১৯৮৪ সালের কথা। লোকসভা নির্বাচন। তখন সবে বর্তমান সংবাদপত্রে শিক্ষানবিশ সাংবাদিক। যাদবপুরে সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে কংগ্রেস প্রার্থী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ভোট কভার করে একটি রিপোর্ট দিলাম তৎকালীন সম্পাদক বরুণ সেনগুপ্তকে। বরুণদা আমার লেখাটি পড়ে বললেন, "জয়ন্ত, এই লেখাটা বাংলায় লিখে আনো।" আমি বিস্মিত চিত্তে প্রশ্ন করলাম, "কেন বরুণদা? এটা তো বাংলাতেই লেখা।" জবাবে আমার ‘সাংবাদিক’ জীবনের প্রথম সম্পাদক বলেছিলেন, "এত তৎসম শব্দ, এত চিত্রকল্প, এত সাহিত্য! এসব ছাড়ো। তুমি তো রাজনৈতিক রিপোর্টিং করছ! মোদ্দা কথাটা কী সেটা আগে স্পষ্ট ভাষায় বলো।"
সাংবাদিকতার সঙ্গে সাহিত্যের সহবাস এবং পরবাস নিয়ে অনেক বিতর্ক হয়েছে। অনেক বিতর্ক হবেও। কিন্তু এবার দিল্লি থেকে বলছি সোজাসাপটা। ভোট যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। দিল্লি উত্তাল এখন। ভ্রমণ কাহিনী! তোমায় দিলাম নাহয় আজ ছুটি।
দিল্লি ভারতের রাজধানী শহর। কলকাতা থেকে ১,৫০০ কিলোমিটার দূরে। এই দিল্লি শহরে পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি সাংবাদিক হিসাবে আমাদের এখন খুব ডিমান্ড। আমি 'নন রেসিডেন্ট বং'। ৩২ বছর ধরে এই শাহি দিল্লি আমার ঠিকানা। তবে দিল্লিতে থাকলেও সারা জীবন ধরে কাজ করেছি বর্তমান আর আনন্দবাজারে। তাই দিল্লিতে কাজ করলেও সব সময়েই special reference টা ছিল পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি। সিপিএম থেকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। আর এখন এই ২০১৯ সালে যেখানেই যাচ্ছি, প্রশ্ন একটাই, "দাদা, বাঙ্গাল মে কেয়া হো রহা হ্যায়? বাঙ্গাল মে বিজেপি কো কিতনা সিট মিলেগা?"
এই প্রশ্নটা আজ নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহ তথা বিজেপি শিবিরের কাছেই খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। তার কারণ একটাই। ২০১৪ সালে যে মোদী সুনামি ছিল, ২০১৯ সালে তা নেই। এ হলো 'ল অফ নেচার'। আমি বলি, অর্থনীতির প্রান্তিক উপযোগিতার তত্ত্ব। পাঁচ বছরে অসন্তোষ ক্রমবর্দ্ধমান। উর্ধমুখী প্রেম, নিম্নগামী হয় মোহভঙ্গে। কিন্তু উত্তর প্রদেশ, রাজস্থান, মধ্য প্রদেশ, ছত্তিশগড় প্রভৃতি রাজ্যে ২০১৪ সালের লোকসভা ভোটে বিজেপি সর্বোচ্চ আসন পেয়ে বসে আছে। এবার যদি এসব রাজ্য থেকে বিজেপির আসন কমে যায়, তবে শীর্ষ নেতৃত্বের আশা পশ্চিমবঙ্গ, ওড়িশা এবং উত্তর পূর্বাঞ্চল থেকে দলের ঘাটতি পূরণ হয়ে যাবে। ওড়িশায় বিজেপির কয়েকটি আসন বাড়তে পারে, কিন্ত এখনও সে রাজ্যে নবীন পট্টনায়কের বিপুল জনপ্রিয়তা আছে। উত্তর পূর্বাঞ্চলের মধ্যে আসামে বিজেপির ফলাফল ভাল হতে পারে।
কিন্তু পশ্চিমবাংলায় কী হবে? দেখুন, বিজেপির এখন রাজ্যে দুটি আসন আছে। তার মধ্যে একটি হলো দার্জিলিং। বিজেপির আসন সংখ্যা যদি বাড়ে তবে কটা বাড়বে? দুই থেকে ১০ হবে? মানে বিজেপির ডবল ডিজিট হবে কি? ঠিক এই প্রশ্নটাই আপাতত সবাই করছে। আগে বিজেপি আশা করেছিল ২ থেকে ২২। এখন জাতীয় সংবাদ মাধ্যমের বেশ কিছু চ্যানেল বলছে ২ থেকে ১০। আমি প্রথমেই বলব, আমি কোনও সংখ্যা আগাম ঘোষণা করতে রাজি নই। আমি জ্যোতিষ চর্চা করি না। আর আমি তো সেফোলজিস্টও নই।
নির্বাচনী সমীক্ষা, মানে যাকে বলে ইলেকশান সার্ভে, সে ব্যাপারটা কিন্তু খুব সহজ কাজ নয়। ধরুন আপনি একটা কেন্দ্রে গেলেন, সেখানে গিয়ে পাঁচজন ভোটারের সঙ্গে বা দশজন বা দুশো জনের সঙ্গে কথা বললেন। জানতে চাইলেন কাকে ভোট দেবেন। তাতে যাঁর সঙ্গে আপনি কথা বলছেন, তিনি যে আসলে আপনাকে মনের কথা বলছেন, তা নাও হতে পারে। সেখানে একটা ফ্যালাসির সম্ভাবনা থাকে। তাছাড়া survey methodology - আমাদের রাজনীতি বিজ্ঞানের এম এ সিলেবাসে এই বিষয়টির ওপর স্পেশাল পেপার ছিল। সে এক মস্ত কঠিন ব্যাপার। র্যান্ডাম সার্ভে বলে আমরা যাকে অভিহিত করি সেটা র্যান্ডাম হলেও আরও অনেক পূর্বশর্ত আছে। চারটি লাল গোলাপ দেখে সিদ্ধান্তে আসা অনুচিত যে পৃথিবীর সব গোলাপই লাল। কারণ সাদা গোলাপ সমীক্ষায় দেখা যায়নি। একে বলে ফ্যালাসি অফ ইন্ডাক্টিভ মেথোডলজি। আর আমি? দিল্লিতে থাকি। মাঝে মাঝে কলকাতা যাই। শুধু দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা থেকে নাড়ি টেপা চিকিৎসকের মত ভবিষ্যৎবাণী করব? সে কেমন কথা?
তবে ভবিষ্যৎবাণী না করলেও সাংবাদিক হিসাবে আমার দায়িত্ব, পরিস্থিতির রাজনৈতিক বিশ্লেষণ করা। সেই বিশ্লেষণ কিন্তু বলছে বেশ কিছু কথা। সে কথাগুলি এবার জানাই গৌরচন্দ্রিকা ছেড়ে।
প্রথমত, বিজেপি এবং নরেন্দ্র মোদী সম্পর্কে বাঙালির মনোভাবে কিন্তু একটা পরিবর্তন এসেছে। বাঙালির কাছে বিজেপি আজ থেকে বিশ বছর আগে যে ভাবে অচ্ছুৎ ছিল, আজ তা নয়। বাঙালির সাংস্কৃতিক ডিএনএ-তে একটা নিঃশব্দ পরিবর্তন আসছে। আমার মনে হয়, ঠিক যেভাবে বাঙালি ধনতেরাস এবং হনুমান জয়ন্তী শুরু করেছে, ঠিক সেভাবেই হিন্দু জাতীয়তাবাদী টোটকা সেবন করতে শুরু করেছে। বাঙালির এই দক্ষিণপন্থী হিন্দুত্বর রাজনৈতিক সত্তাটি অতীতেও ছিল, কিন্তু দীর্ঘদিনের বাম শাসন ও পরবর্তী মমতার নয়া বাম রাজনৈতিক সংস্কৃতির দাপটে চাপা ছিল। এখন নানা কারণে বাঙালি এই হিন্দি বলয়ের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করছে। হতে পারে বাংলায় প্রায় শতকরা ৩০ ভাগ মুসলমান আছেন, সেই কারণে এই ভোট ব্যাঙ্কের প্রতি অতি সদয়তার অ্যান্টি থিসিস হিসাবেও বাঙালি মননে এই প্রবণতা বিকশিত হচ্ছে। এ হল নিউটনের সূত্র। প্রত্যেক ক্রিয়ার একটি বিপরীত ও সমান প্রতিক্রিয়া আছে। তাই পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির বৃদ্ধির পূর্বশর্ত তৈরি হয়েছে। বিজেপি রাজ্যে ধারাবাহিক ভাবে বাড়ছে।
দ্বিতীয়ত, বিজেপির এই পূর্বশর্ত তৈরি হলেও, বিজেপি মমতা বিরোধী রাজনৈতিক পরিসরটি দখল করে প্রধান বিরোধী দলে পরিণত হচ্ছে একথা সত্য হলেও, ২০১৯-এ লোকসভা ভোটে এখনও মমতাই কিন্তু শেষ কথা। প্রধান নির্ধারক রাজনৈতিক শক্তি। বিগত পঞ্চায়েত নির্বাচনগুলির শতকরা ভোটের তুলনামূলক বিচার করলেও বোঝা যায়, মমতার তুলনায় বিজেপি এখনও অনেকটাই কম। আর যদি মোদী বা বিজেপির পক্ষে অন্তত ২ থেকে ৩ শতকরা ভোট সুইং হয়, তবে বেশ কিছু আসন পেতে সে শতকরা বৃদ্ধি কাজে লাগতে পারে।
তৃতীয়ত, কংগ্রেস এবং সিপিএম এই দুই দলই রাজনৈতিকভাবে কার্যত পশ্চিমবঙ্গে অবলুপ্ত হতে বসেছে। এই ক্ষয়ে যাওয়া রাজনৈতিক পরিসর বিজেপি দখল করছে, ফলে এখন মূল লড়াইটা হয়ে যাচ্ছে মমতা বনাম বিজেপি। এটা নিশ্চয়ই বিজেপির জন্য অ্যাচিভমেন্ট।
চতুর্থত, মমতা এবং বিজেপির রাজনৈতিক মেরুকরণে মমতার একটা লাভও আছে। সেটা হলো, মমতা-বিরোধী দলগুলির মধ্যে ভোট ভাগাভাগির সংখ্যা তাতে কমে যাওয়ার সম্ভাবনা। পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি এবং উর্দুভাষী মুসলমান আর যাই হোক, বিজেপিকে কিছুতেই ভোট দেবেন না। অতএব মমতা যদি সমগ্র মুসলমান ভোটটা পান, তাতে তিনি অনেকটাই সুরক্ষিত। বিজেপি অবশ্য বলছে, রাজ্যে ৪২টি আসনে সর্বত্র মুসলমান সমাজ সমান সমান ভাবে বন্টিত নয়। এক এক স্থানে মুসলমান জনসংখ্যা সংখ্যাগরিষ্ঠ আবার বহু আসনে মুসলিম ভোট নগণ্য। তাই মমতার মসুলিম প্রীতির প্রচার চালিয়ে বিজেপি এই হিন্দুসমাজকে উগ্র মমতা-বিরোধী করতে তৎপর।
সর্বশেষ বিষয় হল, হিন্দু এবং মুসলমান মেরুকরণের চেষ্টা এ রাজ্যে নতুন নয়। বাংলা অতীতে বারবার বহু দাঙ্গার শিকার হয়েছে। কিন্তু এই মেরুকরণের পাশাপাশি রাজ্যে মমতা এবং মমতা-বিরোধী রাজনীতির মেরুকরণও হচ্ছে। মমতার বিধানসভা নির্বাচন হতে চলেছে ২০২১ সালে। ২০২০ সালে কলকাতা পুরসভার নির্বাচন। তাই মমতার ক্ষেত্রেও এটি কিন্তু দ্বিতীয় টার্ম। মমতা বিরোধী 'অ্যান্টি ইনকাম্বেন্সি'-ও তৈরি হয়েছে। খোদ প্রধানমন্ত্রী জনসভায় ভাইপোর কথা বলেন। পুলিশ কমিশনারের বিরুদ্ধেও প্রচার হয়। সারদা-নারদা নিয়ে বিজেপির প্রচার অব্যাহত। মুকুল রায় যে মমতার বিকল্প, রাজ্য বিজেপির স্বচ্ছ একটা ‘মুখ’ হতে পারেন না, সেটা জেনেও মোদী-শাহ মুকুল নামক কাঁটা দিয়ে কাঁটা তুলতে উদ্যত।
মমতা কিন্তু ভোট ম্যানেজমেন্ট মোদী-শাহর চেয়ে কম জানেন না। বরং ক্রমশ যতদিন যাচ্ছে, আমার মনে হচ্ছে রাহুল গান্ধী নিজেকে এ ভোটে হাস্যস্পদ প্রমাণ করছেন। কিন্তু মমতার রাজনীতির কৌশলে চতুরতা আছে। তাই মমতা তাঁর ভোটব্যাঙ্কে শুধু মুসলিম নয়, ওবিসি, মতুয়া এবং গরীব চাষী, নানা সেগমেন্ট তৈরি করেছেন। পশ্চিমবঙ্গে অতীতে এই জাতের identity politics ছিল না। এর মধ্যে অনেকে লালু, মুলায়ম, মায়াবতীর মত পশ্চিমবঙ্গেও জাতপাতের ভোটার 'cut and paste method' এর প্রবেশের অভিযোগ তুলেছেন। কিন্তু বাংলার সমাজও নিয়ত বদলাচ্ছে। ভক্তি আন্দোলন একদা জাতপাতের গৌড়ীয় সমন্বয় এ রাজ্যে তৈরি করে, কিন্তু এখন সেই সম্বন্ধও নানা ভাবে বিধ্বস্ত। ত্রস্ত। মমতা এখন এই 'caste engineering' করেছেন, বিজেপি সেই জাতপাতকে হিন্দু ধর্মের আওয়াজ তুলে ভাঙতে পারবে কি?
আর পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির মস্ত বড় সমস্যা হল দলের সাংগঠনিক দুর্বলতা এবং সুষ্ঠু রাজ্য নেতৃত্বের অভাব। দলের মধ্যে গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের প্রাবল্য। প্রার্থী মনোনয়ন নিয়েও যথেষ্ট বিতর্ক। মোদীর বক্তৃতা শুনতে মানুষ যে উদগ্রীব, সে এক নতুন রাজনীতির প্রবণতা। কিন্তু নরেন্দ্র মোদী বাড়ি থেকে একজন ভোটারকে বের করে বুথে ভোট দিতে নিয়ে যেতে কতটা সফল হবেন? বিজেপির জয়ের পরিকাঠামো তৈরি হয়েছে বাংলায়, তবে যদি সব বাধা অতিক্রম করে বিজেপি বিপুল ভোটে জেতে বেশ কিছু আসনে, তবে তার প্রধান কৃতিত্ব হবে একজনেরই, তাঁর নাম নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদী।
( লেখক প্রবীণ সাংবাদিক। মতামত ব্যক্তিগত।)