Advertisment

করোনাভাইরাস কি ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটাচ্ছে?

চাপের মুখে মানুষ বলির পাঁঠা খোঁজে। ইউরোপে পঞ্চদশ শতক থেকেই সেই বলির পাঁঠা ছিলেন ইহুদীরা। ইউরোপের ভয়াবহ প্লেগ মহামারীর সময় ইহুদীদের যথেচ্ছ হত্যা করা হয়

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
coronavirus pandemic

দিল্লির নিজামুদ্দিন এলাকায় লকডাউন যাপন। ছবি: অভিনব সাহা, ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস

এক শতাব্দী পর ফের অস্তিত্বের সঙ্কটে মানবজাতি: ২০২১ দেখার জন্য কে বেঁচে থাকবেন, কে থাকবেন না? বিমূর্ত অর্থে এই প্রশ্ন নেহাতই আলঙ্কারিক, কারণ মৃত্যুর হার সাধারণভাবে কমই থাকবে। তবে কৌতূহলোদ্দীপকও বটে, কারণ মৃত্যুর হার যাই হোক, মৃতের মোট সংখ্যা খুব কম হবে না, এবং সকলের মনেই সুপ্ত ভয় থাকবে, তাঁদের আত্মীয়-বন্ধুরা মহামারীর পরিসংখ্যান হয়ে যাবেন কিনা, তা নিয়ে।

Advertisment

বিশ্বব্যাপী ইনফ্লুয়েঞ্জা মহামারীর ১০০ বছর পার হওয়ার এই সময়কালে জল্পনামূলক সাহিত্য এবং ভবিষ্যচর্চা বা 'futurology'-র প্রকাশ ঘটেছে স্বাধীন চিন্তাধারা হিসেবে, মহানন্দে মানুষের মুর্খামির ফল আমাদের সামনে তুলে ধরে তারা। স্বাধীন বিশ্বে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী অন্ধকারের পর আসে অভূতপূর্ব সচ্ছলতা এবং জনসুরক্ষার এক যুগ। যেখানে উৎকণ্ঠা ছিল, সেই ফাঁক ভরাট করতে চলে আসে অন্যের দুঃখের কাহিনীকে পরোক্ষভাবে নিজের জীবনে অনুভব করা, 'ডিস্টোপিয়া'র (ধ্বংস-পরবর্তী পৃথিবী) কাহিনী, এবং 'ডিজাস্টার পর্ন' (ভদ্র বাংলায়, বিপর্যয়ের অতিরিক্ত প্রদর্শন)।

আরও পড়ুন: স্প্যানিশ ফ্লু: শতবর্ষে হঠাৎ প্রাসঙ্গিক ভারতের আরেক মহামারী

গোদাভাবে বলতে গেলে, এই সাহিত্যের ভিত হলো উন্নততর বুদ্ধিসম্পন্ন প্রাণী অথবা নিজেদেরই বিধ্বংসী বুদ্ধির হাত থেকে মানবজাতির নিজেকে সুরক্ষিত না রাখতে পারার কিসসা। উদাহরণস্বরূপ, 'দ্য টার্মিনেটর' ছবিতে কৃত্রিম বুদ্ধি বা 'আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স', এবং 'ম্যাড ম্যাক্স: ফিউরি রোড' ছবিতে সামাজিক/পরিবেশগত বিপর্যয়। কিন্তু কেউই কল্পনা করতে পারেন নি, এমন এক মহাভাইরাস আসবে যা আমাদের অস্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলবে। তো এখন যখন আসল বিপদ এসেই পড়েছে, তখন হয়তো অন্যের কল্পিত বিপদের কাহিনী কিছুদিন তোলা থাকবে। এবার পালা রসাত্মক এবং ব্যাঙ্গাত্মক সাহিত্যের।

বিষয়বস্তু ছাড়াও সম্ভবত পাল্টাতে চলেছে এই নতুন চিন্তাধারা পরিবেশন করার ধরন, এবং তার মোড়ক। এমনিতেই আমাদের জীবন বদলে দিয়েছে একাধিক বিঘ্নকারী নতুন প্রয়াস, যেগুলির মাধ্যমে আমরা নতুন চোখে দেখছি কিছু চিরাচরিত প্রথাকে, তা সে খাদ্যই হোক বা মিডিয়া, এমনকি শিক্ষাও। কিছু প্রয়াস, যেগুলি এখনও সশরীরে মাল পৌঁছে দেওয়ার ওপর নির্ভর করে, সেগুলি লকডাউনের আবহে হোঁচট খাবে, যার ফলে সোশ্যালিস্ট যুগের অভাব-অনটনের ভুলে যাওয়া স্মৃতি ফের চারণ করব আমরা।

অন্যান্য কিছু পরিষেবার ফলে আবার লকডাউন সহনীয় হয়ে উঠছে। যে শ্রেণীর কথা হচ্ছে, কল্পনা করুন তারা গৃহবন্দি হয়ে রয়েছে স্ট্রিমিং মিউজিক বা ভিডিও, রান্নার ক্লাস, ভালো থাকার অ্যাপ এবং সোশ্যাল মিডিয়া ছাড়া। পুরোনো অভ্যাস সহজে মরে না, তবে পরিষেবা পৌঁছে দেওয়ার বিকল্প মাধ্যম তৈরি হয়ে গেলে মৃত্যু ত্বরান্বিত হতেই পারে। সঙ্গীতের জগতে ইতিমধ্যেই ব্যক্তিগত সংগ্রহের বদলে এখন দস্তুর হয়ে উঠেছে স্ট্রিমিং পরিষেবা। সপ্তাহান্তে মাল্টিপ্লেক্সে যাওয়াটা এখনও অভ্যাস বটে, তবে শহরাঞ্চলে স্ট্রিমিং ভিডিও যে অনায়াসে পাওয়া যায়, তার আকর্ষণ মোহময়।

আরও পড়ুন: COVID-19 বিজ্ঞানের সহজপাঠ

অন্যদিকে, এখনও ছাপার অক্ষরে বই আঁকড়ে ধরে আছে দুনিয়ার এক বড় অংশ, এবং আমাদের অঞ্চলে সকালে খবরের কাগজ পড়ার অভ্যাস এখনও যায় নি। তবে অভ্যাস মাত্রেই ভঙ্গুর, এবং এক কাপ চা ও মোবাইল হাতে বসার অভ্যাসও কিছু কম জোরদার নয় - বিশেষ করে যদি কেউ অতিমাত্রায় স্বাক্ষর না হন, অথবা অডিও ও ভিডিওর খবরেই বেশি স্বচ্ছন্দ বোধ করেন।

ব্যবসায়িক এবিং রাজনৈতিক, দুদিক থেকেই লাভজনক হতে পারে এই সুযোগ। দুনিয়ার বৃহত্তম গণতন্ত্রগুলিতে সাম্প্রতিক সামাজিক ও ধর্মীয় মেরুকরণ মনে করিয়ে দেয় সেইসব সর্বনেশে বিভাজনের যুগের কথা, যখন ধর্মই ছিল রাজনীতির পরিচায়ক। মানসিক চাপ আমাদের সবচেয়ে অন্ধকার দিকগুলোকে টেনে বের করে আনে, এবং নভেল করোনাভাইরাস আমাদের সঙ্গে যতটা সময় থাকবে, তা গুরুতর মানসিক ক্ষতিসাধনের পক্ষে যথেষ্ট।

চাপের মুখে মানুষ বলির পাঁঠা খোঁজে। ইউরোপে পঞ্চদশ শতক থেকেই সেই বলির পাঁঠা ছিলেন ইহুদীরা। ইউরোপের ভয়াবহ প্লেগ মহামারীর সময় ইহুদীদের যথেচ্ছ হত্যা করা হয় বার্সেলোনা, তুলোঁ, ফ্রাঙ্কফুর্ট, মাইনজ, কলোন, বাসেল ইত্যাদি শহরে - এই ধারণার বশে যে তাঁরা অপেক্ষাকৃত অনাক্রম্য, সম্ভবত কারণ তাঁরা তুলনামূলক ভাবে পরিচ্ছন্ন জীবনযাপন করতেন। সেই হত্যালীলার জেরে ইহুদীরা বাধ্য হন পূর্ব ইউরোপের দিকে সরে আসতে, যেখানে ছয় শতাব্দী বাদে বৃত্ত সম্পূর্ণ করে হিটলারের 'হলোকস্ট', যার ভূরাজনৈতিক ফলাফল হলো ইজরায়েলের স্থাপনা।

আরও পড়ুন: করোনায় গণতন্ত্র, এবং ‘ফেক নিউজের’ দাপট

বর্তমানে এশিয়ার বেশ কিছু অঞ্চলে একইভাবে কোণঠাসা, পুনঃ-শিক্ষিত, বা বৈষম্যের শিকার করা হচ্ছে মুসলমানদের। দিল্লির নিজামুদ্দিনে তবলিগি জামাত কাণ্ড, যা COVID-19 এর প্রসারের ক্ষেত্রে নতুন ভরকেন্দ্র হয়ে দাঁড়িয়েছে, এই বৈষম্যের পরিচায়ক। অনেক ক্ষেত্রেই ভুল করেছে এই সংগঠন, সবচেয়ে বড় ভুল হয়েছে দিল্লি সরকারের নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে গিয়ে জমায়েত করা। জনমত বলছে, জনস্বাস্থ্যের এত বড় ক্ষতি করার জন্য শাস্তি হওয়া উচিত তবলিগি নেতৃত্বের, এবং জনমত ঠিকই বলছে।

কিন্তু প্রশাসনিক ব্যর্থতার দিকে দৃষ্টি আকর্ষিত হচ্ছে না কারোরই। দিল্লির গুরুত্বপূর্ণ একটি থানার এলাকায় হয় এই জমায়েত, যেখানে জমায়েত-বিরোধী আইন বলবৎ করা উচিত ছিল প্রশাসনের। এই ধরনের বিভেদমূলক আচরণ কিন্তু প্রাথমিক স্তরের সতর্কবার্তা। সুদূর ভবিষ্যতের রাজনৈতিক বিশ্লেষক এবং ঐতিহাসিকরা হয়তো আমাদের অদূর ভবিষ্যতের দিকে ফিরে তাকিয়ে সেটাই বলবেন যা আমরা হলোকস্ট-এর ক্ষেত্রে বলি: "আর কখনও নয়"।

coronavirus
Advertisment