তুমি আমাদের পিতা
তোমায় পিতা বলে যেন জানি...
সময়কাল উনিশ শতক, ইংরেজ রাজত্বকাল চলছে। ইংরাজি শিক্ষায় শিক্ষিত বাঙালির নবজাগরণের শুরু। অবশ্যম্ভাবী ফল হিসেবে বাঙালি নিজের ধর্মের সংকীর্ণতা সম্পর্কে অবহিত হতে শুরু করেছে। অজস্র কুসংস্কার, ধর্মীয় গোঁড়ামি, আচার আচরণগত বাধানিষেধ, অস্পৃশ্যতার শেকলে আবদ্ধ তৎকালীন হিন্দুধর্ম। শিক্ষার আলো প্রবেশের সাথে সাথে সেই অচল কারাগারে পরিবর্তনের যুগের সূত্রপাত।
হিন্দুধর্মের সংস্কারকরূপে আবির্ভাব হলো এক মনীষীর। রাজা রামমোহন রায় (১৭৭২-১৮৩৩)। বহু ধর্মীয় তথ্য ও তার তাৎপর্য অনুসন্ধানে ব্রতী হলেন রামমোহন। বাইবেল, কোরান, গ্রন্থসাহেব, উপনিষদ, বেদ ইত্যাদি যাবতীয় ধর্মগ্রন্থ পাঠের পর তাঁর এই উপলব্ধি হলো, ঈশ্বর এক। সনাতন হিন্দুধর্মের থেকে বেরিয়ে হিন্দু পৌত্তলিকতার বিরুদ্ধে এক নিরাকার ব্রহ্মের সাধনার উদ্দেশ্যে সে সময়ে প্রচলিত হিন্দুধর্মের স্থবিরতার বিকল্প হিসাবে ২০ অগাস্ট, ১৮২৮ ফিরিঙ্গি কমল বোসের বাড়িতেই রাজা রামমোহন রায় তাঁর বন্ধুদের সঙ্গে মিলে প্রতিষ্ঠা করলেন ব্রাহ্মসভা।
তিনি চেয়েছিলেন, প্রত্যেক ধর্মের অনৈতিক শাস্ত্র আচরণ, কুসংস্কার, ধর্মীয় গোঁড়ামি বাদ দিয়ে এক সর্বজনীন নৈতিক উপদেশাবলী দিয়ে তৈরী অদ্বৈতবাদ কেন্দ্রিক একটি নতুন ধর্মবিশ্বাসের উপস্থাপন করা। তাঁর আশা ছিল, এই ধর্ম সর্বজনীন ধর্ম হিসাবে স্বীকৃতি পাবে। ১৮৬১ সালে লাহোরে নবীন রায় গঠন করলেন ব্রাহ্মসমাজ। কালক্রমে ব্রাহ্মসমাজ আদর্শগত বিরোধের ফলে বারবার তার নাম পরিবর্তন করেছে।
রামমোহনের মৃত্যুর বেশ কিছু বছর পর ১৮৬৬ সালে কেশবচন্দ্র সেন ব্রাহ্মসমাজ ভেঙে বেরিয়ে এসে তৈরী করলেন ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজ। আরও পরে, ১৫ মে, ১৮৭৮-এ কেশবচন্দ্র সেনের সঙ্গেও মতাদর্শের পার্থক্য দেখা দেওয়ায় কলকাতার টাউন হলে এক সাধারণ সভা ডেকে তৈরী হয় সাধারণ ব্রাহ্মসমাজ। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পিতা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের নেতৃত্বে একেশ্বরবাদী মতাদর্শের ছত্রছায়ায় গড়ে উঠেছিল এই সাধারণ ব্রাহ্মসমাজ। এর মূল ভাবনা ছিল, ঈশ্বর এক এবং অদ্বিতীয়। তিনিই ব্রহ্ম। আর ব্রহ্মের উপাসকদের মধ্যে কোনও ভেদাভেদ নেই। নেই কোনও জাতি, ধর্ম, উচ্চ, নীচ, বর্ণভিত্তিক বিভাজন।
এই ধর্ম কোনও মানুষের উপর দেবত্ব আরোপ করে তাঁর উপাসনা করে না। ব্রাহ্মরা সরাসরি ব্রহ্মের উপাসনা করেন। ব্রাহ্মসমাজের পতাকা চারটি ধর্মকেই পুনর্মিলিত করে - হিন্দুধর্ম, বৌদ্ধধর্ম, খৃষ্টধর্ম এবং ইসলাম। এই পতাকা যেমন উত্তর, দক্ষিণ, পূর্ব এবং পশ্চিমের মিলন বোঝায়, আবার ভক্তি, জ্ঞান, যোগ এবং কর্মকেও বোঝায়।
সাধারণ ব্রাহ্মসমাজের তিনজন প্রধান পুরোহিত ছিলেন, আনন্দমোহন বোস, শিবচন্দ্র দেব এবং উমেশচন্দ্র দেব। ব্রাহ্মসমাজ হিন্দুধর্মের গোঁড়ামি দূর করে এক আদি ধর্মের জায়গা থেকে বহু নিয়মনীতি নির্ধারণ করে। উনিশ শতকের শেষদিকে নবজাগ্রত হিন্দুধর্ম ক্রমশ ব্রাহ্মসমাজ আন্দোলনের বহু ধর্মীয় ও সামাজিক ধ্যানধারণা আত্মস্থ করা শুরু করে। সাধারণ ব্রাহ্মসমাজ দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সক্রিয়তায় প্রচার ও প্রসার লাভ করে। বাংলার গণ্ডী ছাড়িয়ে সারা ভারতবর্ষ জুড়ে এর ব্যাপ্তি ঘটে। ঢাকা থেকে লাহোর, সর্বত্রই তৈরী হয় ব্রাহ্মসমাজের উপসনাগৃহ।
শহর কলকাতায় ব্রাহ্মসমাজের দুটি পৃথক উপাসনালয় রয়েছে, দুটিই হেরিটেজ মর্যাদাপ্রাপ্ত। ১৮৬৮ সালে উত্তর কলকাতার অধুনা কেশবচন্দ্র স্ট্রীট-এ আদি ব্রাহ্মসমাজের উপাসনা মন্দিরের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন স্বয়ং কেশবচন্দ্র সেন। কেশবচন্দ্রের খ্রীস্টধর্মের প্রতি আকর্ষণের প্রতিফলন এই ভবনের স্থাপত্য-সৌকর্যে। হিন্দু মন্দিরের সাথে গীর্জার গঠনরীতির মিশ্রণ নজরে আসে। একদিকে যেমন রয়েছে চার্চের মতো বুরুজ, অন্যদিকে আটচালা মন্দিরের আদল। আবার ইসলামী রীতির অর্ধবৃত্তাকার আর্চও রয়েছে। মন্দিরের মতো সুউচ্চ শীর্ষে রয়েছে পতাকা।
ভেতরে আয়তাকার প্রার্থনাকক্ষ। শ্রীরামকৃষ্ণ দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে ১৮৮০ সালে কেশবচন্দ্র তাঁর এই ধারাটির নামকরণ করেছিলেন নববিধান সমাজ। পরবর্তীকালে সমাজে বিভাজনের পরে সাধারণ ব্রাহ্মসমাজের উপাসনালয় তৈরি হয় ১৮৮১ সালে কর্নওয়ালিস স্ট্রীটে। অধুনা যার নাম বিধান সরণি। ধর্মীয় গোঁড়ামীর উর্দ্ধে নতুন এই ধর্মমত প্রচারের বাড়িটি আজও দাঁড়িয়ে আছে স্বমহিমায়। যেখানে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর উপাসনায় যোগ দিয়েছেন। ব্রাহ্মসমাজের জন্য লিখে গেছেন বহু গান। যা আজ ব্রহ্মসংগীত বলে প্রচলিত। আজও এই বাড়ী থেকে ভেসে আসে ঋগবেদের মন্ত্র কিংবা গাওয়া হয় প্রার্থনা সংগীত।
‘অসতো মা সদগময়
তমসো মা জোতির্গময়
মৃত্যোর্মামৃতং গময়'
অর্থাৎ ‘অসত্য হইতে আমাকে সত্যে লইয়া যাও, অন্ধকার হইতে আমাকে আলোকে লইয়া যাও। মৃত্যু হইতে আমাকে অমৃতে লইয়া যাও’। এই মন্ত্রোচ্চারণ যে গৃহ থেকে ভেসে আসে, তার বহিরঙ্গ যেমন সুন্দর, ভেতরটিও তেমনই বাহুল্যবর্জিত, ছিমছাম। ব্রাহ্মসমাজের বিশ্বাস ও রীতি অনুযায়ী জাঁকজমহীন। সম্মুখভাগে রয়েছে চারটি গোলাকৃতি থাম, দোতলা সমান উঁচু। তাদের ক্যাপিটল গ্রীক কোরিন্থিয়ান রীতি অনুসরণে তৈরী। চারটি থাম দিয়ে তিনটি প্রবেশপথ তৈরী হয়েছে। কাঠের চিক দিয়ে খানিক ঢাকা এই পথ। উনবিংশ শতাব্দীতে নির্মিত বহু বাড়ীর ভেতরের বারান্দায় রয়েছে এই কাঠের চিক, যা কাজ করে খানিক আব্রু রক্ষায়, খানিক রোদ প্রতিরোধে।
ভেতরে রয়েছে হলঘর। সরু কলাম দিয়ে হলের ভেতরটি বিভক্ত। আইলস বেশ চওড়া, আর দুদিকে 'নেভ'-এর উপরে রয়েছে রেলিং দিয়ে ঘেরা বারান্দা। যাতে সেখান থেকেও নীচের সম্পূর্ন কার্যকলাপ নজরে আসে। হলের মধ্যে রয়েছে উপাসনার জন্য কাঠের বেঞ্চ, অনেকটাই চার্চের কায়দায়। হলের সংলগ্ন লাইব্রেরীটির বই সম্ভারের জন্য প্রশংসনীয়।
ব্রাহ্মসমাজের এই বাড়ি বর্তমানে খোলা থাকে প্রতি সন্ধ্যায় মাত্র এক ঘন্টা। তবে ব্রাহ্মসমাজ মেতে ওঠে নববর্ষের দিনটিতে, বর্ষবরণের মাধ্যমে। ব্রহ্মসংগীত মন্ত্রিত হয় সমাজের হলঘরটিতে। মাঘ উৎসব অনুষ্ঠিত হয় সমাজের প্রতিষ্ঠা দিবসে। বাদবাকি সময় আদি ব্রাহ্মসমাজের বারান্দায় নীরব রোদ্দুর খেলে। জানলার খড়খড়ি দিয়ে বাতাস ঢোকে না। ফুটপাথের অর্ধেক দোকানের প্লাস্টিকের শামিয়ানা ঢেকে দেয় ব্রাহ্মসমাজের মুখ।
তবু বিধান সরণি দিয়ে চলে যাওয়া ট্রামের ঢং ঢং ঘন্টা মনে পড়ায় সেই যুগের কথা, সেই মনীষীদের কথা... রাজা রামমোহন রায় থেকে শুরু করে বিপিনচন্দ্র পাল, কেশবচন্দ্র সেন, শিবনাথ শাস্ত্রী, সতীশচন্দ্র চক্রবর্তী, সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর, উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরি, সুকুমার রায় সহ সব বিখ্যাত মানুষজনদের যাপনকথা। এই আদি ধর্মের গীত আজও গাওয়া হয় ব্রাহ্ম ধর্মের উপাসকদের গৃহে, উপাসনা মন্দিরে -
'তোমারি গেহে পালিছ স্নেহে
তুমি ধন্য ধন্য হে...'
ব্রাহ্মদের ব্যবহৃত আরেকটি জিনিসও রয়ে গেছে এই শহরের বুকে। তা হলো একটি গ্যাস ক্রিমেটোরিয়াম। শহরে বুবনিক প্লেগে মৃতদের দাহ করতে একদা তৈরি হওয়া এই গ্যাস ক্রিমেটোরিয়ামটি পরবর্তীকালে ব্রাহ্মধর্মাবলম্বী মানুষদের মৃতদেহ সৎকারের জন্য ব্যবহৃত হতো। আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু, নেলী সেনগুপ্ত প্রমুখকে এখানেই দাহ করা হয়। পরে অনিয়মিত গ্যাস সরবরাহের অভিযোগ ওঠায় এটি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। অতীতের লোয়ার সার্কুলার রোড, বর্তমানের আচার্য জগদীশচন্দ্র বোস রোডের কাছে ক্রিমেটোরিয়াম স্ট্রীটে আজও পড়ে আছে তার ভগ্নাবশেষ।
১৯০৯ সালে বৃটিশ ভারতের প্রিভি কাউন্সিল ঘোষণা করেছিল ব্রাহ্মদের অধিকাংশ হিন্দু নন, তাঁদের নিজস্ব ধর্ম আছে। কিন্তু পরবর্তীকালে সরকার ব্রাহ্মধর্মকে সংখ্যালঘুর স্বীকৃতি দিতে অস্বীকার করে। ২০০৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে এক আদেশে ঘোষণা করা হয়, সাধারণ ব্রাহ্মধর্ম কোনও আলাদা সংখ্যালঘু ধর্ম নয়, তাই সাধারণ ব্রাহ্মসমাজের অধীনে থাকা চারটি কলেজ, যেমন আনন্দমোহন কলেজ, সিটি কলেজ, উমেশচন্দ্র কলেজ প্রভৃতি কলেজকে ‘নন মাইনরিটি কলেজ' ঘোষনা করা হয়।
তবে সংখ্যার দিক দিয়ে আজ সত্যি ব্রাহ্মসমাজের অনুসরণকারীদের সংখ্যা নগণ্য। ২০০১ সালে মাত্র ১৭৭ জন মানুষ নিজেদের ব্রাহ্ম বলে পরিচয় দিলেও ব্রাহ্মসমাজের হিসাবে কুড়ি হাজার মতন ব্রাহ্ম আছেন, যাঁরা আজও সমাজ গঠন ও সংস্কারের কাজে নিবেদিতপ্রাণ। তাঁরা শিক্ষাবিস্তার সহ বহু কাজ করে চলেছেন। মহিলা কল্যাণ, ত্রাণ কার্য, গ্রামীণ চক্ষু শিবির, পাঠাগার, অনাথদের সেবা, স্বাস্থ্য প্রকল্প, প্রকাশনা ইত্যাদি বহু কাজে আজও ব্রাহ্ম সমাজের নাম একবাক্যে উচ্চারিত হয়।