Advertisment

ক্যানাডার মতো দেশে কেন প্রাণ দিতে হলো ছোট্ট অর্ককে?

কেন অর্কর মাকে বারবার মাথা চাপড়াতে হচ্ছে, "আমি বুলিইং সম্বন্ধে একটু রিসার্চ করলাম না! তাহলে ছেলেকে এ দেশে আনতামই না।"

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
toronto student suicides

টরোন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ে মোমবাতি জ্বেলে প্রতিবাদ।

ক্যানাডার মতন 'উন্নত' দেশে ‘বুলিইং’ (bullying, অর্থাৎ নিয়মিত মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন) এর শিকার, এবং তার মায়ের মতে শেষমেশ বলি, হয়েছে ১২ বছরের অর্ক মুখোপাধ্যায়। তার তরুণী মা দূর্বা, একা, তাকে কোলে নিয়ে কলকাতা থেকে এসেছিলেন ক্যানাডায়, অনেকের মতন চোখে স্বপ্ন নিয়ে, যে তাঁর ছেলে দশের একজন হবে। ক্যানাডা সে স্বপ্ন দেখায় যে, এখানে নাকি বাচ্চাদের স্বর্গ! আমরা নাকি এখানে আসি আমাদের বাচ্চাদের ক্যানাডিয়ান সরকারকে সঁপে দিতে। সরকার তাদের শিশুকাল ভাতা থেকে শুরু করে, বিনামূল্যে হাই-স্কুল অবধি শিক্ষা, এবং উচ্চশিক্ষায় অনেক ছাড়, ভাতা এবং সরকারি অনুদান দিয়ে তাদের ভবিষ্যত উজ্জ্বল করে তোলে।

Advertisment

তাই কি?

তাহলে ছোট্ট অর্ককে প্রাণ দিতে হলো কেন? কেন এতো কড়া কড়া আইন থাকতে হজসন মিডল স্কুলের ওই ছাত্রকে বুলিইং-এর জেরে এক বহুতল ভবনের ছাদ থেকে পড়ে মরতে হলো? কীভাবে মারা গেল সে? পুলিশ বলছে আত্মহত্যা, কিন্তু এই ঘোষণা ঘিরে উঠেছে প্রশ্ন। কেন বিল্ডিঙের একদম গা ঘেঁষে পড়ল অর্ক, যা ঝাঁপ দিয়ে পড়লে সম্ভব নয়? কেন তার মা লক্ষ্য করলেন যে তার দাঁতগুলো আর নাক ভাঙা, যদিও তাকে চিত হয়ে পড়ে থাকা অবস্থায় পাওয়া যায়? কেন অর্কর মাকে বারবার মাথা চাপড়াতে হচ্ছে, "আমি বুলিইং সম্বন্ধে একটু রিসার্চ করলাম না! তাহলে ছেলেকে এ দেশে আনতামই না।"

এসব প্রশ্নের জবাব এখনও পুলিশের কাছে নেই। ‘বুলিইং’ এবং ‘রেসিজম’ (বর্ণবৈষম্য) ক্যানাডায় বেআইনি। তাও কেন দিনে দিনে বাড়ছে স্কুলে বর্ণবৈষম্য এবং অন্যান্য কারণে বুলিইং?

toronto student suicides আত্মরক্ষার জন্য টায়েকন্ডো ক্লাসে ভর্তি হয় অর্ক, বলেন তার মা

এ সপ্তাহেই অ্যান্ড্রু রজারসন নামে এক ব্যবসায়ী বুলিইং-এর জন্য ৫.৫ মিলিয়ন ডলারের মামলা এনেছেন স্থানীয় মেয়েদের স্কুল হ্যাভারগ্যাল কলেজের বিরুদ্ধে। অভিযোগ, বুলিইং-এর শিকার তাঁর সাত বছরের মেয়ে সে সম্পর্কে নালিশ করাতে, উল্টে শিশুটিকেই স্কুল থেকে বহিষ্কার করা হয়। বাবা প্রভাবশালী ব্যবসায়ী, ফলত 'বার্ষিক ৩৫,০০০ ক্যানাডিয়ান ডলার' ফি নেওয়া স্কুলের বিরুদ্ধে মামলা করার ক্ষমতা রাখেন। কিন্তু আমাদের সাদামাটা বাঙালি মা দূর্বা, যিনি সবেমাত্র ক্যানাডায় পা রেখেছেন, তাঁর দুর্বল ছোট্টো ছেলেকে হারিয়ে আর কী করার ক্ষমতা রাখেন? তবে কি ক্যানাডাতেও যার হাতে ক্ষমতা, তার দখলেই আইন?

অর্কর মা একা ক্যানাডায় আসেন ছেলেকে নিয়ে গত বছর। ১১ বছরের অর্ক ভর্তি হয় স্থানীয় হজসন মিডল স্কুলে। বেশ কয়েকদিন ধরে তার এক গাঁট্টাগোট্টা সহপাঠী তথা প্রতিবেশী ডিরিল (নাম পরিবর্তিত), ছোট্ট, রোগা অর্ককে তাক করেছিল। নানা কারণে বেধড়ক মারত, এবং একদিন নাকি পেটে এমন লাথি মারে, যে বাড়ির সামনে রাস্তায় দাঁড়িয়ে পেট চেপে ধরে কাঁদছিল অর্ক। ভয় পেয়ে অর্কর মা তাকে টায়েকন্ডো ক্লাসে ভর্তি করেন। যে কারণে অর্ক তার মুখটা রক্ষা করতে পেরেছিল কিছুদিন পর, হাত দিয়ে ডিরিলের লাথি ‘ব্লক’ করে, যদিও ঠোঁট ফুলে যায়।

এরপর শুরু হয় কিছু ভিডিও গেমস্‌ নিয়ে তাদের মধ্যে বচসা, এবং ডিরিলের বাবা স্কুলে নালিশ করেন যে অর্ক ডিরিলের একটা ভিডিও গেম কন্সোল চুরি করেছে। অর্ক জানায়, তাকে অন্য এক সহপাঠী সেই কন্সোলটি দিয়েছে। তবু চুরির শাস্তিস্বরূপ স্কুলের ভাইস-প্রিন্সিপ্যাল অর্ককে ‘আইসোলেটেড লাঞ্চ’ করতে বলেন। এবং নানাভাবে অর্ককে জেরা করেন চুরির অপরাধ স্বীকার করানোর জন্য, অভিযোগ করেছেন দূর্বা।

এই তপ্ত পরিবেশে গত ২১ জুন অর্ক স্কুল থেকে ফিরে ফ্রিজ থেকে ক্যান্ড্‌ স্যুপ বের করে গরম করে। একটা বাটিতে নিজের জন্য, একটা বাটিতে মায়ের জন্য স্যুপ রাখে খাবার টেবিলে। মা বাড়ি ফিরলে সন্ধ্যে সাতটা নাগাদ অর্ক মাকে “আমি আসছি”, বলে ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে যায়। বোধহয় কোনও বন্ধু ডেকেছে, এই ভেবে অফিস থেকে ফেরা ক্লান্ত মায়ের একটু চোখ লেগে যায়। দরজা খোলাই ছিল, অর্ক ফিরবে তো এক্ষুনি।

রাত পৌনে ন’টার সময় ধড়মড়িয়ে উঠে দূর্বা দেখেন, অর্ক তখনও বাড়ি ফেরেনি। দৌড়ে বসার ঘরে এসে দেখেন একটা খাতা, তার মধ্যে একটা পাতায় পেনসিল দিয়ে লেখা, "মা, আমি তোমায় হতাশ করেছি। আমায় কেউ ভালোবাসে না। আমি চলে গেলে কারোর মন খারাপ হবে না।" প্রচন্ড ভয় পেয়ে পুলিশে ফোন করেন দূর্বা, এবং পুলিশ এসে তাঁকে জানায় যে পাশের বাড়ি, যেখানে ডিরিল থাকে টপ ফ্লোরে, সেই বিল্ডিঙের ছাদ থেকে পড়ে মারা গেছে তাঁর একমাত্র সন্তান।

এখন দূর্বার আইনজীবী ব্যারি সোয়াড্রন মামলাটি নিয়ে প্রভিনশিয়াল সরকারের কাছে, অর্থাৎ ওন্টারিওর প্রিমিয়ার ডগ ফোর্ডের কাছে আবেদন রাখছেন। এখানকার কাগজেও লেখালেখি হয়েছে, তবে টরন্টো স্কুল বোর্ড কোন সহযোগিতা করেনি, বলেছেন দূর্বা। তিনি আরও বলেছেন যে পুলিশও মামলাটিকে বলছে ‘কনক্লুডেড’ কিন্তু ‘ওপেন’। শিক্ষামন্ত্রী স্টিফেন লেস সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন, “আমদের সক্রিয় প্রচেষ্টা থাকে সব বাচ্চাদের একটা সুস্থ এবং নিরাপদ পরিবেশ দেওয়ার।”

অথচ ক্যানাডায় সর্বস্তরের ছাত্রছাত্রীর নিরাপত্তা আজ বিপন্ন। বিশ্বতালিকায় ২০ তম এবং ক্যানাডায় সর্বশ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয় ইউনিভার্সিটি অফ টরন্টোয় গত দু’বছরে চারটি ছাত্র একই বিন্ডিং, বাহেন সেন্টার ফর ইনফরমেশন অ্যান্ড টেকনলজি, থেকে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেছে। অবস্থা এমন, যে কর্মকর্তারা বিল্ডিংটির একটি ধার ঘিরে দিয়েছেন, যাতে ওই দিক থেকে আর কেউ ঝাঁপ না দিতে পারে।

গত মার্চ মাসে ছাত্রদের মধ্যে প্রবল বিক্ষোভ এবং তীব্র বিতর্ক দেখা দেয়। শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্য এবং সুরক্ষায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা সম্পর্কিত প্রশ্ন আসতে থাকে শিরোনামে। একাধিক অ্যান্টি-সুইসাইড হেল্পলাইন বসানো সত্ত্বেও ছাত্রদের মতে, তেমন জোর দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ছাত্রছাত্রীদের ক্রমবর্ধমান মানসিক স্বাস্থ্য মহামারীর মোকাবিলার চেষ্টা করছেন না।

এর জেরে সেপ্টেম্বর মাসেই শতাধিক শিক্ষার্থী কার্যালয়ের বাইরে ‘সাইলেন্ট ক্যান্ডল-লাইট’ প্রতিবাদ করেছিল। “আপনারা রাতে ঘুমোন কী করে?” প্রশ্ন করেছিল এক প্রতিবাদী ছাত্রী। “এর পর কার সন্তান?” পোস্টারে ছেয়ে যায় ক্যাম্পাস। মানসিক অবসাদের জন্য হেল্পলাইন করা হয়েছে, কিন্তু তারা আত্মঘাতী মনস্কদের অ্যাপয়েন্টমেন্ট দিচ্ছে চার মাস পর! মানসিক অবসাদগ্রস্তদের সংখ্যা, পরিসর এবং অবসাদের তীব্রতার জন্য যে তাঁরা প্রস্তুত নন, তা স্বীকারও করেছেন কর্তৃপক্ষ।

ক্যানাডার মতন “ছাত্রদের স্বর্গ”তেও শিক্ষার্থীরা আত্মহত্যা করছে এবং ‘বুলিইং’এর শিকার হয়ে মারা যাচ্ছে গত কয়েক বছর ধরেই। এখানকার প্রেস বা মিডিয়া তেমন সক্রিয় নয়, বা সক্রিয় হতে হয়তো দেওয়া হয় না, হয়তো নানান আইনি প্যাঁচে জড়িয়ে রাখা হয়। যে কারণে মিডিয়া তেমনভাবে নেতিবাচক কোনও খবর নিয়েই মাতামাতি করতে পারে না। অনেক খবরই ধামাচাপা দেওয়া থাকে।

এত সুন্দর দেশ, যাকে প্রায় শিশুদের স্বর্গ বলা যায়, এখানেও মানসিক রোগের জটিলতা প্রবেশ করে গেছে বাচ্চাদের মনে। বর্ণবৈষম্যে ভরে যাচ্ছে চারপাশ। ইউনিভার্সিটির পড়ার চাপেই হোক, অতিরিক্ত একান্ত থাকার প্রয়োজনেই হোক, বা একাকীত্বের জন্যই হোক, ক্যানাডার ছেলেমেয়েদের মধ্যে মানসিক অবসাদ বেড়েই চলেছে। সোশ্যাল মিডিয়ার অলীক দুনিয়ার ঘুর্ণিতে পাক দিতে দিতে বাইরের দুনিয়ার সঙ্গে মোকাবিলা করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলছে। অতিরিক্ত পাওয়ার মধ্যে কিছুই না পাওয়ার শূন্যতা তাদের যেন শ্বাসরুদ্ধ করে দিচ্ছে ক্রমাগত।

Advertisment