কলকাতার মেসবাড়ির ইতিহাসে বর্ণময় চরিত্রদের যা সম্ভার, তার জুড়ি মেলা ভার। ব্যোমকেশ থেকে ঘনাদা, সকলেরই ঠিকানা ছিল কলকাতার মেসবাড়ি। অর্থাৎ প্রধানত অবিবাহিত, চাকরিরত বা অন্য কোনোভাবে কর্মরত, শহরের বাইরে থেকে আসা পুরুষদের মাথা গোঁজার ঠাঁই।
আজ গেলে দেখা যায়, সরু, লম্বা, আধো-অন্ধকার একটা গলি। গলি দিয়ে সোজা ঢুকে গেলেই ইটের পাঁজর বের করা সিঁড়ি। এর পাশেই সারি সারি ছোট্ট রুম। এক একটা বাড়িতে ১০-১২টা করে ঘর, প্রত্যেক ঘরে একাধিক চৌকি পাতা। চুনকাম করা দেয়ালে অজস্র হিজিবিজি। হ্যাঙ্গারে জামা প্যান্ট। দু-তিনতলা বাড়িগুলোর কোথাও পলেস্তারা খসে পড়েছে, আবার কোথাও বারান্দা উধাও। বেরিয়ে রয়েছে লোহার কাঠামো। তবে কলকাতার মেসবাড়ির শুরুটা ঠিক এমনই ছিল কি?
তখন প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শেষ। শুরু শহরের মেসবাড়ির কালচার। শিক্ষিত বাঙালি কাজের খোঁজে জেলা থেকে আসতে শুরু করেছেন কলকাতায়। অবশ্য এর আগেও কেরানিগিরির সুবাদে গ্রাম থেকে কলকাতা মুখো হয়েছিলেন কিছু নব্যযুবক। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর কলকাতায় মেসবাড়ির সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় মাথার উপর ছাদের আর চিন্তা রইল না। এইসব মেসবাড়ি কেবল ইট-কাঠের কাঠামো কিন্তু ছিল না। ছিল কয়েক প্রজন্ম, অনেকটা ইতিহাস, গোটা একটা সংস্কৃতি নিয়ে কলকাতার বুকে গড়ে ওঠা নতুন এক অধ্যায়ের সূচনা। যার ছিটেফোঁটা নস্টালজিয়াও দিতে পারে না হালের 'পেয়িং গেস্ট' বা 'পিজি' প্রথা।
চল্লিশ ও পঞ্চাশের দশকে প্রধানত আমহার্স্ট স্ট্রিট, মুক্তারামবাবু স্ট্রিট, কলুটোলা স্ট্রিট, কলেজ স্ট্রিট, মানিকতলা ও শিয়ালদহ এলাকাতেই ছিল মেসের রমরমা। তার কারণ, পা বাড়ালেই ছিল স্কুল, কলেজ, অফিস, আদালত। সেকালে প্রতিটি মেসবাড়ির নিজস্ব চরিত্র ছিল। মেজাজ, খাওয়া-দাওয়া, শখ-আহ্লাদের বিচারে যতই ব্যক্তিবিশেষের তফাৎ থাকুক না কেন, মাসের পর মাস, বা হয়ত বছরের পর বছর, একই ছাদের নিচে মিলেমিশে থাকার অভ্যাসে অজান্তেই একসুরে বাঁধা পড়তেন বাসিন্দারা।
তবে একালে এর একটু ব্যতিক্রম ঘটেছে। হাল ফ্যাশানের বঙ্গসন্তানদের পছন্দ 'পিজি'। পিজিতে নেহাতই ঘর শেয়ার করা, আর কিছু শেয়ার করা নয়। ফলস্বরূপ শুশ্রূষার অভাবে বয়সের ভারে মাথা নুইয়েছে মেসবাড়ি। তবে গল্পের জন্যে ফিরতেই হবে অতীতে। কোনও এক দুপুরে হ্যারিসন স্ট্রিটের (বর্তমানে মহাত্মা গান্ধী রোড) প্রেসিডেন্সি বোর্ডিংয়ে শরদিন্দুর ব্যোমকেশের সঙ্গে অজিতের আলাপ। তদন্তের প্রয়োজনে মেসের হট্টরোলেই আত্মগোপনের সুবিধা খুঁজে নিয়েছিলেন ছদ্মবেশী দুঁদে গোয়েন্দা। উত্তর কলকাতার মেসবাড়িগুলোর তখন স্বর্ণযুগ। এই প্রেসিডেন্সি বোর্ডিংয়ের জানলা দিয়ে ট্রাম দেখার নেশা ছিল জীবনানন্দ দাশের। এখানেই তো খুঁজে পেয়েছিলেন 'বনলতা সেন'।
ঠিক তেমনই শিব্রাম চক্কোত্তি এই মেসেই খুঁজে পেয়েছিলেন আরাম। যে মেসবাড়ি সম্পর্কে তিনি বলেছিলেন, মুক্তারামে থেকে, তক্তারামে শুয়ে, শুক্তারাম খেয়েই তিনি শিবরাম হয়েছেন। ঠনঠনিয়া কালিবাড়ির রাস্তায় এসে, যে কোনও কাউকে শিবরাম চক্রবর্তীর মেসবাড়ি জিজ্ঞেস করলেই সোৎসাহে দোতলার একটি ঘর দেখিয়ে দেন। ১৩৪, মুক্তারামবাবু স্ট্রিটের 'ক্ষেত্র কুঠি'। এখানেই একলা থাকতেন তিনি। ভাগ্য ভালো হলে দেওয়ালে লেখাও নজরে আসতে পারে। শোনা যায়, শিবরাম কখনও দেওয়াল রং করতে দিতেন না। সেখানে লেখা থাকত জরুরি বহু জিনিস। কারণ, খাতার মতো দেওয়ালের হারিয়ে যাওয়ার ভয় নেই! রাবড়ির প্রতি ছিল তাঁর তীব্র আকর্ষণ। আর একমাত্র সেই টানেই নাকি হপ্তায় দু-একদিন সাধের 'মুক্তারামের তক্তারাম' ছাড়তে বাধ্য হতেন তিনি।
পুরনো কলকাতা। বৃষ্টিভেজা রাস্তা। ট্রাম। কফি হাউস। রাইটার্স বিল্ডিং। শহর চষে পাঞ্জাবির পকেটে শেষ চারমিনার বাঁচিয়ে ঘরে ফেরা। নিজের ঘর না থাকলেও সে সময় বাঙালির ছিল মেসবাড়ি।
'সাড়ে চুয়াত্তর' থেকে 'বসন্ত বিলাপ'। বাংলা সিনেমায় ব্যাচেলরদের নিয়ে ছবি বানাতে গিয়েও পরিচালকরা গল্পের মধ্যে নিয়ে এসেছেন মেসবাড়ি। সাহিত্য বা খেলাধুলো নয় কেবল, রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটেও সেকালের শহরে মেসবাড়ির অবদান ছিল যথেষ্ট। স্বাধীনতা সংগ্রামের বহু খসড়া বহু বিপ্লবীর আস্তানা ছিল কলকাতার মেসবাড়ি। চল্লিশের দশকের দিনগুলোর উত্তেজনা কিংবা স্বাধীনতা-পরবর্তী কলকাতায় সত্তরের দশকের দিন বদলের স্বপ্ন দেখা তরুণদের দল, মেসবাড়ি সাক্ষীkolkata mess rent ছিল সব কিছুরই।
সময়টা বদলে গেছে। মেসবাড়ির সংস্কৃতি বদলে হয়েছে পিজি। অনেক জায়গায় সাবেকি মেস ভেঙে তৈরি হয়েছে আবাসন। এখন যে ক'টা টিকে আছে, সেই আন্তরিকতা নেই বললেই চলে বোর্ডারদের মধ্যে। তক্তপোষ পরিণত হয়েছে সিঙ্গল বেড-এ। তবুও এখনও কোনও এক মেসবাড়ির পাশ দিয়ে ধুঁকতে ধুঁকতে চলা ট্রামের ঘন্টির শব্দ যেন ব্যোমকেশ আর অজিতের বন্ধুত্বের কথা মনে করিয়ে দেয়।