গত বছরের মে মাসে ছত্তর সিং যখন দেখেন, ঘন কালো মেঘের মতো এক ঝাঁক পঙ্গপাল উড়ে আসছে তাঁর ক্ষেতের দিকে, বড় রকমের ধাক্কা খান তিনি। কারণ এই দৃশ্য তিনি শেষবার দেখেছেন প্রায় তিন দশক আগে। রাজস্থানের জয়সলমীর জেলার রামগড় গ্রামে বাস ৬০ বছর বয়সী এই কৃষকের। তাঁর কথায়, "ত্রিশ বছর আগে আমাদের গ্রামে একটা পঙ্গপাল বিভাগ ছিল, খুব দ্রুত এদের মোকাবিলা করত।"
কিন্তু গত ২৫-৩০ বছর ধরে পঙ্গপাল সমস্যা দেখা না দেওয়ায় নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে এই বিভাগ, বলছেন সিং। সুতরাং গত বছর যখন ফের হানা দিল পঙ্গপালের ঝাঁক, রামগড়বাসীরা কী করবেন বুঝতে না পেরে এন্তার থালা-বাসন বাজিয়ে, গাড়ির টায়ার পুড়িয়ে তাদের তাড়ানোর চেষ্টা করেন। তৎসত্ত্বেও চলতি বছরের জানুয়ারি মাসের মধ্যে সিংয়ের ক্ষেতের অর্ধেক ফসল ধ্বংস করে দিয়ে বিদায় নেয় পঙ্গপালের দল, কিন্তু এপ্রিলেই পুনরাবির্ভাব ঘটে তাদের।
রামগড় থেকে প্রায় ৮০ কিমি দূরে নয়া দিল্লিতে বসে ৭৬ বছরের প্রভা দুবে বুঝতেই পারছেন না, দেশের রাজধানীতে পঙ্গপাল হানার ভবিষ্যদ্বাণী হচ্ছে কেন। শহরাঞ্চলে পঙ্গপাল হানার অভিজ্ঞতা তাঁর নেই এমন নয়, তবে তা ১৯৫০ বা '৬০-এর দশকে, উত্তরপ্রদেশের বালিয়াতে কাটানো তাঁর শৈশবে। তাঁর মনে আছে, "ওরা এলেই মেঘের মতো অন্ধকার নেমে আসত চারদিকে, আর আমরা দরজা-জানলা বন্ধ করে বাড়িতে বসে থাকতাম।" তখন প্রায়ই আসত পঙ্গপালের দল, বলছেন তিনি, এবং ছোটবেলায় শুনতেন নানারকমের গুজব এবং মিথ, যেমন, পঙ্গপাল নাকি ছোট ছোট বাচ্চা ধরে খায়!
আরও পড়ুন: পঙ্গপালের দঙ্গল শহরাঞ্চলে কেন, এরা ফসলের কতটা ক্ষতি করতে পারে?
উত্তরপ্রদেশ, রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ, এবং মহারাষ্ট্রের অংশবিশেষ ছারখার করে দিয়ে দিল্লির দিকে এগোচ্ছে এই বিধ্বংসী পোকার দল, এমন হুঁশিয়ারি মঙ্গলবার জারি করে কেন্দ্রীয় পরিবেশ মন্ত্রক। করোনা মহামারী এবং অর্থনৈতিক মন্দার সঙ্গে প্রতিনিয়ত যুঝতে থাকা দেশের বহু নাগরিকের শিরদাঁড়া দিয়ে নামে ঠাণ্ডা ভয়ের স্রোত। বিগত প্রজন্মের যাঁরা, তাঁদের মনে পড়ে যায় সেইসব সময়ের কথা, যখন দেশে হামেশাই ঘটত পঙ্গপালের আক্রমণ, যাতে আতঙ্ক ছড়াত গ্রাম থেকে গ্রামে, কারণ পঙ্গপাল ছিল ধ্বংসের আগমনবার্তা, সংবাদমাধ্যমে ফলাও করে লেখা হতো তাদের মহামারী-সুলভ উপস্থিতির কথা।
প্রাচীনকালেও অশনি সঙ্কেত
অনন্তকাল ধরে যে ব্যাপক ধ্বংসলীলা চালিয়েছে পঙ্গপালের ঝাঁক, তার প্রমাণ মেলে প্রায় প্রত্যেকটি গুরুত্বপূর্ণ ধর্মগ্রন্থে। মহাভারতে কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে অর্জুনের উদ্দেশে আবৃত্তি করা একটি কবিতায় কর্ণ উল্লেখ করেন এদের কথা। বাইবেলের 'বুক অফ এক্সোডাস'-এ পঙ্গপালদের বর্ণনা করা হয়েছে অষ্টম মহামারী হিসেবে, যা খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চদশ শতাব্দীতে ঘটেছিল বলে বিশ্বাস করা হয়। কোরানেও বলা হয়েছে পঙ্গপাল মহামারীর কথা, যার জেরে দেখা যায় ব্যাপক হারে মৃত্যু।
এ তো গেল সুদূর অতীতের কথা। সাম্প্রতিক ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, রাষ্ট্রসংঘের ফুড অ্যান্ড অ্যাগ্রিকালচারাল অর্গানাইজেশন (FAO)-এর একটি রিপোর্ট অনুযায়ী, উনিশের শতকে প্রতি কয়েক বছর অন্তর পঙ্গপালের হামলার খবর পাওয়া যেত ভারতে। বিশেষ করে ১৯২৬ থেকে ১৯৩১ পর্যন্ত পাঁচ বছরের সময়কাল ধরে ফসলের যা ক্ষতি হয়, তৎকালীন যুগে তার পরিমাণ ছিল ২ কোটি টাকা। পশুখাদ্যেরও বিপুল ক্ষতি হয়, যার ফলে ব্যাপক হারে মৃত্যু ঘটে গবাদি পশুর।
শেষবার বড় রকমের পঙ্গপালের প্রাদুর্ভাব ঘটে ১৯৯৩ সালে, যে বছর ১৭২ বার হানা দেয় এরা। এরপর কিছু স্থানীয় হানা নথিভুক্ত হয় ১৯৯৭, ২০০৫, ২০১০, এবং ২০১৫ সালেও, তবে খুব ছোট পরিসরে।
সমন্বিত সরকারি নিয়ন্ত্রণ
যেহেতু ভারতে ফিরে ফিরে এসেছে পঙ্গপাল সমস্যা, ব্রিটিশ আমলে এদের মোকাবিলা করতে নিজ নিজ এলাকায় প্রশাসনিক বিভাগ গঠন করে সমস্ত করদ রাজ্য এবং প্রদেশ। FAO-এর রিপোর্ট বলছে, "১৯২৬-৩২ সালের পঙ্গপাল মহামারীর ফলস্বরূপ তৎকালীন ব্রিটিশদের অধীনস্থ ভারত সরকার সিদ্ধান্ত নেয়, ১৯৩১ থেকে মরুভূমির পঙ্গপাল সম্পর্কে বিস্তারিত গবেষণা শুরু করার।" এর ফলেই ১৯৩৯ সালে গঠিত হয় 'লোকাস্ট (অর্থাৎ পঙ্গপাল) ওয়ার্নিং অর্গানাইজেশন বা LWO, যার সদর দফতর ছিল নয়া দিল্লিতে, এবং একটি উপ-দফতর করাচিতে। এই সংগঠনের মূল উদ্দেশ্য ছিল মরুভূমির পঙ্গপালের ওপর নজরদারি রেখে তাদের রাস্তায় সম্ভাব্য রাজ্যগুলিকে হুঁশিয়ার করা।
এই বিষয়ে উল্লেখযোগ্য গবেষণা করেন হেম সিং প্রুথি - কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট করার পাশাপাশি যিনি আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন কীটপতঙ্গ বিশেষজ্ঞও ছিলেন। চল্লিশের দশকে তাঁকে ভার দেওয়া হয় LWO পরিচালনার। 'A History of Indian Agriculture' গ্রন্থে ইতিহাসবিদ এম এস রানধাওয়া লেখেন, "১৯৪২ সালে পঙ্গপাল নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যে একটি বিশদ পরিকল্পনা প্রস্তুত করেন তিনি (হেম সিং)। এবং ১৯৫০ সালে তিনি লেখেন একটি বিস্তারিত প্রতিবেদন, 'The Desert Locust Cycle of 1940-46 in India'।" পঙ্গপালদের গতিবিধি, প্রজননের সময়, পরিব্রাজনের ধরন, এবং আবহাওয়া ভিত্তিক তথ্য, এই সবকিছু নিয়েই বিস্তারিত লেখেন প্রুথি।
তবে সমস্যার পাকাপাকি সমাধান না হওয়ায় ১৯৬৩ সালে রাষ্ট্রসংঘের FAO পরামর্শ দেয়, মরুভূমির পঙ্গপাল নিয়ন্ত্রণে আঞ্চলিক সংগঠন হোক আফগানিস্তান, ভারত, ইরান, এবং পাকিস্তানকে নিয়ে। তারপর থেকে এই অঞ্চলে পঙ্গপাল নিয়ন্ত্রণে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করে চলেছে চারটি দেশ। বিবিসি-র একটি রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০১৭ থেকে ২০১৯-এর মধ্যে পঙ্গপাল নিয়ন্ত্রণের স্বার্থে ১০টি সীমান্ত বৈঠক করেছে ভারত এবং পাকিস্তান।
চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে পঙ্গপাল মোকাবিলায় রাষ্ট্রীয় জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে পাকিস্তান। ভারত এখনও কড়া নজর রাখছে পরিস্থিতির ওপর, যা হাতের বাইরে চলে গেলে করোনা যুদ্ধের পাশাপাশি কৃষিক্ষেত্রেও বিপুল ক্ষতির বিরুদ্ধে লড়তে হবে দেশকে।
কৃষি বিশেষজ্ঞ দেভিন্দর শর্মা বলছেন, "আসল সমস্যাটা হলো যে এবারের মরসুমে সময়ের আগেই ঘটছে আক্রমণ। সাধারণত হর্ন অফ আফ্রিকা (আফ্রিকার অন্তরীপ) থেকে এরা আসে জুলাই থেকে অক্টোবর মাসের মধ্যে। গত কয়েক বছর ধরে তাদের পরিব্রাজনের পথে বেড়েছে ঘূর্ণিঝড়ের তীব্রতা। দ্বিতীয়ত, ভারত, পাকিস্তান এবং ইরানে অনিয়মিত বৃষ্টির ফলে প্রজননের আদর্শ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।" কেন নব্বুইয়ের দশক থেকে এখন পর্যন্ত তেমনভাবে দেখা যায় নি এদের, তার ব্যাখ্যা হিসেবে শর্মা বলেন যে পরিব্রাজনের পক্ষে আবহাওয়া অনুকূল ছিল না।
বর্তমান প্রাদুর্ভাবের মোকাবিলা করতে কী পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে, জিজ্ঞেস করায় LWO সংগঠনের কেএল গুজরাল বলছেন, "পঙ্গপাল নিয়ন্ত্রণে কোনও প্রতিরোধক ব্যবস্থা নেই। এই মুহূর্তে আমরা ড্রোন ব্যবহার করে কীটনাশক ছড়াচ্ছি যাতে তাদের গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ করা যায়।"
বুধবার নিজেদের প্রত্যাশিত গতিপথ পরিত্যাগ করে দিল্লিকে রেহাই দিয়ে মধ্যপ্রদেশের দিকে রওনা দেয় পঙ্গপালের ঝাঁক, দিল্লিতে বসে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেন দুবে। ওদিকে রামগড়ে ফসল কীভাবে রক্ষা করা যায়, সেই চিন্তায় ঘুম উড়ে গিয়েছে সিংয়ের। "গোটা গ্রামে একটিও গাড়ির টায়ার পাবেন না। ফসল বাঁচানোর চেষ্টায় সবকটা টায়ার পুড়িয়ে ফেলেছি আমরা।"
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন