কুখ্যাত সন্ত্রাসবাদী মাসুদ আজহারের নেতৃত্বাধীন জঙ্গী সংগঠন জইশ-এ-মহম্মদের কাশ্মীর উপত্যকায় আতঙ্কের কেন্দ্রস্থলে ফেরার মরিয়া চেষ্টাই বৃহস্পতিবারের আত্মঘাতী হামলার প্রধান কারণ, বলছেন বিশ্লেষকরা। অবন্তীপোরার মত এত বড় মাপের হামলা অভূতপূর্ব হলেও, এ বছর ইতিমধ্যেই উপত্যকায় প্রায় এক ডজন হামলার ঘটনা ঘটিয়েছে জইশ, যার মধ্যে দুটি ঘটে প্রজাতন্ত্র দিবসের আগের দিন শ্রীনগরে।
এই কর্মকাণ্ডে সাহায্য করতে তার দুই আত্মীয়কে উপত্যকায় পাঠায় আজহার। তালহা রশিদ, যার মৃত্যু হয় ২০১৭ সালের অক্টোবরে, এবং উসমান হায়দার, যে তার ঠিক এক বছর পর নিহত হয়।
আরও পড়ুন: করাতকলের কর্মী থেকে জইশ জঙ্গি, কাশ্মীর হামলার মূল চক্রী আদিল
ভারত ও পাকিস্তানকে যুদ্ধের মুখে দাঁড় করিয়ে দেয় ভারতের মাটিতে জইশের প্রথম বড় জঙ্গী হানা - ২০০১ সালে দিল্লিতে সংসদ ভবনের ওপর আক্রমণ। ২০১৬-র জানুয়ারি মাসে পাঠানকোট বিমান ঘাঁটিতে হামলা চালিয়ে সাতজন সুরক্ষা কর্মীকে হত্যা করে জইশ। সে বছরই সেপ্টেম্বর মাসে ঘটে উরি হামলার ঘটনা, যাতে মৃত্যু হয় ২০ জন সৈনিকের। জবাবে লাইন অফ কন্ট্রোল বা নিয়ন্ত্রণ রেখা পেরিয়ে পাকিস্তানের মাটিতে বেশ কিছু জঙ্গী শিবিরে সার্জিক্যাল স্ট্রাইক হানে দিল্লি।
বিস্ফোরক বোঝাই গাড়ি ব্যবহার করে হামলা জইশ-এ-মহম্মদের কাছে নতুন কিছু নয়। আজ থেকে ১৯ বছর আগে, ১৭ বছর বয়সী স্কুলছাত্র আফাক আহমেদ একটি বোমা বোঝাই মারুতি গাড়ি চালিয়ে হাজির হয় শ্রীনগরের ভারতীয় সেনাবাহিনীর ১৫ কোরের (15 corps) সদর দফতরে। শেষ মুহূর্তে নার্ভ হারায় আফাক, যার ফলে গেটের বাইরেই ঘটে বিস্ফোরণ। এভাবেই নিজেদের আগমন ঘোষণা করে জইশ। এর আগে আফগানিস্তানের কান্দাহারে হাইজ্যাক হওয়া ফ্লাইট আইসি-৮১৪ এর যাত্রীদের প্রাণের বিনিময়ে জইশের প্রতিষ্ঠাতা মৌলানা মাসুদ আজহারকে ১৯৯৯ সালে মুক্তি দেয় ভারত সরকার।
স্কুলছাত্র আফাকের পর ফের একবার বিস্ফোরক বোঝাই মারুতি গাড়িতে করে সেনাবাহিনীর ১৫ কোরের (15 corps) সদর দফতরে ক্রিসমাসের দিন পৌঁঁছে যায় এক ২৪ বছর বয়সী ব্রিটিশ নাগরিক। এর পর ২০০৫ সালে এই অবন্তীপোরাতেই বিস্ফোরণ ঘটিয়ে আত্মঘাতী হয় জইশের এক মহিলা সুইসাইড বম্বার।
আরও পড়ুন: মাসুদ আজহারকে সন্ত্রাসবাদী ঘোষণা: পথের কাঁটা চিন
পাক মদতপুষ্ট জইশ-এ-মহম্মদের নাড়ির যোগ তালিবানের সঙ্গে। জইশ তথা আজহারের মূল ঘাঁটি বাহাওয়ালপুরে। ৯/১১-য় মার্কিন মুলুকে সেই ভয়ঙ্কর জঙ্গী হানার পর যখন সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ইসলামাবাদ সমর্থনের হাত বাড়ায় আমেরিকার দিকে, জইশ বিরোধিতায় নেমে পড়ে পাকিস্তানেরও।৯/১১-র কিছুদিনের মধ্যেই জইশের নিশানা হয়েছিল শ্রীনগর, জম্মু কাশ্মীর বিধানসভায় জঙ্গী হানায় নিহত হয়েছিলেন ২৩ জন। সেই প্রথম পাকিস্তান সরকারিভাবে কাশ্মীরে কোনো জঙ্গী হানার নিন্দায় সরব হয়েছিল।
২০০৩ সালে, পাকিস্তানের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি পারভেজ মোশাররফের বিরুদ্ধে দুবার প্রাণঘাতী হামলার পর তুঙ্গে ওঠে পাকিস্তান-জইশ বিরোধ। এই একই সময় কাশ্মীর উপত্যকাতেও ভিত দুর্বল হতে শুরু করে জইশের। এর প্রধান কারণ দুটি - পাকিস্তানের সমর্থন হারানো, এবং গোষ্ঠীর অভ্যন্তরে ভারতের গুপ্তচরদের অনুপ্রবেশ। উদাহরণ স্বরূপ, ২০০৪ সালে লোলাবে এক বৈঠকের পর নিহত হয় জইশের প্রায় সমস্ত শীর্ষ নেতা। অনুপ্রবেশকারী চরদের সাহায্যে সংগঠনের আরো অনেক সন্ত্রাসবাদী প্রচেষ্টা ব্যর্থ করতে সক্ষম হয় পুলিশ। ২০১১ সালের মার্চ মাসে নিহত হয় জইশের কাশ্মীর প্রধান সাজ্জাদ আঘানি।
জইশের পুনরুজ্জীবনে নূর মহম্মদ তান্ত্রে ওরফে নূর ত্রালি নামের এক স্থানীয় জঙ্গি নেতার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। নূর নিহত হয় এই পুলওয়ামাতেই, ২০১৭-র ২৫ ডিসেম্বর। ত্রালির জায়গা নিয়েছিল পাক জঙ্গি মুফতি ওয়াকাস। ২০১৭-র ৩১ ডিসেম্বর দুই সুইসাইড বম্বার-এর হানায় সিআরপিএফ-এর প্রশিক্ষণ শিবিরে প্রাণ হারিয়েছিলেন পাঁচ নিরাপত্তাকর্মী।
নূর এবং মুফতি, দুই জঙ্গিই ছিল সদ্যযুবক। একজন ক্লাস টেনের ছাত্র, যার বাবা ছিলেন পুলিশ অফিসার। অন্যজন ট্যাক্সিচালক। মুফতি ওয়াকাস নিহত হয় অবন্তীপোরায়, ২০১৮-র মার্চে।
এবারের জঙ্গী হানায় ফের জইশের টার্গেট সিআরপিএফ। একদিকে আফগানিস্তানে নিজেদের সামরিক উপস্থিতি কমানোর সাম্প্রতিক মার্কিন ঘোষণা, অন্যদিকে ভারত-পাক সম্পর্কে ক্রমবর্ধমান শৈত্য, এই পরিস্থিতিতে জইশের লক্ষ্য পরিষ্কার।ভারত-পাকিস্তান, দুই দেশকেই খাদের কিনারায় ঠেলে দেওয়া।