Advertisment

শ্রীমতী সোনিয়া গান্ধী, আপনি কোথায়?

দিল্লি থেকে বলছি- তৃতীয় পর্ব। সাংবাদিক জয়ন্ত ঘোষালের কলাম।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
Delhi-Theke-Bolchi

সোনিয়া গান্ধী।

শ্রীমতী সোনিয়া গান্ধী, আপনি কোথায়? ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের এই ঝড় ঝঞ্ঝায় আপনাকে কোথাও দেখতে পাচ্ছি না। আমরা সবাই অবগত যে আপনার শরীর ভালো নেই। এখনও মাঝে মাঝেই নিউইয়র্কে গিয়ে আপনাকে চেক আপ করাতে হয়। তবে আপনি অবশ্য এবারও লোকসভায় প্রার্থী হয়েছেন সেই একই আসন থেকে। কিন্তু সেখানেও আপনার প্রতিনিধি হিসাবে মূলত প্রিয়াঙ্কা গান্ধীই কাজ করেছেন। সত্যি কথা বলতে কি রায়বেরিলি আসনে জয়লাভের জন্য আপনাকে সেখানে বার বার যেতে হবে এমনও তো নয়। তাই এবার কিন্তু শ্রীমতী সোনিয়া গান্ধী মহাশয়া, আমরা সাবাই আপনাকে মিস করছি।

Advertisment

কিছুদিন আগে সোনিয়া গান্ধী এসেছিলেন কংগ্রেসের সদর দফতর ২৪ নম্বর আকবর রোডে। সেদিন কংগ্রেসের নির্বাচনী ইশতেহারের আনুষ্ঠানিক প্রকাশ হল। রাহুল গান্ধী কংগ্রেস সভাপতি, সেদিন অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার পর মধ্যাহ্নভোজনের আড্ডা ছিল। আপনি শুধু মুখটা দেখিয়ে মঞ্চে উপবিষ্ঠ ছেলের পাশে বসে কিছুক্ষণ কাটিয়ে চলে গেলেন। কংগ্রেসের এক প্রবীণ নেতা যিনি গান্ধী পরিবারের খাস অনুগত, তিনি বললেন, ওঁর অ্যাজমার সমস্যা আছে। এখানে খুব ধূলো আর দিল্লির বিখ্যাত দূষণ, তাই তিনি চলে গেলেন।

শ্রীমতী সোনিয়াজি, আজ আপনার পুত্র শ্রীমান রাহুল গান্ধী কংগ্রেসের নেতৃত্বে। কিন্তু আমরা এই ভোটযজ্ঞে আপনাকে বড় বেশি মিস করছি। আজকের রাহুল গান্ধী ২০১৪ সালের রাহুল গান্ধী নন। ২০১৯ সালে তিনি অনেক পরিণত মনস্ক। আর যাই হোক তাঁকে এবার "পাপ্পু" বলাটা বোধহয় ওঁর প্রতি অন্যায় করা হবে। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে এটাও বলব যে ভোটের শুরুতে রাহুল যেভাবে যাত্রাটা শুরু করেছিলেন, কৃষক বিদ্রোহ-দলিত অসন্তোষ-কর্মহীনতা আরও কত রকমের প্রচারের বিষয় ছিল, এমনকি রাফালের মত ইস্যুও ছিল। কিন্তু ক্রমশ ভোট যুদ্ধ যতই এগোতে লগল ততই মনে হচ্ছে রাহুল যেন পিছু হঠছেন। অর্জুন, বিষাদ যোগ থেকে কর্মযোগে উপনীত হন শ্রীকৃষ্ণের উপদেশে, কিন্তু রাহুল গান্ধীর হতাশা কাটাতে কোনও কৃষ্ণ এলেন না।

দিল্লি থেকে বলছি: বিনা প্রস্তুতিতে কেন প্রিয়াঙ্কাকে যুদ্ধে নামানো?

সোনিয়া গান্ধীর সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় হয়েছিল দিল্লির রামকৃষ্ণ মিশন আশ্রমে। আশ্রমের অধ্যক্ষ ছিলেন স্বামী গোকুলানন্দ। সোনিয়ার সঙ্গে মহারাজের সম্পর্ক ভাল ছিল। সোনিয়া দিল্লির আশ্রমে এলেন, রামকৃষ্ণ পরমহংসর মূর্তির সামনে বসে ধ্যান করলেন। তারপর স্বামী বিবেকানন্দের উপর তৈরী প্রদর্শনী দেখলেন। এরপর গকুলানন্দের অফিস ঘরে বসে বেশ কিছুক্ষণ গল্প গুজব করলেন। সোনিয়া বললেন, শাশুড়ি ও তাঁর মা ভরত মহারাজের ঘনিষ্ট ছিলেন। রামকৃষ্ণ মিশনের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কর কথা তো কমলা নেহেরু নিজেও লিখে গেছেন বহু চিঠিতে। যাই হোক যে কথা বলছিলাম, সোনিয়ার রাজনীতির মধ্যে যে পরিণত মনস্কতা এবং ভারতের রাজনীতির স্টাইলকে রপ্ত করার ক্ষমতাটা দেখেছি, সেটা রাহুলের মধ্যে দেখা যায় না।

সোনিয়া যখন দলের দায়িত্বপ্রাপ্ত তখনই পাঁচমারি অধিবেশনে জোটধর্মের বিষয়ে দলীয় প্রস্তাব গৃহীত হয়। দলের মধ্যে সেবার জবরদস্ত বিতর্ক হয়েছিল। প্রণব মুখোপাধ্যায়ের মত প্রাচীনপন্থী নেতাদের যুক্তি ছিল, শরিকদের কাছে সারাক্ষণ মাথা নীচু করে থাকলে দলের শ্রীবৃদ্ধি ব্যাহত হবে। তাই কোয়ালিশন ধর্ম পালন করতে গিয়ে জো হজুর নীতি গ্রহণ করাটা ঠিক নয়। অন্যদিকে অর্জুন সিংয়ের মতো নেতারা বলেন, আপাতত দলের দীর্ঘ মেয়াদি কৌশল জোটধর্মই হওয়া দরকার, না হলে আশু নির্বাচনী রাজনীতিতে কংগ্রেস উঠে দাঁড়াতে পারবে না। শেষ পর্যন্ত সোনিয়া গান্ধী জোট ধর্মের আশু বাধ্যবাধকতা মেনে নেন। প্রণববাবু নিজেও ইন্দিরা গান্ধীর সময়কার একদলীয় সমন্ততান্ত্রিক অহংকার পরিত্যাগ করে কোয়ালিশন গঠনে উদ্যত হন।

মনে আছে, সোনিয়া গান্ধী রামবিলাস পাশোয়ানের মত তপশিলি নেতার সঙ্গে বোঝাপড়ার জন্য ১০ জনপথের বাসভবন থেকে হেঁটে হেঁটে রামবিলাসের বাড়ি চলে যান। রামবিলাস তাঁর বাড়ি থেকে ঢিল ছোঁড়া দূরত্বে জনপথেই থাকতেন। এমনিতে ব্যাপারটা কিছু নয়, হেঁটে না গিয়ে গাড়ি করে গিয়েও তিনি বৈঠক করতে পারতেন, জোট চূড়ান্ত করতে তাতে কোনও অসুবিধা ছিল না। তবু এই সামান্য হাঁটার মধ্য দিয়ে সোনিয়া এক অসাধারণ জোটবার্তা দিয়েছিলেন। প্রকাশ্যে জানাতে চেয়েছিলেন যে তিনি রামবিলাসকে সম্মান ও গুরুত্ব দিচ্ছেন।

এবার ২০১৯ সালে রাহুল কিন্তু এই পথ দিয়ে হাঁটলেন না। মোদীর মতো এক প্রবল পরাক্রান্ত শক্তিকে মোকাবিলা করতে গেলে বরং আরও বেশি করে জোটধর্ম পালন করা প্রয়োজন ছিল। কিন্তু তিনি কী করলেন? কেরালায় গিয়ে এমন এক আসনে প্রার্থী হলেন যেখানে বিজেপি শুধু নয়, প্রধান প্রতিপক্ষ সিপিআই। এই ঘটনায় সার্বিকভাবে বাম শিবির অসন্তুষ্ট। সিপিএম নেতারা বার বার রাহুলকে বার্তা দিচ্ছিলেন যাতে তিনি কর্নাটকের মতো দক্ষিণী রাজ্যের কোনও আসন থেকে দাঁড়ান, কিন্তু কংগ্রেস শাসিত সে রাজ্যে না গিয়ে তিনি বাম শাসিত কেরলকেই বেছে নিলেন। এর ফলে কমিউনিস্ট পার্টিতে সীতারাম ইয়েচুরির মতো যারা কংগ্রেসকে নিয়ে মোদী বিরোধী মহাজোট নির্মাণের পক্ষে, দলের মধ্যে তাঁরাই বিপদে পড়ে গেলেন। আর প্রকাশ কারাটের মতো কংগ্রেস বিরোধী কট্টরবাদীরা দলে আরও শক্তিশালী হলেন।

দিল্লি থেকে বলছি: মোদী বাংলার ক’জন ভোটারকে বুথে টেনে নিয়ে যেতে পারবেন?

মমতা বন্দোপাধ্যায়ের সঙ্গেও মোদী বিরোধী জোট গঠনের জন্য পশ্চিমবঙ্গে বোঝাপড়ার ব্যাপারে তিনি নিজে কোনও উদ্যোগই নিলেন না। মমতা নিজেই জোট চাইছেন না, শুধু একথা বলে তৃণমূল কংগ্রেসকে দূরে সারিয়ে রাখলেন। গুলাম নবি আজাদ আর আহমেদ প্যাটেলকে দিয়ে তিনি মমতার সঙ্গে কথা বলাতেন, কিন্তু মমতার সঙ্গে রাহুল নিজে কতবার আলোচনায় বসেছেন? মমতা নিজে যথেষ্ট 'সিনিয়র'। নরসিংহ রাওয়ের মন্ত্রিসভার সদস্য। রাহুল গান্ধীর বাবার সঙ্গে তিনি কাজ করেছেন। এমনকি মা সোনিয়া যতটা মমতার সঙ্গে হৃদ্যতার পরিচয় দেন ঠিক ততটা রাহুল গান্ধী কি করেছেন? রাজনীতিতে ব্যাক্তিগত সম্পর্কের রসায়নও বহু সময় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। কেজরিওয়ালের সঙ্গেও রাহুল গান্ধী শেষপর্যন্ত সমঝোতা করে উঠতে পারলেন না। কেজরিওয়ালের একটা সাক্ষাৎকার শুনছিলাম, সেখানে দেখলাম তিনি সারাসরি রাহুলের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছেন যে টুইট করে কি জোট হয়?

অন্যদিকে উত্তরপ্রদেশেও মায়াবতী আর অখিলেশ যখন জোট করলেন এবং মায়াবতী কংগ্রেসকে সেই জোটে নিতে চাইলেন না, তখন রাহুল গান্ধীর কি উচিত ছিল না একবার মায়াবতীর সঙ্গে আলোচনায় বসা। কারণ, এই রাজ্যে ২০১৪ সালে মাত্র ২টি আসন পেয়েছিল কংগ্রেস, আর বহু আসনে চতুর্থ স্থানে ছিল কংগ্রেস। ফলে মহাগাঠবন্ধনের বাইরে এবার সবক'টি আসনে কংগ্রেসের প্রার্থী দেওয়া কি সঠিক সিদ্ধান্ত হল? উনি কি মায়াবতী বা অখিলেশের সঙ্গে একবারও বসতে পারতেন না?

সোনিয়া গান্ধী আজ যদি নির্বাচনের কান্ডারী হতেন তবে বোধহয় এই পরিস্থিতিটা তৈরি হত না। ফলে, সোনিয়া গান্ধীকে এই নির্বাচনে খুবই মিস করছি আমরা। যদিও একেবারে ধাপে ধাপে কংগ্রেস সংগঠনের শীর্ষে উঠেছেন রাহুল গান্ধী। তবুও বলব, মমতা যেমন বলেছিল বিরোধীদলগুলিকে একত্র করে একটা মোর্চা হিসাবে এগোনোর দরকার, সেটা করলেন না রাহুল। এর দায় কিন্তু, রাহুলকেই নিতে হবে।

rahul gandhi Mamata Banerjee sonia gandhi Delhi Theke Bolchi
Advertisment