এবার আসা যাক বাংলার কথায়। কেমন আছেন বাংলায় ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেলের উত্তরসূরীরা?
করোনা আবহে দায়িত্ব বেড়ে গিয়েছে অনেক। ডিউটিতে থাকলে কাজ থেকে মুখ তোলার সময় থাকে না। চরম ব্যস্ততার মধ্যেই ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলাকে সময় দিলেন ক্যালকাটা মেডিকাল কলেজের মেডিসিন বিভাগের স্টাফ নার্স শ্রীপর্ণা নস্কর। কী বললেন শ্রীপর্ণা? “আমাদের অন্যান্য সময় ৬ ঘণ্টা কাজ করতে হয়। কোভিড পরিস্থিতি সামাল দিতে সেটা ৮ ঘণ্টা করা হয়েছে। টানা ৮ ঘণ্টা এখন পিপিই পরে থাকতে হয় আমাদের। খুব কিছু শারীরিক সমস্যা না হলে ওই ৮ ঘণ্টায় জল খাওয়া যাচ্ছে না, খাবারও না। ওয়াশরুমেও যেতে পারছি না আমরা। শরীরে জলের চাহিদা বাড়ছে। অথচ জল খাওয়ার উপায় নেই। একবার পিপিই খুলে ফেললে নতুন পিপিই পরতে হয়। শুধু আমাদের অবশ্য না, একই সমস্যার মুখে পড়ছেন চিকিৎসকেরাও। আমাদের ওয়ার্ডে এসি-র ব্যবস্থা নেই। এসিতে সংক্রমণ ছড়িয়ে যায় বলে। তাই এই গরমে টানা ৮ ঘণ্টা পিপিই পরে থাকলে কেমন লাগে, সেটা যাঁরা পরছেন না, তাঁদের পক্ষে বোঝা সম্ভব নয়।”

“আমরা আরও একটা সমস্যার মধ্যে পড়ছি, সোশ্যাল মিডিয়ায় এত ভুল তথ্য ছড়িয়ে যাচ্ছে, মানুষ আমাদের দেখলেই কোভিড আক্রান্ত ভাবছেন। যাঁরা সরাসরি মুখে কিছু বলছেন না, তাঁদেরও হাবেভাবে আতঙ্কের ছাপ স্পষ্ট। ইন্টারনেটের যুগে কী হয়েছে? তথ্য খুব তাড়াতাড়ি ছড়িয়ে পড়ে, সেখানে ঠিক-ভুল, সত্যি-মিথ্যে বিচার করা সম্ভব হয় না। করোনা নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতার চেয়ে অনেক বেশি আতঙ্ক ছড়িয়েছে। আমার এক সহকর্মীকে তার বাড়িওয়ালা বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে যেতে বলেছে। ওর কাছে কিন্তু কোভিড টেস্টের নেগেটিভ রিপোর্ট ছিল। এই চরম দুর্দিনে নার্সরাও যে ডাক্তারদের মতোই দিন নেই, রাত নেই, খেটে চলেছে, সেটা কেউ বুঝতে পারছে না। এই যে এত প্যানেল ডিসকাশন হয় টিভিতে, ডাক্তারদের ডাকা হয়, নার্সদের হয়না কেন?” প্রশ্ন শ্রীপর্ণার।
আরও পড়ুন, ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল কেন আজও প্রাসঙ্গিক, কোভিড কীভাবে কেড়ে নিচ্ছে তাঁর উত্তরাধিকার?
স্বাস্থ্যকর্মী বললেই সাধারণ মানুষের চোখে ভেসে ওঠে চিকিৎসকদের চেহারা। সম্মানটাও অনেক বেশি পান তাঁরাই। নার্সিংকে যেন পেশা হিসেবে এখনও খানিকটা খাটোই করা হয় এই দেশে। এটা কেন? এই প্রসঙ্গে নীলরতন সরকার হাসপাতালের ইএনটি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ডঃ টিকে হাজরা বললেন, “মানুষের মনে একবার যে ধারণা হয়ে যায়, তা বদলানো সময় সাপেক্ষ। আরেকটা ব্যাপার আছে। বেসরকারি হাসপাতালে এখনও প্রশিক্ষিত নন, এমন নার্স নিয়োগের চল রয়েছে। অনেক ছোটখাটো নার্সিং হোমে আয়াকে নার্স বলে চালানো হয়। কোনও পেশা ছোট নয়। তবে যিনি যে কাজে প্রশিক্ষণ পেয়েছেন, তাঁর সেই কাজে দক্ষতা বেশি থাকে। একজন ডাক্তার স্থেথো গলায় ঝুলিয়ে এলেই রোগীর আত্মীয় এটুকু নিশ্চিত হন, যে এঁর ন্যূনতম একটা ডিগ্রি রয়েছে। নার্সদের ক্ষেত্রে এই চোখ বন্ধ করে ভরসার ব্যাপারটা এখনও তৈরি হয়নি। তবে আমি নিজে বহু বছর বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালে থাকার দরুন দেখেছি, হয়তো মহিলা হওয়ার কারণেই এঁদের মধ্যে স্বভাবজাত সেবার মনোভাব অনেক বেশি থাকে।”
প্রায় একই কথা বললেন অ্যাপলো গ্লেনিগেলস-এর মেডিসিন বিভাগের চিকিৎসক পৃথ্বীরাজ মাইতি। ডাঃ মাইতির কথায়, “ডাক্তাররা তো সারাক্ষণ ওয়ার্ডে থাকেন না। রোগীর হাল হকিকত সবচেয়ে ভালো জানেন নার্সরাই। কোনও রোগী গুরুতর অসুস্থ, তা বুঝতে পেরে কিন্তু ঠিক সময়ে নার্সরাই আমাদের ফোন করেন। আমরা তখন ফোনে বলি আপতকালীন ব্যবস্থা কী নিতে হবে, যাতে আমরা পৌঁছনোর আগে, রোগীর কিছু হয়ে না যায়। প্রাথমিক চিকিৎসা কিন্তু সেই অর্থে নার্সরাই করেন। তবে উন্নয়নশীল দেশে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গী বদলাতে সময় লাগে। নার্সিং নিয়ে বিএসসি ডিগ্রি এখানে বেশিদিন চালু হয়নি। তাই ভরসাটা বাড়তে, নার্সিং পেশাটার প্রতি সম্মান বাড়তে এখনও সময় লাগবে।”
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলার তরফে যোগাযোগ করা হয়েছিল বাংলার নার্স সংগঠন নার্সেস ইউনিয়নের সেক্রেটারি ভাস্বতী মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে। ভাস্বতী দেবী বলেন, “নার্সদের চিকিৎসকের সঙ্গে একাসনে না বসতে পারাটা কিন্তু জনস্বাস্থ্যের পক্ষে মোটেও ভালো কথা না। ডাক্তার-নার্স-টেকনিশিয়ানের মধ্যে সুস্থ সম্পর্ক, পারস্পরিক সম্মান না থাকলে স্বাস্থ্যব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়তে বাধ্য। করোনা আবহে রাজ্য সরকার থেকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল এই পরিস্থিতিতে টানা ৭ দিন কাজ করবেন নার্সরা, পরের সাতদিন ছুটিতে থাকবেন। এর পরেও তাঁদের থেকে বেআইনি ভাবে উইক অফ কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। সম্প্রতি বাঙ্গুর হাসপাতালে চ্যানেল সমেত এক রোগীকে হাসপাতাল থেকে রিলিজ করে দেওয়া হয়। সংশ্লিষ্ট বিভাগের দুই নার্সের বিরুদ্ধে তদন্ত কমিটি বসে তাঁদের অবগত না করে। এবং সম্পূর্ণ বেআইনি পদ্ধতিতে উত্তরবঙ্গের প্রত্যন্ত গ্রামে বদলি করে দেওয়া হয় ওঁদের।
“নার্সদের বিরুদ্ধে বঞ্চনা সব জায়গায় রয়েছে। সরকারি এবং বেসরকারি, দু’ধরনের ব্যবস্থাতেই। বেসরকারিতে বঞ্চনা আরও বেশি। টাকা পয়সা, সুযোগসুবিধে আরও কম। তাছাড়া আমার মনে হয়, করোনা পরিস্থিতি সামলাতে কমিউনিটি মেডিসিনে বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নার্সদের কাজে লাগানো উচিত ছিল। আমরা চাকরিজীবনে এসে সরকারের টাকায় এটা নিয়ে পড়াশুনো করেছি। অথচ সমাজের যখন আমাদের সবচেয়ে দরকার ছিল, আমরা কিচ্ছু করতে পারছি না। প্রশাসন আমাদের সেই সুযোগটাই দেয়নি।”
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন