‘বুয়ারে ইংরেজে, যুদ্ধ বেধে গেছে,
নিত্য আসিতেছে খবর তার;
আজকে এরা ওরে গুঁতুলে বেড়ে করে,
কালকে ওরা ধ’রে জবর মার!’
সেই বুয়ার যুদ্ধ। ১৮৮০ থেকে ১৮৮১ প্রথম বুয়ার যুদ্ধ, এবং ১৮৯৯ থেকে ১৯০২ দ্বিতীয় বুয়ার যুদ্ধ হয়েছিল ইংরেজদের সঙ্গে দক্ষিণ আফ্রিকার। ট্রান্সভাল রিপাবলিক এবং অরেঞ্জ স্টেটের সঙ্গে ব্রিটিশদের এই যুদ্ধের কারণ ছিল বিবিধ। ভাবছেন তো, তার সাথে কলকাতার কী সম্পর্ক? যদি বলি, সেই বুয়ার যুদ্ধে ইংরেজ সৈন্য যে সামরিক পোশাক পরে লড়াই করেছিল, তার প্রস্তুতকর্তা এক বাঙালি? বাস্তবিকই চমকে ওঠার মতো এই তথ্য। কলকাতার বাসিন্দা বামাচরণ ভড়ের কোম্পানি ছিল তখন সামরিক পোশাক তৈরিতে রীতিমত এক নম্বর।
অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি। কলকাতা তখন ইংরেজ শাসনে অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সাফল্যের শিরোনামে। নবজাগরণের ফলে, ইংরাজি শিক্ষার দৌলতে বাঙালি তখন কেরানিগিরিতে একচেটিয়া আধিপত্য বিস্তার করছে। আবার উদ্যমী বাঙালিদের কেউ কেউ সরাসরি নেমে পড়েছেন ব্যবসায়। কত বিচিত্র সেসব ব্যবসা! কেউ বানাচ্ছেন নৌকো, কেউ আতসবাজি, কেউ বা গাঁজা ও সিদ্ধির দোকান খুলে বসছেন।
লক্ষ্মীকান্ত ধর বা নকু ধর, বৈষ্ণবচরণ শেঠ, গোকুল মিত্র, মদনমোহন দত্ত, রামদুলাল সরকার, সুখময় রায়, প্রাণকৃষ্ণ লাহা, মতিলাল শীল, শিবকৃষ্ণ দাঁ প্রমুখ বাঙালি ব্যবসায়ীর নাম ছড়িয়ে পড়ছে ক্রমশ। ইংরেজরা বিভিন্ন কারবার করার জন্য লাইসেন্স বিলি করেছিলেন বাঙালিদের মধ্যে। ঊনবিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে দ্বারকানাথ ঠাকুর খুলে ফেলেন ‘কার টেগোর অ্যান্ড কোম্পানি’ নামে এক প্রতিষ্ঠান, যা ছিল এদেশের প্রথম ইঙ্গ-ভারতীয় ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান।
আরও পড়ুন: খিদিরপুর: নাবিকদের স্মরণে তিনটি স্থান
এই প্রতিষ্ঠানের চারজন অংশীদার ছিলেন, দ্বারকানাথ ঠাকুর, ডবলিউ কার, ডবলিউ প্রিন্সেপ ও ডি এম গর্ডন। ইংরেজ শাসনে দেশের ধনসম্পদ যাতে বিদেশে চলে না যায়, এবং ভারতবাসী যাতে শুধু কৃষিনির্ভর না হয়ে থেকে শিল্প ও বাণিজ্যের প্রতি আকৃষ্ট হয়, তারই দৃষ্টান্ত স্বরূপ জন্য দ্বারকানাথ ‘কার টেগোর অ্যান্ড কোম্পানি’ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। নীল ও রেশম রপ্তানী, কয়লাখনি, জাহাজের ব্যবসা, চিনির কল স্থাপন...কী না করেছিল তাঁর কোম্পানী! ইংরেজদের সাথে যুগ্ম মালিকানায় তো বটেই, বাঙালি নিজেও বিদেশীদের সাথে রীতিমতো প্রতিযোগিতায় নেমে বাণিজ্য ক্ষেত্রে আপন সুনামের স্বাক্ষর রেখেছিল।
বামাচরণ ভড় এমনই এক সফল ব্যবসায়ী। বামাচরণের জন্ম ১৮৫১ সালে। তিনি আদত কলকাতার বাসিন্দা ছিলেন না। ইংরেজদের পৃষ্ঠপোষকতায় কলকাতা তখন উদীয়মান নগরী, সামাজিক ও অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের পীঠস্থান। দলে দলে মানুষ রোজগারের আশায় তখন দিবারাত্র ভিড় করছেন এ শহরে। বামাচরণ ছিলেন তেমনই এক ভাগ্যান্বেষী। দরিদ্র পরিবারের সন্তান, গ্রাসাচ্ছাদনের আশায় এসে পৌঁছলেন কলকাতায়, আর দশজন শ্রমিকের মতো। এ শহরে তখন হাওয়ায় টাকা উড়ছে, রাতারাতি তার হদিশ পেয়ে ভোল পালটে ফেলছে কেউ। আবার কেউ বা শহরের অন্ধকার চোরাগলিতে খোয়াচ্ছে সর্বস্ব।
কলকাতায় এসে বামাচরণ প্রথমে এক পোশাক তৈরির কারখানায় শিক্ষানবিশ হিসেবে যোগদান করলেন। সে সংস্থা মূলত ইওরোপীয় পোশাক তৈরি করত। বামাচরণ ছিলেন অসম্ভব বুদ্ধিমান ও পরিশ্রমী। অচিরেই তিনি ব্যবসার যাবতীয় বিষয় করায়ত্ত করলেন। ক্রমে তিনি কলকাতার এক পোশাক প্রস্তুতকারক ইংরেজ কোম্পানির অংশীদার হয়ে বসলেন। পরবর্তীকালে এই কোম্পানীর মালিক বিলেতে ফিরে গেলেন, পুরো ব্যবসা বামাচরণকে হস্তান্তর করে।
আরও পড়ুন: পাথরা – বাংলার মন্দিররীতির প্রদর্শনশালা
পরবর্তীকালে ক্ষেত্রমোহন দে নামে আরেক বাঙালি পাশ্চাত্য-পোশাক ব্যবসায়ীর সাথে বাণিজ্যিক গাঁটছড়া বাঁধেন বামাচরণ। নতুন কোম্পানি গঠিত হয়, যার নাম হয় ‘মেসার্স ক্ষেত্রমোহন দে অ্যান্ড বামাচরণ ভড় অ্যান্ড কোম্পানি লিমিটেড’। মূলত ইউনিফর্ম তৈরিতে এ কোম্পানি ছিল দক্ষ। বিভিন্ন ব্রিটিশ পুলিশ বাহিনী এবং সেনাবাহিনীর ইউনিফর্ম তৈরি করত তারা। ১৮৭৫ সালে আসাম পুলিশের একটি বার্ষিক প্রতিবেদনে উল্লেখ পাওয়া যায় বামাচরণের কোম্পানির। তাতে লেখা, সীমান্তরক্ষী বাহিনীর পোশাক সরবরাহকারী হিসেবে এই কোম্পানি বড্ড চড়া দাম ধার্য করেছে!
বুয়ার যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী ইংরেজ সৈন্যদের ইউনিফর্ম একচেটিয়া সরবরাহ করে বামাচরণ ও ক্ষেত্রমোহনের যৌথ কোম্পানি। এই সময় এই সংস্থা প্রভূত অর্থ উপার্জন করে। ব্যবসালব্ধ টাকা বামাচরণ ব্যয় করেন এ শহরের বুকে সুরম্য এক অট্টালিকা তৈরি করে। এবং ভাগ্য পরিবর্তনের কৃতজ্ঞতাস্বরূপ বাড়ির উঠোন সংলগ্ন স্থানে প্রতিষ্ঠা করেন কৃষ্ণের মন্দির। কিন্তু দুর্ভাগ্য বামাচরণের, নতুন বাড়ি ভোগ করার সৌভাগ্য বেশিদিন হয়নি তাঁর। দ্বিতীয় বুয়ার যুদ্ধ থামার দু'বছর পর ১৯০৪ সালে আকস্মিক মৃত্যু ঘটে তাঁর।
উত্তর কলকাতার নীলমণি সরকার লেনে বামাচরণ ভড়ের বসতবাটি ব্রজকিশোর ঠাকুরবাড়ি নামে পরিচিত। সরু গলি, বাইরে থেকে দেখে বোঝার উপায় নেই, কী অপূর্ব স্থাপত্য অপেক্ষা করছে ভেতরে। ১৮৬৫ সালে তৈরি লাল ইটের বাড়িটি দোতলা। তৎকালীন প্রচলিত জমিদার রীতিতে ইট, কড়িবরগা, চুন-সুরকি নির্মিত বাড়িটি দেড়শ বছর ধরে দাঁড়িয়ে আছে প্রায় অবিকল।
আরও পড়ুন: হাওড়ার রাসবাড়িতে রাধাকৃষ্ণের ঘরগেরস্থালি
মাঝে উঠোন, চারপাশ ঘিরে ঘরগুলি আর বারান্দা দিয়েই প্রতিটি ঘরের প্রবেশ পথ, তখনকার রীতি অনুযায়ী। প্রথমে বার-উঠোন, আর অন্দরমহলের জন্য আরেকটি উঠোন। উঠোনের এক দিকে রাধামাধবের মন্দির। প্রধান ফটক দিয়ে প্রবেশ করলে মুখোমুখি হওয়া যায় দেবতার। তিনিই কূলদেবতা। এখনো নিত্যপূজা করেন বামাচরণের বংশধরেরা। বিংশ শতকের শুরুর দিকে এই মন্দিরের খ্যাতি ছিল এখানে আয়োজিত মধুর কীর্তনের জন্য, ভক্তজনের ভিড়ে উঠোন থাকত সর্বদাই জমজমাট।
শরিকি বিভাজনের কারণে বাড়ি আজ ছোট হয়ে গেছে। পরবর্তীকালে বংশধরেরা উঠোনের এক পাশের দেওয়ালে বামাচরণ ভড়ের আবক্ষ মূর্তি খোদাই করেছেন। তার নীচে বাংলা সন অনুযায়ী তাঁর জীবনকাল লেখা ‘১২৫৪-১৩১১’। বিশেষত্বহীন বহিরঙ্গের বাড়িটির অন্দরের শোভা বর্ধন করেছে গথিক আর মুঘল স্থাপত্যরীতির সংমিশ্রণে তৈরি একাধিক আর্চ। বিম আর কলাম ধরে রেখেছে বাহারি পেনডেন্টিভ। খড়খড়িযুক্ত বারান্দা, তাতে লোহার রেলিং আর মাথায় আর্চ। রাধামাধব মন্দিরের দরজা এবং তার বাইরের উঠোনের মাথায় দ্বিস্তরীয় খিলানের অপূর্ব ব্যবহার নজর কাড়ে। উঠোনের বাকি অংশের খিলানগুলি সম্ভবত পরবর্তীকালে সংস্কার করা হয়েছিল।
ছাদের পাঁচিলের কারুকার্যও অনবদ্য। ছাদের আর্চগুলিতে দেখা যায় আংটায় আটকানো পর্দার ঝালরের প্যাটার্ন। প্রাচীনত্বের স্পর্শ এখনো ধরে রেখেছে কাঠের রেলিং-যুক্ত মার্বেল পাথরের সিঁড়ি। ছাদে পুরোনো জলছাদের নমুনা দেখা যায়, যা কিনা চুন সুরকি, গুড়, শঙ্খ গুঁড়ো, বিউলির ডাল, মেথি ইত্যাদি মিশিয়ে পাটা দিয়ে পিটিয়ে পিটিয়ে তৈরি করা হত।
অনুমান করা হয়, বামাচরণের মৃত্যুর পর তাঁর ব্যবসায়িক পার্টনার ক্ষেত্রমোহন দে সম্পুর্ণ ব্যবসার হাল ধরেন, এবং তাঁদের প্রতিষ্ঠানের নাম হয় 'ক্ষেত্রমোহন দে অ্যান্ড কোং'। তবে এ ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট তথ্যপ্রমাণ পাওয়া যায় না। আসলে বামাচরণের সাথে যৌথ ব্যবসা শুরুর আগেও ক্ষেত্রমোহনের নিজস্ব কোম্পানি ছিল। বস্ত্রব্যবসার সমান্তরালে তিনি একটি নিলাম ঘরেরও মালিক ছিলেন। সুদূর পোর্ট ব্লেয়ারে ‘আন্দামান উড’-এর কাঠের গুঁড়ির নিলামের সময় ক্ষেত্রমোহনের কোম্পানি অংশগ্রহণ করেছিল।
ক্রমশ উত্তর ভারত থেকে অবাঙালি ব্যবসায়ীরা কলকাতায় আসতে শুরু করেন। ১৮৬৫ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া রেল কোম্পানি দিল্লী পর্যন্ত রেল লাইন স্থাপন করলে রাজস্থান থেকে মারোয়াড়ি বণিকরাও ভিড় জমাতে শুরু করেন এ শহরে। কলকাতায় এসে তাঁরা বড়বাজারের আশেপাশে বসবাস ও কারবার শুরু করেন। আগে এ জায়গা বাঙালি ব্যবসার কেন্দ্র ছিল। এঁদের আগমন বাঙালির সেই একাধিপত্যকে নষ্ট করে দেয়। ১৯০৮ সালে গঠিত হয় 'কলকাতা স্টক এক্সচেঞ্জ'। তারপর বিশ্বযুদ্ধ ও ফলস্বরূপ শেয়ার বাজারে ঘনঘন জোয়ার ভাটা।
কিন্তু অর্থনৈতিক টালমাটালের সময়েও মারোয়াড়িরা ঠিক লাভ করে নেন। স্বাধীনতার পর সাহেবরা ব্যবসা বেচে দিয়ে যখন দেশে ফিরে যায়, তখন তাদের থেকে সেসব কোম্পানি একচেটিয়াভাবে কিনে নেন মারোয়াড়িরাই। বাঙালির কপালে রয়ে যায় শুধু সেসব 'বেওসাদার'-দের গোলামি। তাই, নীলমণি সরকার লেনে বামাচরণ ভড়ের সাধের বসতবাটি আজও কেরানি চাকুরিজীবী বাঙালিকে স্মরণ করিয়ে দেয় সফল উদ্যোগপতি বাঙালির সেই অস্তমিত গৌরবগাথা।