাওয়া শক্ত। অর্থাৎ মাঝের সারির নেতৃত্বের ক্ষেত্রেও দল আর সরকারের গুলিয়ে যাওয়ার বিষয়টা বাস্তব।
আরও পড়ুন: মৌসম বদল, হাত ছেড়ে জোড়াফুলে গণিখানের ভাগনি
তবে সবশেষে আসে সর্বোচ্চ স্তরে দেশ বা রাজ্যের প্রশাসনের সঙ্গে দলের মিলেমিশে যাওয়ার কথা। দীর্ঘ বাম আমলে জ্যোতি বসু দলের শীর্ষনেতা না রাজ্য সরকারের মুখ্যমন্ত্রী এই নিয়ে বিতর্ক হয়েছে অনেক। তবে সংবাদমাধ্যমে যা শুনতে পাওয়া গেছে তা হলো, তিনি নাকি দল এবং সরকার, এই দুটি বিষয়কে আলাদা করেই ভাবতেন। মানুষ কতটা ভাবছেন, কতটা দেখাচ্ছেন, আর তার মধ্যে কৌণিক পরিমাপ ত্রিকোণমিতির সূত্রে কোনদিকে ট্যারা চোখে তাকিয়ে আছেন, এই সমস্ত হিসেব পাটিগণিতের নিয়মে হয় না।
তবে জ্যোতি বসু রাইটার্সে দাঁড়িয়ে আছেন, পাশে প্রমোদ দাশগুপ্ত, এবং কংগ্রেসের কোন বড় নেতা সেখানে এসে সর্বসমক্ষে সিপিএমে যোগ দিলেন, এমন উদাহরণ বিশেষ নেই। বাম রাজত্বে সরকারের ওপর সিপিএমের দখল যে পুরোমাত্রায় ছিল তার পরোক্ষ প্রমাণ আছে অনেক। কিন্তু তাতে আড়াল ছিল কিছুটা।
বাম-বিবর্তিত তৃণমূলের সময় তা বিশেষভাবে প্রত্যক্ষ। এই রাজত্বে সরাসরি সম্প্রচারিত মুখ্যমন্ত্রীর প্রশাসনিক বৈঠকে অনেকটাই নিজের দল নিয়ে আলোচনা। তাতে মুখ্যমন্ত্রী বিভিন্ন সময়ে স্বদলের নেতাকর্মীদের ধমক দেন এবং তাঁদের দুর্নীতির কথাও সরাসরি ব্যক্ত করেন। অস্বীকার করার উপায় নেই যে বাংলার রাজনীতিতে এ এক নতুন ধারা। একাধারে রাজনীতি এবং প্রশাসনের উচ্চপদস্থ কর্মচারীদের সর্বময় নেত্রী চমকালে সমাজের পিছিয়ে থাকা মানুষদের কাছে তাঁর জনপ্রিয়তার পারদ যে উর্দ্ধমুখী হয়, তার প্রমাণ কিন্তু যথেষ্ট। সঙ্গে দল আর সরকার মিলেমিশে যাওয়াটা তো উপরি পাওনা।
একই ধারায় সম্প্রতি তৃণমূলে যোগ দেওয়া সদ্য প্রাক্তন কংগ্রেস সাংসদ মৌসম বেনজির নূরের স্বাগত-পূর্তি সাংবাদিক সম্মেলন হয়ে গেল রাজ্যের সর্বোচ্চ প্রশাসনিক ভবন নবান্নে। উপস্থিত ছিলেন মুখ্যমন্ত্রী এবং তৃণমূলের এক বর্তমান সাংসদ। সংবাদমাধ্যমে প্রশ্ন উঠবেই, সংসদীয় গণতন্ত্রে এই রীতি কতটা শ্রেয়। উত্তর এক্ষুনি পাওয়া অসম্ভব। তবে আমরা অপেক্ষা করে দেখতে পারি, যে তৃণমূল নবান্ন থেকে কিংবা বিজেপি রাষ্ট্রপতি ভবনের খুব কাছাকাছি সাউথ বা নর্থ ব্লক থেকে আসন্ন লোকসভায় তাদের প্রার্থী তালিকা প্রকাশ করার পরিকল্পনা নেয় কী না। সেক্ষেত্রে দল আর গণতন্ত্র যোগ করে মধ্যপদলোপী কর্মধারায় সংবিধানে "সংসদীয় দলতন্ত্র" শব্দবন্ধটা ঢুকিয়ে দেওয়া যাবে।
(লেখক ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইন্সটিটিউটের অধ্যাপক, মতামত ব্যক্তিগত)