/indian-express-bangla/media/post_attachments/wp-content/uploads/2019/08/1-22.jpg)
ব্রিটিশ শাসনকালে খিদিরপুরের গুরুত্ব ছিল অপরিসীম, কারণ যোগাযাগের মাধ্যম তখন জলপরিবহণ। হুগলি নদী তখন গভীর, নাব্য। ব্রিটিশরা প্রভুত্ব করতে এসেছিল তাদের রাজধানী লন্ডন থেকে দখলীকৃত এই উপমহাদেশের রাজধানী কলকাতায়, প্রথমে সাগরপথে, তারপর হুগলী নদীপথে। শেষে নোঙর এই খিদিরপুরের ঘাটে। তাই এখানে আনাগোনা ছিল নাবিক আর মাঝিমাল্লাদের, সঙ্গে ব্রিটিশ নৌসেনারও।
তাদের জন্য গড়ে ওঠে কবরখানা। নৌসেনার স্মরণে লস্কর ওয়ার মেমোরিয়াল। তবে সবার আগে দেবতার আশ্রয়, যেখানে সবাই প্রার্থনা করেন, যাত্রা ও আগমন শুভ হোক। কিনারার সন্ধান করতে আসা জলযান দূর থেকে দেখতে পায় দেবতার আলয়, সেন্ট স্টিফেন্স চার্চ। বাতিঘর হয়ে জাহাজীদের ডাক দিত এই অ্যাংলিকান চার্চ। ৬ জানুয়ারি, ১৮৪৪ সালে আর্চডিকন টমাস ডেলট্রি-র সহযোগিতায় গভর্নর জেনারেল এডওয়ার্ড ল এটির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। প্রথমে এটি শুধু গভর্নর জেনারেল ও তাঁর পরিবারের প্রার্থনার জন্যই ব্যবহৃত হতো, পরে ১৮৭০ সালে সাধারণের জন্য খুলে দেওয়া হয়। চার্চে নাবিক, জাহাজী ছাড়াও আসতেন স্থানীয় ইংরেজ এবং প্রচুর বাঙালি, যাঁরা ধর্মান্তরিত হয়েছিলেন। তবে চার্চের সমস্ত ধার্মিক অনুষ্ঠান, প্রার্থনা ইত্যাদি ইংরাজিতেই হতো।
/indian-express-bangla/media/post_attachments/wp-content/uploads/2019/08/2-1-4.jpg)
স্বাধীনতার পর বহু ইংরেজই নিজের দেশে পা বাড়ালেন। যাত্রীবাহী জাহাজও আর ভেড়ে না খিদিরপুর ডকে। চার্চের গুরুত্ব ফুরলো। আটের দশকে চার্চ বন্ধই হয়ে গেল। ক্রমশ জরাজীর্ণ হয়ে গেল রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে। রইল ব্রিটিশ লাইব্রেরিতে সংরক্ষিত ১৮৫১ সালে ফ্রেডরিক ফিবিগ-এর দক্ষিণ পশ্চিমদিক থেকে তোলা এক রঙিন ফোটোগ্রাফ। লাইব্রেরির অনলাইন গ্যালারিতে খুঁজলে পাওয়া যাবে সে ছবি।
২০১৩ সালে নতুন উদ্যমে শুরু হলো চার্চের পুনরুজ্জীবন। অর্থসংগ্রহের জন্য সোশ্যাল মিডিয়ায় আবেদন রাখা হলো, পাঁচশো টাকা মূল্যের প্রতিটি ইটের গায়ে লেখা থাকবে দাতার নাম। ধীরে ধীরে ছিমছাম ছোট্ট চার্চ আবার আগের মতই সেজে উঠল। যদিও মেঝের মূল মার্বেল পুনঃসংস্থাপিত করা সম্ভব হয় নি। বর্তমানের মেঝেটির মার্বেল দান করেন চার্চের এক সদস্য তাঁর অকালমৃত শিশুপুত্রের স্মরণে।
৩ নং ডায়মন্ড হারবার রোডে, খিদিরপুরের সেন্ট টমাস বয়েজ স্কুলের পাশটিতে এই ছোট্টখাট্টো কিন্তু অনন্যদর্শন চার্চটি দাঁড়িয়ে আছে পাঁচিলের ঘেরাটোপে। সামনে অনেকখানি সবুজ ঘাসজমি। চার্চটি গথিক স্থাপত্যরীতি অনুসরণে তৈরী। সামনে পিনাকল (pinnacle)-সহ একটি উঁচু মিনারের মত বেল টাওয়ার। দুই-তলা লেভেলে চারদিকে গথিক (Gothic) জানলা, তাতে খড়খড়ি লাগানো কাঠের পাল্লা। টাওয়ারের দুপাশে বাট্রেসের (buttress) মত দুটি প্রোজেক্টেড দেওয়াল।
/indian-express-bangla/media/post_attachments/wp-content/uploads/2019/08/3-14.jpg)
/indian-express-bangla/media/post_attachments/wp-content/uploads/2019/08/4-9.jpg)
গোটা বাড়িটিতেই জানলার দুপাশে বাট্রেস এবং সেগুলির মাথায় একটি করে পিনাকল। গথিক চার্চটির সৌন্দর্য্য বাইরের মত ভেতরেও প্রতিফলিত। অভ্যন্তরভাগ কোন আইল বা নেভে বিভক্ত নয়। দুদিকে প্রার্থনার জন্য কাঠের বেঞ্চ। মাঝের রাস্তার শেষে অল্টার। অল্টারের পেছনের দেওয়ালে কারুকার্যময় স্টেইনড গ্লাসের কাজ।
অল্টারের দুদিকে দুটি ঘেরা ক্লসেট, সম্ভবত নানেদের জন্য তৈরি। তাঁরা এই ঘেরা জায়গার জানলা দিয়ে বাইরের লোকেদের সঙ্গে বার্তাবিনিময় করতেন। অল্টারের বাঁদিকে রয়েছে একটি ছোট পাইপ অর্গান, যেটি আজও প্রার্থনায় বাজানো হয়।
/indian-express-bangla/media/post_attachments/wp-content/uploads/2019/08/5-8.jpg)
/indian-express-bangla/media/post_attachments/wp-content/uploads/2019/08/6-4.jpg)
/indian-express-bangla/media/post_attachments/wp-content/uploads/2019/08/7-4.jpg)
অল্টারের আরেক দিকে রয়েছে কারুকার্যময় শ্বেতপাথরের পালপিট, যেখান থেকে যাজক ধর্মীয় বার্তা দেন। অন্যদিকে একটি দন্ডের উপরে বিশাল এক ধাতব বাজপাখি। চার্চের দেওয়াল জুড়ে রয়েছে পুরনো এবং নতুন ফলক। পুরানো ফলকগুলি সবই ইংরেজ নাবিকদের বা সেই সব ইউরোপিয়ানদের, যাঁরা সমুদ্রযাত্রার মাঝে প্রাণ হারিয়েছেন কিংবা নদীতেই মৃত্যু ঘটেছে ঝড়-তুফানে বা অজ্ঞাত কারণে।
তেমনই একটি প্রাচীন ফলক 'খাইবার' নামের একটি জাহাজের থার্ড অফিসার এডগার বেলহাউসের, যিনি হুগলী নদীতে ডুবে গিয়েছিলেন ১১ মে, ১৮৯০ সালে। তাঁর সম্মানে স্মৃতিফলক ঢাকা আছে জাহাজের নোঙর এবং শিকল দিয়ে। আবার সুদূর উত্তমাশা অন্তরীপে (কেপ অফ গুড হোপ) ৫ মে, ১৮৫১ সালে মারা যান জেমস হেনরি জনস্টন। অজানা অচেনা জাহাজীদের স্মৃতিফলক চার্চের দেওয়ালে গেঁথে রেখে গেছেন তাঁদের সতীর্থরা। তুলনামূলক নতুনগুলিতে পাওয়া যায় ভারতীয়দের নামও।
/indian-express-bangla/media/post_attachments/wp-content/uploads/2019/08/8-2.jpg)
/indian-express-bangla/media/post_attachments/wp-content/uploads/2019/08/9-3.jpg)
/indian-express-bangla/media/post_attachments/wp-content/uploads/2019/08/10-3.jpg)
আজও রবিবার জমায়েত হয়, পাইপ অর্গান বাজে, সেন্ট টমাস স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা, স্থানীয় খ্রিষ্টান সম্প্রদায়, প্রার্থনায় সামিল হন। স্মরণ করা হয় সেইসব জাহাজীদের, যাঁদের একদিন সলিলসমাধি হয়েছিল। আর রকেটের মত ছুঁচোলো পিনাকল উঁচিয়ে সেন্ট স্টিফেন্স চার্চ দাঁড়িয়ে থাকে সুদূরে পাড়ি দেওয়ার ভঙ্গিমায়।
খিদিরপুর ডকের অদূরে, এখন যেখানে সার্কুলার রেলের ষ্টেশন, তার কাছে রয়েছে ১৮২০ সালে তৈরি হওয়া সেন্ট স্টিফেন সিমেট্রি। প্রথমে লোহার গেট, তারপরে মূল প্রবেশপথ। ত্রিভুজাকৃতি দেওয়ালের গায়ে লেখা, 'Blessed are the dead who died in the Lord'।
ঢুকেই চাইনিজ প্যাগোডার মতো গেট, তার নিচে যীশুর মুর্তি, তারপর পথের দুধারে সার সার চৌকো সমাধিবেদী। ভিতরে মূলত নাবিকদের কবর। কেউ বা নৌসেনা, কেউবা শুধুই নাবিক। তাই দেখা যায় কবরের ফলকে তৈরি করা নোঙর। তাই তো এটিকে 'seaman cemetery'-ও বলে।
/indian-express-bangla/media/post_attachments/wp-content/uploads/2019/08/11-2.jpg)
/indian-express-bangla/media/post_attachments/wp-content/uploads/2019/08/12-3.jpg)
/indian-express-bangla/media/post_attachments/wp-content/uploads/2019/08/13-2.jpg)
তবে অধিকাংশ ফলকের লেখাই আবছা, কোনোটা বা নিশ্চিহ্ন। এখনও এখানে কবর দেওয়া হয় স্থানীয় খ্রিষ্টানদের। পুরাতনের ওপরেই নতুনদের ঠাঁই হয়। মাত্র দু-একটি বেদীতে মার্বেল ফলক চোখে পড়ে। ঢুকেই যে বিখ্যাত মানুষটির কবর নজরে আসে, তিনি রেভারেন্ড মধুসূদন শীল। ১৮৩৬ সালে তিনি খৃষ্টধর্মে দীক্ষিত হন। তখনকার বাঙালী খ্রিষ্টান সমাজে এক অগ্রগণ্য ভূমিকা ছিল তাঁর। সমাধিটিতে তিনি একা নন, রয়েছেন তাঁর কন্যাও। আবার এই সেন্ট স্টিফেন সিমেটারিরই আর একদিকে শায়িত আছেন মাদার টেরিজার মিশনারিজ অব চ্যারিটির সিস্টাররা।
/indian-express-bangla/media/post_attachments/wp-content/uploads/2019/08/14-1.jpg)
/indian-express-bangla/media/post_attachments/wp-content/uploads/2019/08/15.jpg)
খিদিরপুরের একদম গঙ্গার তীর ঘেঁষে রয়েছে ভারতীয় নৌবাহিনীর দপ্তর, তাদের কর্মকান্ডের জন্য বাড়িঘর, অফিস, ইত্যাদি। জনসাধারণের প্রবেশ খানিকটা হলেও সীমাবদ্ধ। এখানে মেরিন হাউস পার করে বিদ্যাসাগর সেতুর কোল ঘেঁষে রয়েছে ১০০ ফুটের একটি সৌধ। সেতুর ওপর থেকে রাতের বেলায় আলোকিত যে স্তম্ভটি বিস্ময় জাগায়, তার পোষাকী নাম লস্কর ওয়ার মেমোরিয়াল (Lascar War Memorial)।
হেস্টিংস এলাকার নেপিয়ার রোডে অবস্থিত এই যুদ্ধের স্মৃতিসৌধটি লস্কর অর্থাৎ জাহাজীদের জন্য। এই জাহাজীরা সকলেই প্রথম বিশ্বযুদ্ধে নিযুক্ত নাবিক। মোট ৮৯৬ জন। এঁরা সবাই ভারতীয়, মূলত বাংলা, আসাম, এবং উত্তর ভারতের লোক। এবং সকলেই ব্রিটিশ রয়্যাল নেভির হয়ে যুদ্ধ করতে গিয়ে নিহত হন ১৯১৪-১৯১৮'র প্রথম বিশ্বযুদ্ধে।
/indian-express-bangla/media/post_attachments/wp-content/uploads/2019/08/17-1.jpg)
/indian-express-bangla/media/post_attachments/wp-content/uploads/2019/08/18-1.jpg)
এই সৌধ তৈরি শুরু হয় ১৯২০ সালে। ইন্দো-মুসলিম স্থাপত্যরীতিতে নির্মিত এই সৌধের স্থপতি উইলিয়াম ইনগ্রাম কের। লস্কর মেমোরিয়াল তৈরির জন্য তিনি পাঁচশ টাকা পুরস্কার পেয়েছিলেন। চিতোরের চিতোর মিনারের সঙ্গে সাদৃশ্য মেনে এটির বহিরঙ্গের সৌন্দর্যায়ন করা হয়েছে। উঁচু চৌকো প্লিন্থের ওপর চৌকো স্তম্ভ। একটু উঁচুতে রয়েছে একটা বড় প্রোজেক্টেড কার্নিস।
চারদিকে চারটি মুঘল অলিন্দের মতো অংশ, তাতে রয়েছে কার্নিস, জাফরি, এবং আরো কিছু কারুকার্য। ওপরেও দুটি স্তরে চারদিকে দুটি প্রোজেক্টেড কার্নিস আছে। একদম শীর্ষে আছে চার কোণে চারটি মিনারেট। মাঝে একটি বড় ডোম বা গম্বুজ। শুরুর দিকে একটি স্তরে রয়েছে ঢেউয়ের মত কিছু লাইন। যা সব মিলিয়ে সমুদ্রের জল আর জাহাজের কথাই মনে করায়। নির্মাণ শুরুর চার বছর পর ৬ ফেব্রুয়ারি, ১৯২৪ সালে এটি উদ্বোধন করেন বাংলার তৎকালীন গভর্নর এবং পরবর্তীকালে ভারতের অস্থায়ী ভাইসরয় লর্ড লিটন।
/indian-express-bangla/media/post_attachments/wp-content/uploads/2019/08/19.jpg)
/indian-express-bangla/media/post_attachments/wp-content/uploads/2019/08/20.jpg)
পরবর্তীকালে বহুদিন এটি আগাছার জঙ্গলে হারিয়ে গিয়েছিল। প্রাতঃভ্রমনে গিয়ে প্রথম এটি লক্ষ্য করেন কমোডোর বি কে মহান্তি। তখন ১৯৯৪ সাল। পুনরায় এটিকে সংস্কার ও সুসজ্জিত করা হয়। রাতে আলোকিত করার ব্যবস্থা হয়। ৭ ডিসেম্বর, ১৯৯৪ পুনর্বার উদ্বোধন করেন পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন গভর্নর এ এল ডায়াস। নেভাল বেস আইএনএস নেতাজী সুভাষের ৪০ তম জন্মবার্ষিকীতে।
বর্তমানে কলকাতার দ্বিতীয় উচ্চতম মনুমেন্ট এটি। মেমোরিয়ালের তিনটি ফলক জানিয়ে দেয় এর ইতিহাস। এখানে INTACH-এর কলকাতা শাখার একটি অনুষ্ঠান আয়োজিত হয় ২০১২ সালের ৪ ডিসেম্বর, ন্যাশনাল নেভি দিবসে। তাতে উপস্থিত ছিলেন মেমোরিয়ালের স্থপতি উইলিয়াম কের-এর ছেলে জেমস কের। বি কে মহান্তিও উপস্থিত ছিলেন।
নদীর নাব্যতা কমে এলেও খিদিরপুরের এই তিন স্থান যেন আজও ঘাটের কাছে অতীতের গল্প বলে ছলাৎছল!