Advertisment

দাঁড়াও পথিকবর: ২০বি, কার্ল মার্ক্স সরণী

মাইকেল মধুসূদনের বাড়িটি তার তৎকালীন বৈশিষ্ট্যের অল্পই ধরে রাখতে পেরেছে। ক্রমাগত হাতবদল, বাসিন্দা বদল, নতুন ঘরের সংযোজনে স্থাপত্য বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে বলার মতো কিছুই আর অবশিষ্ট নেই।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
kolkata heritage building khidirpur

মুখ লুকিয়ে দাঁড়িয়ে সেই বাড়ি

তিন কবির বাসভূমি ছিল কলকাতার খিদিরপুর, যাঁদের অন্যতম অবশ্যই মাইকেল মধুসূদন দত্ত। জনশ্রুতি ও অনুমান নির্ভর তাঁর বিভিন্ন জীবনী থেকে জানা যায়, মধুসূদনের প্রপিতামহ রামকিশোর দত্ত খুলনার (সেকালের যশোর) বাসিন্দা ছিলেন। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর পুত্রেরা মাতামহের গ্রাম সাগরদাঁড়িতে বাস আরম্ভ করেন। পরবর্তীকালে কবির পিতা রাজনারায়ণ দত্ত যশোর ছেড়ে আসেন কলকাতায়। প্রথম সন্তান মধুসূদনের জন্ম ১৮২৪ সালের ২৫ জানুয়ারি (আনুমানিক)। তিনি শৈশব সাগরদাঁড়িতেই কাটিয়েছিলেন, কারণ রাজনারায়ণ কলকাতায় ওকালতি করলেও সেকালের রীতি-রেওয়াজ অনুযায়ী পরিবারকে গ্রামের বাড়িতেই রেখেছিলেন।

Advertisment

উকিল হিসেবে পসার লাভ করার পর ১৮০০ সালে খিদিরপুরে বড় রাস্তার ওপর একটি বাড়ি কেনেন রাজনারায়ণ, যেটি আজকের ২০বি, কার্ল মার্ক্স সরণীর বাড়িটি বলে মনে করা হয়। আবার এই বাড়িটিতেই বাল্যকালে বাস করতেন ভিক্টোরিয়ান যুগের প্রথম বাঙালি তথা ভারতীয় কবি কাশীপ্রসাদ ঘোষ (১৮০৯-৭৩), যিনি ইংরেজিতে কবিতা লিখতেন, Hindu Intelligence পত্রিকা সম্পাদনা করতেন। আনুমানিক ১৮৩৩-৩৪ সালে মাতা জাহ্ণবী দেবী মধুসূদনকে নিয়ে একান্নবর্তী পরিবারের গন্ডী থেকে বেরিয়ে খিদিরপুরের এই বাড়িতে এসে বসবাস শুরু করেন।

kolkata heritage building khidirpur আজকের ২০বি, কার্ল মার্ক্স সরণী

কারো কারো মতে মধুসূদনের পড়াশোনা শুরু হয়েছিল খিদিরপুরের কোনো এক ইংরেজি স্কুলে খিদিরপুরের এই বাড়ি থেকেই মধুসূদনের হিন্দু (বর্তমানে প্রেসিডেন্সি) কলেজে ভর্তি ও সাহিত্যজগতে প্রবেশ। ১৮৪৩ সালে খ্রীষ্টধর্ম গ্রহণের পর পরিবারের সঙ্গে বিচ্ছেদ এবং হিন্দু কলেজ থেকে বহিষ্কারের ফলে খিদিরপুরের বাড়ির সাথে মধুসূদনের বসবাসের সম্পর্ক শেষ হয়। পরবর্তীকালে মায়ের মৃত্যুর পর একবার মধুসূদন এ বাড়িতে এসেছিলেন।

মধুর গৃহত্যাগের পর একমাত্র পুত্রের ধর্মান্তরিত হওয়ার রাগে জাহ্ণবী দেবী বেঁচে থাকতেই রাজনারায়ণ একাধিক বিয়ে করেছিলেন, সেই আত্মীয়রা খিদিরপুরের বাড়িতে বসবাস করছিলেন। সম্পত্তি হাতছাড়া হওয়ার ভয়ে রাজনারায়ণের মৃত্যুর খবর তাঁরা মাদ্রাজে মধুসূদনকে জানানও নি। বন্ধু গৌরদাস বসাকের চিঠিতে বাবার মৃত্যুসংবাদ পেয়ে সম্পত্তি পুনরুদ্ধারে মধু কলকাতা আসেন। এক চিঠিতে তিনি অনুমান করেছিলেন, খিদিরপুরের ঐ বাড়ির দাম চার হাজার টাকা হবে। এই বাড়ির মালিকানা লাভ করা তাঁর পক্ষে সহজ হয়নি। আত্মীয়রা মিথ্যে উইল করে মামলা মোকদ্দমায় দীর্ঘদিন তাঁকে বিব্রত রেখেছিলেন। ১৮৬১ সালে মামলায় কবি জয়লাভ করেন।

তবে অধিকার লাভের পরও এ বাড়িতে তিনি বাস করেন নি। বিলেত যাবার খরচ জোগাড়ের উদ্দেশ্যে সাত হাজার টাকায় পৈত্রিক বাড়ি বিক্রি করে দেন, আলিপুর আদালতের দলিল থেকে জানা যায়, ক্রেতা মধুসূদনের বাল্যবন্ধু ও প্রতিবেশী রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাই হরিমোহন। নতুন মালিকের কাছে এই বাড়ির জন্য আন্তরিক দুঃখপ্রকাশ করলেও মধুসূদন বিলেত থেকে ফিরে এসে এ বাড়িতে থাকার কথা ভাবেন নি, নাহলে অত শস্তায় তিনি বাড়ি বিক্রি করতেন না। বাড়ির পিছনের এবং পাশের জমি বিক্রি করেন জেমস ফ্রেডরিক নামে ওরিয়েন্টাল ব্যাঙ্কের এক কর্মচারীকে, ১,৬০০ টাকায়।

kolkata heritage building khidirpur সরু গলি, আর্চ

kolkata heritage building khidirpur বাড়ির ছাদ

kolkata heritage building khidirpur বারান্দার উপরের অংশে কাঠের তৈরি আবডাল

এবার মধুকবির বাড়িটির স্থাপত্য প্রসঙ্গঊনবিংশ শতকে ও বিংশ শতাব্দীর প্রথমভাগে বাংলার নবজাগরণের সময়ে কলকাতা হয়ে ওঠে সংস্কৃতির এক পীঠস্থান। নাটক, সাহিত্য, সঙ্গীত, চিত্রকলা - প্রতিটি ক্ষেত্রেই বহু কৃতি মানুষ তাঁদের প্রতিভার স্বাক্ষর রাখেন এবং এক স্বতন্ত্র ঐতিহ্যের ধরণ তৈরি হয়। তেমনই স্থাপত্যেও তৈরি হয় মিশ্র সংস্কৃতি। খিদিরপুর অঞ্চল মেটিয়াবুরুজ সংলগ্ন, নবাব ওয়াজেদ আলি শাহের স্মৃতি বিজড়িত মুঘল স্থাপত্যের ধারার তৈরি মঞ্জিলের সঙ্গে মিশে যায় ইংরেজদের ইউরোপীয় স্থাপত্যশৈলী। সব মিলিয়ে তৈরি হয় জমিদার বাড়ির এক গঠন বৈশিষ্ট। তাতে মিশেল ঘটে দুটি ধারার, এক, হিন্দু ট্র্যাবিয়েটেড স্টাইল অর্থাৎ কলাম-বিমের গাঁথনি, দুই, মুঘল স্টাইল-আর্কুলেটেড স্টাইল, অর্থাৎ আর্চ-গম্বুজের প্রাধান্য। 

ইংরেজরা এবং বনেদী বাঙালীরা আবহাওয়ার সাথে সাযুজ্য রেখে লম্বা দালান, উঁচু ছাদযুক্ত চওড়া দেওয়ালের ঘরবাড়ি তৈরি করতেনদরজা জানলায় খানিক হাওয়া চলাচল নিয়ন্ত্রণ, খানিক আব্রু রক্ষার জন্য খড়খড়ি। কাঠের সহজলভ্যতা ও উন্নত জলপথ পরিবহনের কারণে লম্বা গুঁড়ি থেকে চেরাই করা কাঠের ব্যবহার হতে লাগল বিম এবং কড়িবরগায়। ছাদ বা মেঝেতে এই কড়িবরগার ওপর পোড়া মাটির টালি পাশাপাশি বা আড়াআড়ি সাজানো হত। মর্টার বা বাঁধুনির মশলা হিসেবে আর প্লাস্টারে ব্যবহৃত হত চুন-সুড়কি। কোনো কোনো ক্ষেত্রে দামী উপকরণ হিসেবে ব্যবহৃত হত শঙ্খের গুঁড়ো।

kolkata heritage building khidirpur সরু প্যাসেজ

kolkata heritage building khidirpur খোলা উঠোন

kolkata heritage building khidirpur কাঠের মোটা বিম

বৃষ্টিবহুল অঞ্চল বলে ছাদে এক ধরনের বিশেষ আস্তরণ দেওয়া হতো, যাকে বলে জলছাদ। চুন, সুরকি, গুড়, খড় এই সব মিশিয়ে পিটিয়ে পিটিয়ে তৈরি হতো পুরু একটা জল নিরোধক স্তরসাধারণত দু-মহলা বাড়ি হতো, অন্দরমহল ও বাহিরমহল মাঝে বড় উঠোন। সারিবদ্ধ ঘরের সামনে বারান্দা। রোদ আটকানোর জন্য বারান্দার উপরের অংশে কাঠের তৈরি আবডাল। থামগুলো তৈরি হতো গথিক স্থাপত্য অনুসারে। কখনো ডোরিক, আইওনিক বা করিন্থিয়ান কিছু নিয়ম মেনে, কখনো বা মিশ্র।

মধুসূদনের এই বাড়িটি তার তৎকালীন বৈশিষ্ট্যের অল্পই ধরে রাখতে পেরেছে। ক্রমাগত হাতবদল, বাসিন্দা বদল, নতুন ঘরের সংযোজনে স্থাপত্য বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে বলার মতো কিছুই আর অবশিষ্ট নেই। বিবর্ণ দোতলা বাড়িটি আশপাশের বাড়ির মধ্যে মুখ লুকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে খিদিরপুর মোড়ের ফ্যান্সি মার্কেটের দিকেসরু প্যাসেজের ভেতর দিয়ে ঢুকলে ছোট্ট একটা খোলা উঠোন, ইলেকট্রিক তারের জঙ্গল আর পুরোনো কড়িবরগা। উঠোনের চারপাশে বেশ কিছু অফিস, ফ্যান্সি মার্কেটের দোকানের গুদামঘর আর দোতলায় কিছু ভাড়াটে এবং অফিস নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে বাড়িটি।

kolkata heritage building khidirpur সামনের অংশের নতুন সিঁড়ি

kolkata heritage building khidirpur প্রধান বসতবাড়ির অবিকৃত অংশ

kolkata heritage building khidirpur সরু পথ, মাথায় আর্চ

বাইরের দিকটা মুখ লুকিয়েছে কাপড় রং-ধোলাই করার দোকানের তারে ঝুলিয়ে রাখা অজস্র রঙিন কাপড়েতার আড়াল থেকে নজরে আসে কাঠের মোটা বিম, যা আজও মজবুত। সামনের অংশের নতুন সিঁড়ি উঠেছে উঠোনের এক পাশ থেকে। উঠোন দেখে অনুমান করা যায়, তা আগে অনেক বড় ছিল। উঠোনের ডান দিকে প্রধান বসতবাড়ি। তার ভেতরে যাওয়ার সরু পথ, যার মাথায় একটা আর্চ খড়খড়ি লাগানো দু-চারটি জানলা আজও তাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে। বাঁ দিকের দোতলায় এক সময়ের বারান্দা, যা আজ ঘেরা হয়ে গেছে, তবে রয়ে গেছে মোটা কয়েকটা থাম, গোলাকার, কারুকার্যহীন। ডোরিক থামের আদল বলা যেতে পারে।

kolkata heritage building khidirpur খড়খড়ি লাগানো জানলা

kolkata heritage building khidirpur গোলাকার থাম

বিংশ শতাব্দীর নব্বইয়ের দশকের গোড়ায় তৎকালীন মালিকদের থেকে এই বাড়িটি কেনেন সালাউদ্দিন। হেরিটেজ আইন চালু হওয়ার পর পুরসভার হেরিটেজ কমিটি বাড়িটিকে গ্রেড টু হেরিটেজ মর্যাদা দেয়। যে তকমা অনুযায়ী ভাঙা তো দূরের কথা, নির্মাণে কোনো মৌলিক রদবদলও নিষিদ্ধ। সালাউদ্দিন আদালতের দ্বারস্থ হলে বাড়িটি হেরিটেজ তালিকাভুক্ত করার সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা ও পুনর্মূল্যায়ণের নির্দেশ দেয় হাইকোর্ট।

বহু বিশিষ্ট মানুষ নানা সময়ে বলেছেন, এই বাড়িটিতেই মধুকবি জীবনের বেশ কিছু সময় কাটিয়েছেন, নানা পুরোনো পত্রপত্রিকাতেও এ সংক্রান্ত বেশ কিছু লেখা প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে কমিশনে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কোনো তথ্যপ্রমাণ জমা পড়ে না। পুরকর্তারা জানান, পুর দপ্তরেও এ ধরণের কোনো নথি নেই। কমিশন খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দিলেও (জুলাই, ২০১৭) কোনো ফল মেলে না

কমিশনের চেয়ারপার্সন শিল্পী শুভাপ্রসন্ন সালাউদ্দিনকে রাজি করান যে বাড়িটি ভেঙে শপিং মল বা বহুতল যাই করা হোক, তা যেন মধুসূদনের নামে করা হয় এবং বাড়ির সামনে মধুকবির মূর্তি ও ফলক বসানো হয়। পুরসভা সূত্রে প্রাপ্ত খবর, কমিশনের সিদ্ধান্ত জানার পর পুরাতত্ত্ব বিভাগ সহ সংশ্লিষ্ট সরকারি নানা সংস্থার বিশেষজ্ঞদের কাছে মধুসূদনের বাড়ি হিসেবে ২০বি, কার্ল মার্ক্স সরণীর বাড়িটির ঐতিহাসিক ভিত্তি সম্পর্কে মতামত চাওয়া হয় ও তার ভিত্তিতে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

সর্বশেষ খবর অনুযায়ী, বাড়িটি হেরিটেজ ভবন ঘোষিত হয়েছেবর্তমান মালিক এই ঘোষণার বিরুদ্ধে উচ্চতর আদালতে যাওয়ার চেষ্টায় আছেন এই টানাপোড়েন নিয়ে বাড়িটি তাকিয়ে আছে কর্তৃপক্ষের পরবর্তী সিদ্ধান্তের দিকে। আর আমরা আত্মবিস্মৃত জাতির তকমা নিয়ে নিশ্চুপে দাঁড়িয়ে। ভবিষ্যৎ এখনো অজানা।

heritage
Advertisment