Advertisment

রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে কেন প্রশ্নের মুখে ভারত?

২০১৭ সালে মায়ানমারে যখন সমস্যা সৃষ্টি হয়, তখন বৌদ্ধ ও খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের মানুষকে মিজোরাম রাজ্যে আশ্রয় দেওয়া হয়, অথচ সেই একই সময়ে মুসলিম রোহিঙ্গাদের শরণার্থী হিসেবে গ্রহণ করা হয় নিI

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
NULL

গতবছর বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শরণার্থীরা। ফাইল ছবি

আন্তর্জাতিক পটভূমিকায় ভারতের কাছে আজ অন্যতম বড় সমস্যা হলো রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ। বিষয়টি মায়ানমারে ঘটে যাওয়া 'রোহিঙ্গা সংকট'-এর সঙ্গে যুক্ত I 'রোহিঙ্গা সংকট' নামে পরিচিত এই সমস্যাটি কয়েক দশকেরও বেশি সময় ধরে মায়ানমারে চলতে থাকা একটি দুঃখজনক ঘটনাপ্রবাহ, যা একই সঙ্গে মায়ানমারের রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা-মুসলিম সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের হাজার হাজার মানুষের চরম দুর্দশার কথা তুলে ধরেI মায়ানমার সরকার এই রোহিঙ্গা সম্প্রদায়কে নাগরিক হিসাবে স্বীকৃতি দেয় না, এবং তাদের 'অবৈধ অধিবাসী' হিসেবে বিবেচনা করে। রাখাইন রাজ্যে সাম্প্রতিক সময়ে ঘটে যাওয়া সামরিক বাহিনীর রক্তাক্ত অভিযানের জেরে কয়েক হাজার রোহিঙ্গা নিহত বা আহত হয়েছেন, এবং প্রায় সাত লক্ষ রোহিঙ্গা আজ গৃহহীন, দেশছাড়াI

Advertisment

দলে দলে মায়ানমার ছেড়ে পালাতে থাকা রোহিঙ্গা শরণার্থীরা যে গুরুতর মানবিক সংকটের সৃষ্টি করেছেন, তা ভারতের আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তাকেও প্রভাবিত করছেI প্রাথমিকভাবে, 'রোহিঙ্গা সংকট' মায়ানমারের অভ্যন্তরীণ সংঘাতের কারণI এই দ্বন্দ্বের জন্য মূলত দায়ী দেশের বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায়, যাঁরা একটি বহুবিধ, বহু-ভাষিক ও বহুবিধ সমাজের গ্রহণযোগ্যতা অস্বীকার করেন। রোহিঙ্গা মুসলিম সমস্যাও এই বৃহত্তর মানসিকতার ফলন। রাখাইন 'জাতিগত গোষ্ঠী', যাঁরা মূলত বৌদ্ধ, এবং রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে প্রভাবশালী 'বামার-বৌদ্ধ' সংখ্যাগরিষ্ঠ গোষ্ঠীর মধ্যে সম্পর্কের কারণে ধীরে ধীরে রাখাইন অঞ্চলের রোহিঙ্গা মুসলিম জাতি কোণঠাসা হয়ে পড়েছে I

rohingya, Refugee, myanmar, Myanmar Rohingya, Burma, West Bengal, Baruipur, kurali, রোহিঙ্গা, রিফিউজি, মায়ানমার, কলকাতা, পশ্চিমবঙ্গ, বারুইপুর, কুড়ালি কলকাতার কাছে বারুইপুরে বর্তমানে পরিত্যক্ত রোহিঙ্গা শিবিরেই এই শিশুর জন্ম। ফাইল ছবি: শশী ঘোষ

আরও পড়ুন: আড়াই দিন পরেও কাটেনি জট, ত্রিপুরায় ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে দাঁড়িয়ে রোহিঙ্গারা

একই সঙ্গে মায়ানমারের সামরিক বাহিনীও বিশেষ করে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের স্বার্থ সুনিশ্চিত করতেই বদ্ধপরিকরI এর ফলে রোহিঙ্গা মুসলমান সম্প্রদায় বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়ছে। ফলস্বরূপ অন্যান্য জাতিগত সংখ্যালঘুদের মতোই মায়ানমারে রোহিঙ্গাদেরও 'অবৈধ অভিবাসী' হিসেবে গণ্য করা হয়। খুব অনায়াসেই অতি-জাতীয়তাবাদী বৌদ্ধ শক্তির আক্রমণের সহজ লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে মুসলিম রোহিঙ্গা সম্প্রদায়I

রোহিঙ্গা সংকটে ভারতের অবস্থানের দুটি দিক রয়েছে। প্রথম, রোহিঙ্গা শরণার্থীদের উপর ভারতের অবস্থানের প্রভাব এবং দ্বিতীয়, সংকট সমাধানের ক্ষেত্রে ভারতের ভূমিকা। আন্তর্জাতিক স্তরে বর্তমান বিতর্কটি প্রথম বিষয়টির উপর বেশী গুরুত্ব আরোপ করেছে I যার ফলে রোহিঙ্গাদের প্রতি ভারতের দৃষ্টিভঙ্গির বিষয়ে একাধিক প্রশ্ন উঠছে। দুটি মূল চিন্তাধারা রোহিঙ্গা সমস্যার ক্ষেত্রে ভারতের অবস্থান ব্যাখ্যা করে। যদিও বেশিরভাগ বিষয়ে দুটি চিন্তাধারা ভিন্ন ভিন্ন, উভয়ের মধ্যে এ নিয়ে দ্বিমত নেই যে ভারতে কোনও নির্দিষ্ট উদ্বাস্তু নীতি ও কাঠামোর অভাব রোহিঙ্গা সংকটকে জটিল করে তুলেছে।

প্রথম চিন্তাধারাটি অনুযায়ী, বর্তমানে ভারতের রোহিঙ্গা প্রসঙ্গে ভাবনার পদ্ধতিতে ধারাবাহিকতার উপাদান রয়েছে, কারণ এটি ভারতের ঐতিহ্যগত ধারণার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণI উদাহরণ স্বরূপ বলা যেতে পারে, ১৯৭১ সালে যুদ্ধের সময় ভারত বাংলাদেশের (পূর্ব পাকিস্তান) উদ্বাস্তুদের ভারতে থাকার অনুমতি দিলেও, যুদ্ধের পর শরণার্থীদের বাংলাদেশে ফিরে যাওয়ার প্রত্যাবর্তন নীতি নিশ্চিত করেছিল। যার ফলে এটা বোঝা যায় যে ভারত উদ্বাস্তুদের স্থায়ী বসবাস সমর্থন করে না এবং একই সঙ্গে একটি জাতীয় শরণার্থী নীতির ক্ষেত্রে দিল্লীর দৃষ্টিভঙ্গি কিঞ্চিৎ জটিল। তবে বিজেপি নেতৃত্বাধীন সরকার রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুদের ক্ষেত্রে ভারতের পুরানো নীতিগুলি অনুসরণ করে নিI রোহিঙ্গাদের ক্ষেত্রে সরকার দরজা বন্ধ করে দেয়, অথচ ভারত সবসময় অন্যান্য ক্ষেত্রে উদ্বাস্তুদের স্বাগত জানায়। তাছাড়া অতীতে কোনও শরণার্থীকে ভারত 'সন্ত্রাসী হুমকি' বলে মনে করে নি, অথচ রোহিঙ্গাদের ক্ষেত্রে নিরাপত্তা সংক্রান্ত উদ্বেগ ছিল সরকারের মূল যুক্তি।

দ্বিতীয় মতটি রোহিঙ্গা প্রসঙ্গে ভারতের বর্তমান অবস্থানকে অতীতের থেকে সরে আসা বলে মনে করেI এই মতের যুক্তি হলো, নিরাপত্তার খাতিরে রোহিঙ্গা সংকটের ক্ষেত্রে ভারতের অবস্থান একটি ক্ষণস্থায়ী দৃষ্টিকোণI এটি ভারতের জন্য আরও নিরাপত্তা সংক্রান্ত সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে, যার ফলে ভারতের মাটিতে মৌলবাদী চিন্তাধারার সৃষ্টি হতে পারে, যা ভারতের ক্ষেত্রে ক্ষতিকারকI এই মত অনুসারে, সরকারের রোহিঙ্গা নীতি মায়ানমার সহ বিভিন্ন দেশে হাজার হাজার ভারতীয়দের বিপদের মুখে ফেলবে I কেননা পৃথিবীর সব দেশেই ভারতীয়রা সংখ্যালঘু। অধিকন্তু, এই দৃষ্টিভঙ্গিটি ভারতের গণতান্ত্রিক সমাজের দীর্ঘ ঐতিহ্যকে হ্রাস করেছে, যেখানে অতীতে উদ্বাস্তুদের জন্য ভারত সর্বদা তার দরজা খোলা রেখেছেI

একটি ধারণা তৈরি হয়েছে, যে রোহিঙ্গাদের প্রতি বিজেপি নেতৃত্বাধীন সরকারের অবস্থানের মূলে রয়েছে প্রস্তাবিত ২০১৬ সালের নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল, যেখানে 'অমুসলিম উদ্বাস্তুদের' নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। এক্ষেত্রে বলা যেতে পারে, ২০১৭ সালে মায়ানমারে যখন সমস্যা সৃষ্টি হয়, তখন বৌদ্ধ ও খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের মানুষকে ভারতের উত্তর পূর্ব অঞ্চলের মিজোরাম রাজ্যে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় দেওয়া হয়, অথচ সেই একই সময়ে মুসলিম রোহিঙ্গাদের শরণার্থী হিসেবে গ্রহণ করা হয় নিI ভারতের এই দ্বৈত নীতি ভারতকে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্তরে প্রশ্নের মুখে ফেলে দিয়েছেI

একটি ক্রমবর্ধমান শক্তি হিসেবে, এবং উদ্বাস্তু সমস্যা সমাধানের স্বার্থে, ভারতের অনেক বেশী দায়িত্বশীল হওয়া প্রয়োজন। ভারত যে উদ্বাস্তু সহ বিশ্বব্যাপী আরও অনেক সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করতে পারে, একথা বলাই বাহুল্যI রোহিঙ্গা প্রসঙ্গে ভারতের অবস্থানের ক্ষেত্রে যে অনেক প্রশ্ন উঠে আসছে, তার সমাধান সূত্র ভারতকেই খুঁজে বের করতে হবেI দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় যদি ভারতের প্রাধান্য বজায় রাখতে হয়, তাহলে ভারতের আরো সহানুভূতির সঙ্গে আঞ্চলিক সমস্যার সঙ্গে যুক্ত হওয়া প্রয়োজনI গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে ভারত অন্যান্য দেশেও যাতে গণতন্ত্র রক্ষা হয়, সেদিকে নজর দেবে, সেটাই স্বাভাবিকI

(লেখক যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক, মতামত ব্যক্তিগত) 

Rohingya
Advertisment