ধরা যাক এক মহিলা কলকাতায় ফিরছেন বহুদিন পর, মেট্রো থেকে নেমে দেখলেন তাঁর বাবা অথবা দাদা অপেক্ষা করছেন। আবেগ ধরে রাখতে না পেরে সে ছুট্টে গিয়ে জড়িয়ে ধরলেন তাঁদের। সর্বনাশ করে ফেললেন! দেখবেন একদল সিনিয়র সিটিজেন ছুটে এসে চারপাশ থেকে ঘিরে ধরে পেটাতে শুরু করবেন আপনাদের। কারও মুখে পরিতৃপ্তির হাসি, কেউ বলছেন 'হচ্ছে হচ্ছে, দারুণ হচ্ছে, ফাটিয়ে দে শালাদের, মুখে মুখে তর্ক, অ্যাঁ? পাবলিক প্লেসে বেলেল্লাপনা করা হচ্ছে'? দেখবেন কেউ আবার এমন রসালো মুহূর্ত ক্যামেরাবন্দি করছেন।
সকালে উঠেই 'দমদম মেট্রোয় আলিঙ্গনের অপরাধে গণপিটুনি'র খবরটা হোয়াটসঅ্যাপের ইনবক্সে পেয়েছিলাম। ছবির মুখগুলো জুম করে করে দেখলাম অনেকবার। নাহ্, ওদের মধ্যে কেউ আমার বাবা বা জেঠু নন তবে ওঁরা সেই তিলোত্তমারই লোক, যে শহরটা আমায় ভালবাসতে শিখিয়েছিল। যে শহরের আয়োনোস্ফিয়ারে আজও রবি ঠাকুর বিরাজমান, চেনা গলিপথে হেঁটে গেলে ভেসে আসে সপ্তপদীর 'এই পথ যদি না শেষ হয়'। যে শহরে প্রেমের কানন বলতে নন্দনকেই বোঝানো হয়েছে আজীবন। ভিক্টোরিয়ার ঘোড়া গাড়ি থেকে ময়দানের ঝালমুড়ি, বৃষ্টিভেজা ট্রাম রাইড, যে শহরে প্রতিটি নিউরোনে বইছে প্রেমের হ্যালোটিউন। চেনা সেই শহরের আকাশটাই অপ্রেমের দূষণে ভরে গিয়েছে আজ। সূর্য ওঠেনি, মেঘ করেছে। কীসের মেঘ, তা জানা নেই, শুধু ভয় করছে, কষ্ট হচ্ছে ভীষণ। দম বন্ধ হয়ে আসছে। আমার শহরেও আজ বস্তাপচা নৈতিকতার বিষ জারিত হয়ে মাথার ওপর অ্যাসিড বৃষ্টির মেঘ জমছে পরতে পরতে। যেকোনও সময় ঝমঝমিয়ে নেমে পুড়িয়ে দিতে পারে সব।
মেট্রোর গণপিটুনির ঘটনা প্রসঙ্গে কয়েকটা প্রশ্নের উত্তর পাচ্ছিনা কিছুতেই। যে বা যাঁরা ছবিটা তুললেন তাঁরা কি ফোন রেখে একবারও ছেলে মেয়ে দুটোকে বাঁচানোর কথা ভেবেছিলেন? যাঁরা মারলেন, তাঁরা দিনের শেষে কোন ঠিকানায় ফিরছিলেন? কষাইখানায়? ভাগাড়ে? না পরিবারের কাছে? যে স্নেহের বাসায় পরিজনেরা অপেক্ষা করে থাকেন খাবার টেবিলে। কী জানি! তবে ছবিই যখন উঠল তখন আমিও চাই, হ্যাঁ মনে প্রাণে চাই ছবিগুলো ছেয়ে ফেলুক স্যোশাল মিডিয়া। যাতে ওই নৈতিক দারোগাদের পাড়া প্রতিবেশী এবং আত্মীয়স্বজন অতিষ্ট করে তোলেন। লজ্জায় মুখ না দেখাতে পারেন বহুদিন।
আরও পড়ুন: অর্ধেক আকাশে সন্তোষ! কেন?
আপনাদের বলছি, হ্যাঁ আপনাদেরই। আপনাদের রক্ষণশীল চোখে বর্তমান প্রজন্ম অশালীন, অসভ্য এবং উদ্ধত। অথচ সিনেমা হলে টাকা দিয়ে বেড সিন দেখতে যেতে আপনাদের লজ্জা হয় না। লুকিয়ে স্মার্টফোনে নীলছবি দেখতে লজ্জা হয় না। প্রকাশ্য রাস্তায় জিপার খুলতে লজ্জা হয় না। শুধু কোনও প্রেমিক যুগলের প্রেমের বহিঃপ্রকাশ দেখলেই লজ্জা করে? বেলেল্লাপনা মনে হয়? তাহলে সন্তান সন্ততিকে নিয়ে প্রকাশ্যে বেরোবেন না। ওরাও তো আপনার অথবা ছেলে-মেয়ের ক্ষণিক আবেগেরই প্রকাশমাত্র । লজ্জা করছে? হ্যাঁ লজ্জা পাওয়াই ভাল। এটা আপনাদের লজ্জা পাওয়ারই সময়।
ভিড় মেট্রোয় একা মেয়েদের দেখলে অতর্কিতে মেয়েটির শরীর ছুঁয়ে স্বর্গীয় সুখ অনুভব করতে কারও নৈতিকতায় বাধে না। কিন্তু ভিড়ের মধ্যে প্রেমিক যুগলকে সামান্য ঘনিষ্ঠ হতে দেখলেই সমস্ত নৈতিকতা, বিচার-বুদ্ধির সুইচ অন করে ঝাঁপিয়ে পড়া যায় ওদের ওপর। আসুন এভাবেই ভালবাসাকে খামচে খুবলে খেয়ে নিই। টুঁটি টিপে শেষ করে দিই প্রেমের সমস্ত বহিঃপ্রকাশকে।
'একলা রাস্তায় মেয়ে ধর্ষণ হয়ে যেতে পারে', বাবা-মা এতদিন এমন একটা আশঙ্কায় ভুগতেন। আজ থেকে আমি ভয় পাব। হাসতে ভয় পাব, ভয় পাব আমার সহকর্মী মেয়েটির হাত ধরে রাস্তা পার হতে, ছেলে বন্ধুদের চরম আবেগে রাস্তায় জড়িয়ে ধরে কাঁদতেও ভয় পাব। অ্যাঙ্কেল লেংথ জিন্স পরে মেট্রোয় উঠতে ভয় পাব। কারণ? আমার হাসিতে কারও হাড়-মাংস জ্বলে যেতে পারে, সহকর্মীর হাত ধরতে দেখলে আমায় লেসবিয়ান ভেবে মারা হতে পারে, কিংবা বেরিয়ে থাকা পা-এর অংশটুকু দেখে কোনও দাদুর বিশেষ অনুভূতি হতে পারে। তাই আজ থেকে শুধু আমি না। এই শহরে প্রতিটি বর্তমান প্রজন্মের প্রতিনিধিরা ভয় পাবে প্রতিনিয়ত।
আরও পড়ুন: পৌরুষ! আর চাই না
ঠিক, ভুল বিচার করতে গিয়ে, নিজেদের মধ্যেকার নীতি পুলিশটাকে তুলে ধরতে গিয়ে আমরা বড় উদ্ধত হয়ে পড়ছি, ভুল করে ফেলছি অসংখ্য। ভাগাড়ের পচা মাংসের চেয়েও বিষাক্ত হয়ে পড়ছি আমরা। কারণটা অধরা। শুধু অনেকদিন ধরেই টের পাচ্ছি আমার শহরটা ক্রমশ প্রেমহীন হয়ে পড়ছে। এবং এই মহামারী মুক্ত করবার উপায় বিশ্বের কোনও সংশোধনাগারে নেই। আমি ঠিক জানি না মার খাওয়ার পর ছেলে-মেয়ে দুটি আদৌ বাড়ি ফিরেছে কিনা, কিন্তু বিশ্বাস করুন এ এক অশনি সংকেত। এটা শেষ নয়। বরং, একটা শুরু। চরম অরাজকতার।