আজ ১৯ নভেম্বর, ঝাঁসির রানি লক্ষ্মীবাইয়ের জন্মদিন। সিপাই বিদ্রোহ বা মহা বিদ্রোহ অথবা ভারতের প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধে, ইংরেজের সঙ্গে মুখোমুখি লড়াইয়ে নেমে ঝাঁসির রানির আত্মত্যাগের কথা কারও অজানা নয়। এ লেখার বিষয়ও তা নয়। কলকাতার কাছে, ব্যারাকপুরে বিদ্রোহের আগুন জ্বলেছিল। শহিদ হন সুদূর উত্তরপ্রদেশের যুবক মঙ্গল পাণ্ডে। কিন্তু ১৮৫৭-র ওই বিদ্রোহ যখন ভারত জুড়ে চলছে, তখন এবং পরবর্তীতেও এই বিদ্রোহ নিয়ে কলকাতার জনজীবন, লেখা-লেখি, গুজব ইত্যাদিই এই আলোচনায় জায়গা পেয়েছে।
লক্ষ্মীবাইয়ের নাম ছিল মণিকর্ণিকা। বেনারসে মণিকর্ণিকা ঘাটের কাছে জন্ম বলে। ১৯ নভেম্বর লক্ষ্মীবাইয়ের জন্মদিন নিয়ে কেউ যে কখনও সন্দেহ প্রকাশ করেনি তা নয়। তবে অন্য কোনও তারিখও কেউ দাবি করেননি। ১৮৯৪ সালে মারাঠি ঐতিহাসিক দত্তাত্রেয় বলওয়ান্ত পারসনিস প্রথম ঝাঁসির রানি লক্ষ্মীবাইয়ের একটি জীবনী রচনা করেন। তিনি মূলত তথ্য সংগ্রহ করেছিলেন, লক্ষ্মীবাইয়ের তখনও জীবিত আত্মীয় স্বজনের থেকে। সেটাই ছিল রানিকে নিয়ে লেখা প্রথম বই। সেখানে তিনি জন্ম তারিখ দিয়েছেন ১৯ নভেম্বর। আর জন্ম সাল, ১৮৩৫। জন্মসাল নিয়ে পরে অনেকে কিছু প্রশ্ন তুলেছেন। কারও মতে জন্ম সাল ১৮২৭ থেকে ১৮৩১-এর মধ্যে। তবে জন্ম তারিখটা অনেকেই মেনে নিয়েছেন।
আরও পড়ুন, মৃত্যু যখন জীবনে ফেরায়
তলোয়ার সহ লক্ষ্মীবাইয়ের দাঁড়ানো ছবি, মূর্তি আমরা দেখেছি। ঘোড়ায় চড়া ছবিও চেনা। দেখতে কেমন ছিলেন লক্ষ্মীবাই? এক কথায় সুন্দরী এবং সুঠাম চেহারা। তাঁর চেহারার একটা বর্ণনা পাওয়া যায় এক ব্রিটিশ আইনজীবী জন ল্যাঙ্গ-এর লেখা ‘ওয়ান্ডারিংস ইন ইন্ডিয়া অ্যান্ড আদার স্কেচেস অফ লাইফ ইন হিন্দুস্তান’ বই থেকে। সেখানে তিনি রানির পোশাক, চোখ, নাক, মুখ, কপাল ইত্যাদি নিয়ে মন্তব্য করেছেনএবং বলেছেন, রানি গয়না পরতেন না। রানি বলতে যে সোনায় মোড়া নারী দেখতে ভারতীয়রা অভ্যস্ত, রানি তা ছিলেন না। শুধু কানে একজোড়া সোনার দুল পরেছিলেন রানি এই আইনজীবীর সঙ্গে দেখা করার সময়। তাঁর রাজ্যের মামলা নিয়ে রানি এই আইনজীবীর সঙ্গে কথা বলেছিলেন।
জন ল্যাঙ্গ তাঁর বইয়ে রানির বর্ণনায় আর যা যা লিখেছেন তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল রানির কণ্ঠস্বর। তিনি লিখেছেন, ‘ভেরি শ্রিল’। বাংলায় আমরা কর্কশ বলতেই পারি। যে রানি নিয়মিত শরীর চর্চা করতেন, ঘোড়ায় করে তরোয়াল হাতে যুদ্ধ করা শিখেছিলেন, তাঁর কণ্ঠস্বর তো এমনই হবে। যদিও ভারত সরকার তাঁকে নিয়ে যে বই প্রকাশ করেছে ‘১৮৫৭ দ্য আপরাইজিং’, সেই বইয়ে কণ্ঠস্বরের জায়গায় ‘শ্রিল’ না লিখে তিনটে ডট বসিয়ে দেওয়া হয়েছে। যেন যোদ্ধা রানির কণ্ঠস্বর কর্কশ লিখলে রানির রানিত্ব এবং মর্যাদা কমে যাবে। সেটা ১৮৫৪ সাল। রানিকে দেখে লেখকের মনে হয়েছে তাঁর বয়স ২৬-২৭ হবে। এই তথ্য থেকে পিছিয়ে গিয়ে অনেকে ঐতিহাসিক দত্তাত্রেয় বলওয়ান্ত পারসনিসের দেওয়া জন্ম সাল নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। মেয়েদের বয়স দেখে বোঝা যায়! সাহেব দেখে যা বুঝেছেন সেটা ভুল হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। এই সাহেবকে কনসাল্টেশন ফি হিসেবে রানি অনেক কিছু দিয়েছিলেন। তার মধ্যে দুটি শাল, একটা উট, একটা হাতি, দুটো গ্রেহাউন্ড কুকুরও ছিল। বাবা মোরোপন্ট তাম্বে মা ভাগীরথীদেবী। থাকতেন প্রথমে মহারাষ্ট্রের পুনেতে। সেখান থেকে চলে আসেন বেনারস। সেখানেই মণিকর্ণিকার জন্ম। সেখান থেকে তাম্বে পরিবার চলে যায় কানপুরের কাছে গঙ্গার তীরে, ব্রহ্মবার্তায়। দ্বিতীয় বাজিরাওয়ের পুজারী হিসেবে। বাজিরাওয়ের পালিত পুত্র নানা সাহেব এবং রাওসাহেবের সঙ্গেই লেখাপড়া, তরোয়াল চালানো, ঘোড়ায় চড়ার প্রশিক্ষণের শুরু।
এবার কলকাতার কথা। যখন ‘সিপাই বিদ্রোহ’ চলছে, তখন হুতোম লিখছেন, ‘একদিন আমরা মিছি মিছি ঘুরে বেড়াচ্ছি, এমন সময় শুনলেম পশ্চিমের সেপাইরা ক্ষেপে উঠেছে, নানা সাহেবকে চাঁই করে ইংরেজদের রাজত্ব নেবে।...যে ছাপা যন্ত্রের কল্যাণে হুতোম নির্ভয়ে এত কথা অক্লেশে কইতে পাচ্চেন, যে ছাপা যন্ত্র, কি রাজা কি প্রজা কি সেপাই পাহারা-কি খোলার ঘর, সকলকে একরকম দ্যাখে, ব্রিটিস কুলের সেই চির পরিচিত ছাপা যন্ত্রের স্বাধীনতা মিউটিনি উপলক্ষে কিছু কাল শিকলী পরলেন। বাঙ্গালিরা ক্রমে বেগতিক দেখে গোপাল মল্লিকের বাড়িতে সভা করে সাহেবদের বুঝিয়ে দিলেন যে,- ‘যদিও এক শো বছর হয়ে গ্যালো, তবু তাঁরা আজও সেই হতভাগা ম্যাড়া বাঙ্গালিই আছেন- বহুদিন ব্রিটিস সহবাসে, ব্রিটিস শিক্ষায় ও ব্যবহারেও অ্যামেরিকানদের মত হয়ে উঠতে পারেননি। (পারবেন কি না তারও বড় সন্দেহ) তাঁদের বড় মানুষদের মধ্যে অনেকে তুফানের ভয়ে গঙ্গায় নৌকা চড়েন না- রাত্তিরে প্রস্রাব কত্তে উঠতে হলে স্ত্রীর বা চাকর চাকরাণীর হাত ধরে ঘরের বাইরে যান, অস্তরের মধ্যে টেবিল ও পেননাইফ ব্যবহার করে থাকেন, যাঁরা আপনার ছাওয়া দেখে ভয় পান- তাঁরা যে লড়াই করবেন এ কথা নিতান্ত অসম্ভব।‘
আরও পড়ুন, সকলের নজরে রাম মন্দিরের স্থপতি, বলছেন তৈরি হতে লাগবে তিন বছর
হুতোম লিখছেন, এই সময়ে কলকাতায় গুজব রটে, বিদ্যাসাগরের উদ্যোগে বিধবা বিবাহ আইন পাস হয়েছে বলেই ‘সেপাইরা খেপেছে’। গুজব রটে প্রথম বিধবা বিবাহ বর শিরীষের ফাঁসি হবে। হুতোমের মিউটিনি নিয়ে আরও কথা আছে। কিন্তু এইটুকু কথাতেই স্পষ্ট হুতোমের বিদ্রোহীদের প্রতি দুর্বলতা ছিল।
একই সঙ্গে ১৮৫৭-এর ২০ জুন সংখ্যায় সম্পাদক গৌরীশঙ্কর ভট্টাচার্য ‘সম্বাদ ভাস্কর’-এর সম্পাদকীয় লিখছেন, ‘...আমরা রাজভক্তি ব্যতীত অন্য কিছুই জানি না।...পরমেশ্বর সমীপে সর্বদা প্রার্থনা করি যেন পুরুষানুক্রমে ইংরেজাধিকারে থাকিতে পারি। ভারতভূমি কত পুণ্য করিয়াছিলেন এই কারণে ইংরেজ স্বামী পাইয়াছেন, মৃত্যুকাল পর্যন্ত ও যেন ইংরেজ ভূপালদিগের মুখের পান হইয়া পরম সুখে কাল যাপন করেন’।
ওই একই দিনে, অর্থাৎ ২০ জুন, ‘সম্বাদ প্রভাকর’-এর সম্পাদক ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত তাঁর কাগজে লিখছেন, ‘এই দণ্ডেই হিন্দুস্তানে পূর্ববৎ শান্তি সংস্থাপিত হোক। রাজ্যের সমুদয় বিঘ্ন বিনাশ হউক। হে বিঘ্নহরঃ তুমি গভর্নমেন্টের জয়পতাকা চিরকাল সমভাবে উড্ডীয়মান কর। অত্যাচারী, অপকারী, বিদ্রোহকারী দুর্জনদিগকে সমুচিত প্রতিফল প্রদান করে যাহারা গোপনে গোপনে অথবা প্রকাশ্যরূপে এই বিষয়তর অনিষ্ট ঘটনার ঘটক হইয়া উল্লেখিত জ্ঞানান্ধ সেনাগণকে কুচক্রের দ্বারা কুপরামর্শ প্রদান করিয়াছে ও করিতেছে তাহাদিগকে দণ্ডদান কর। তাহারা অবিলম্বেই আপনাপন অপরাধ বৃক্ষের ফল ভোগ করুক’।
ঈশ্বর গুপ্ত লিখলেন,
‘কার কথা শুনে সবে সেজে সমরে?
পিপীড়ার পাখা ওঠে মরিবার তরে।।
এখনই ছেড়ে দেও, মিছে ছেলেখেলা।
আকাশের উপরেতে, কেন মারো ঢেলা।।
একবার দেখ দেখি , ধর্মপানে চেয়ে।
এতকাল বেঁচে আছো, কার অন্ন খেয়ে।।
পাখি দেখ পশু দেখো, যারা হয় পোষা।
পালকের প্রতি কভু নাহি করে গোঁসা।।
তোমরা হইলে খল, সাপের অধিক।
অধিক কি কব আর ধিক ধিক ধিক।।
এটা অবশ্য মোটেই সামগ্রিক ছবি নয়। বরং উল্টোটাই। সিপাই বিদ্রোহ নিয়ে যেমন হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের বেঙ্গল প্যাট্রিয়টের অসাধারণ নির্ভীক, দুঃসাহসী ভূমিকা, তেমনি বিদ্রোহ শেষ হওয়ার পর কিছু দিনের মধ্যে বাঙালি হাতে পেল রজনীকান্ত গুপ্তের পাঁচ খণ্ডে ‘সিপাহী যুদ্ধের ইতিহাস’। কেন তিনি এই ইতিহাস লিখলেন, তা নিয়ে বলতে গিয়ে বিনয় ঘোষ বলেছিলেন, তিনি (রজনীকান্ত) বুঝেছিলেন যে ১৮৫৭ সালের সিপাই বিদ্রোহের পরে আধুনিক ভারতের নব জন্ম হয়েছে। একই ভাবে উল্লেখযোগ্য, পাঁচকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘সিপাহী যুদ্ধের ইতিহাস’। বিদ্রোহ চলাকালীনও বেশ কিছু তুলনায় কম নামী সংবাদ পত্রে বিদ্রোহীদের কাজের সমর্থনে যুক্তি খোঁজার চেষ্টা করেছিল। সিপাই বিদ্রোহ নিয়ে লেখা হয়েছে অনেক কবিতা, গান, ছোটো গল্প, নাটক। এই নিয়ে লেখা একটি বইয়ের উল্লেখ অবশ্যই করা উচিত। ‘সেটা হল, বাঙালি বুদ্ধিজীবীর চোখে ১৮৫৭’, লেখক, মালবিকা রায় বন্দ্যোপাধ্যায়। এই লেখার বেশ কিছু তথ্য এই বই থেকে নেওয়া।
হঠাৎ দেশে উঠল আওয়াজ- “হো-হো, হো-হো, হো-হো”
চমকে সবাই তাকিয়ে দেখে- সিপাহী বিদ্রোহ!
ঘটনার অনেক কাল পরে লিখেছিলেন সুকান্ত।
যখন সিপাই বিদ্রোহ ঘটেছিল, তখনও ভারতীয় জাতীয়তাবাদের জন্ম হয়নি। গণতন্ত্র এবং স্বাধীনতার আদর্শ তখনও স্পষ্ট হয়নি ভারতীয় বুদ্ধিজীবীদের মনে। একদিকে তখন চলছে রামমোহন, বিদ্যাসাগরেরে সংস্কারের কাজ, অন্যদিকে কখনও ছোট, কখনও বড় মাপের প্রতিবাদ বিদ্রোহের ঘটনা ঘটে চলেছে ইংরেজের বিরুদ্ধে। সঙ্গে হিন্দু পেট্রিয়টের মতো সাংবাদিকতার জন্ম। চার্লস ডিকেন্স বোধ হয় এমন সময়কেই বলেছিলেন, ‘সে ছিল এক অন্যতম সুসময়, সে ছিল এক অন্যতম দুঃসময়’।