শনিবার, অর্থাৎ গতকাল, টোকিয়োতে অনুষ্ঠিত হলো রাগবি বিশ্বকাপের ফাইনাল। ইংল্যান্ডকে ৩২-১২ হারাল দক্ষিণ আফ্রিকা। কলকাতায় কতজন দেখেছেন জানা নেই, খুব বেশি হওয়ার কথা নয়, যদিও কলকাতার সঙ্গে রাগবির যোগাযোগ দীর্ঘদিনের। আসলে দুনিয়ার একটা বড় অংশে প্রভূত জনপ্রিয় ফুটবলের ধাঁচের এই খেলা (যাতে হাত এবং পা দুইয়েরই ব্যবহার আছে) ভারতে তেমন জায়গা করে নিতে পারে নি কোনোকালেই। কাজেই কলকাতা বা বাংলা কেন, ভারতেরই বেশিরভাগ মানুষ সম্ভবত জানেন না, রাগবি ব্যাপারটা ঠিক কী।
অথচ উত্তরবঙ্গের এক প্রত্যন্ত গ্রাম সরস্বতীপুরের ছেলেমেয়েরা আগাগোড়া মন দিয়ে দেখেছে শনিবারের ফাইনাল। এতেই আশ্চর্য হবেন না। বছর কয়েক আগে পর্যন্ত আক্ষরিক অর্থেই এরা জানত না, 'রাগবি' খায় না মাথায় দেয়। আজ এদের মধ্যে কেউ কেউ রীতিমত জাতীয় স্তরে রাগবি খেলছে।
আরও আছে। চলতি বছরের জুন মাসে চণ্ডীগড়ে অনুষ্ঠিত ন্যাশনাল অনূর্ধ্ব-১৮ রাগবি সেভেন্স চ্যাম্পিয়নশিপে অংশ নেয় বাংলার ছেলে এবং মেয়েদের দল, প্রযত্নে বেঙ্গল রাগবি ইউনিয়ন (বিআরইউ), সহায়তায় শহরের সুপ্রতিষ্ঠিত এনজিও ফিউচার হোপ ইন্ডিয়া। আরও একটি জরুরি ভূমিকা পালন করে শহরেরই ১৫ বছরের পুরনো রাগবি ক্লাব জাঙ্গল ক্রোজ, যাদের কথায় পরে আসছি।
ও, এই ফাঁকে বলে রাখা ভালো, বাংলার মেয়েরা কিন্তু আপাতত অনূর্ধ্ব-১৮ বিভাগে জাতীয় চ্যাম্পিয়ন, এবং যে দুটি দল চণ্ডীগড় যায়, তাদের মধ্যে ছিলেন কুল্যে ২৪ জন খেলোয়াড়, দুজন কোচ, দুজন ম্যানেজার, এবং দুজন বিআরইউ আধিকারিক। নেহাত ফেলনা নয়।
মোটামুটি মে থেকে সেপ্টেম্বর মাসের মধ্যে যদি সিসিএফসি (ক্যালকাটা ক্রিকেট অ্যান্ড ফুটবল ক্লাব) মাঠ, অথবা আমেরিকান সেন্টারের উল্টোদিকে জাঙ্গল ক্রোজের মাঠে যান, দেখবেন কী পরম উৎসাহে রাগবি প্র্যাকটিস করছে একঝাঁক ছেলেমেয়ে। আরও মজার ব্যাপার হলো, এদের মধ্যে অনেকেই আসে রাজ্যের বিভিন্ন জেলা থেকে, যেখানে রাগবির কোনও চলই ছিল না এতদিন।
বিআরইউ-এর সভাপতি লব ঝিঙ্গন জানান, কলকাতাতেই ভারতে প্রথম রাগবি খেলা হয়, সৌজন্যে ১৮৭১ সালে অনুষ্ঠিত ইংল্যান্ড বনাম স্কটল্যান্ড-ওয়েলস-আয়ারল্যান্ডের ম্যাচ। কিন্তু যেহেতু ক্রিকেটের মতো সারাবছর রাগবি খেলা সম্ভব নয়, এবং ক্রিকেটের অধিক জনপ্রিয়তার ফলে খেলার মাঠ পাওয়াই দুষ্কর, রাগবি বরাবরই ভারতে অবহেলিত। "কোথায় দৈত্যাকার বিসিসিআই, আর কোথায় আমাদের ছোট্ট রাগবি ইউনিয়ন," হাসতে হাসতে বলেন ঝিঙ্গন।
কিন্তু সেই দৈন্য বোধহয় এবার ঘুচছে। ঝিঙ্গন যেমন বললেন, "এশিয়ান গেমসে খেলা হচ্ছে রাগবি, কলকাতায় সেপ্টেম্বর মাসে অনুষ্ঠিত হয়ে গেছে অল ইন্ডিয়া অ্যান্ড সাউথ এশিয়া কাপ, এবং সবচেয়ে বড় কথা, স্কুল স্তরে বাচ্চাদের রাগবিতে আনার চেষ্টা হচ্ছে। যে কোনও খেলার বিকাশেই ছোটদের অংশগ্রহণ খুব জরুরি।" এখনও অর্থকরীভাবে ঠিক মজবুত হয়ে ওঠে নি রাগবি সংগঠনগুলি, তবে কিছু পৃষ্ঠপোষক এগিয়ে আসছেন, একথাও জানান তিনি।
বিআরইউ-এর কোষাধ্যক্ষ তথা ফিউচার হোপের সিইও সুজাতা সেন বলেন, "গত বছরও জাতীয় অনূর্ধ্ব-১৮ টুর্নামেন্টে অংশ নেয় ২২টি রাজ্য, এবং এশিয়া রাগবি ইউনিয়নের সভাপতি বর্তমানে একজন ভারতীয়। সবচেয়ে বড় কথা, এই মুহূর্তে বিআরইউ-এর কাজ হচ্ছে রাজ্যের জেলায় জেলায়, স্কুলে স্কুলে ছড়িয়ে পড়া।"
যেসব ছেলেমেয়ে এখন অনূর্ধ্ব-১৫ বা অনূর্ধ্ব-১৮ খেলছে, তাদের অনেকেই অত্যন্ত দরিদ্র পরিবার থেকে আসা। অনেকের পরিবার বলতে আদৌ কিছু নেই। এদের কাছে রাগবি শুধু একটা খেলা নয়, বলেন সুজাতা। নিজেদের আত্মবিশ্বাস, মূল্যবোধ, এবং জীবনবোধ গড়ে তোলার উপাদানও বটে। এই টানেই বর্ধমান থেকে রোজ কলকাতায় অনুশীলন করতে আসে প্রীতি হালদার, শিলিগুড়ি থেকে একদল মেয়ে কলকাতায় থেকে কঠোর পরিশ্রম করে প্র্যাকটিসে, বা ছেলেদের টিমের কোচ সঞ্জয় আসেন ব্যারাকপুর থেকে।
জাঙ্গল ক্রোজের প্রতিষ্ঠাতা পল ওয়ালশ
এবার আসা যাক জাঙ্গল ক্রোজের কথায়। বছর কুড়ি আগে কলকাতায় এই ক্লাবের প্রতিষ্ঠা করেন ব্রিটিশ কূটনীতিক পল ওয়ালশ, মূলত দুঃস্থ পরিবারের ছেলেদের জন্য। শনিবার ব্রিটিশ ডেপুটি হাই কমিশনে বসে বিশ্বকাপ ফাইনাল দেখতে দেখতেই পল জানালেন, কীভাবে সেই উদ্যোগ কলকাতা ছাড়িয়ে আজ ছড়িয়ে পড়ছে বাকি রাজ্যে, সরস্বতীপুর যার প্রথম ধাপ। এবং কীভাবে গ্রামের মেয়েরা ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে পড়েছে রাগবির সঙ্গে।
তাঁর কথাতেও পাওয়া যায় সুজাতার বক্তব্যের প্রতিধ্বনি, "রাগবি খেললেই যে পেশাদার খেলোয়াড় হতে হবে, তার কোনও মানে নেই। একবার ভাবুন এই ছেলেমেয়েগুলোর কথা। কয়েক বছর আগেও রাগবি শব্দটাই জানত না, আজ রাগবি খেলতে তারা দুবাই যাচ্ছে, জাপান যাচ্ছে - আমাদের কলকাতায় জরজিয়াডি কাপে ভারতের জাতীয় দলকে আরেকটু হলে হারিয়ে দিচ্ছিল জাঙ্গল ক্রোজের মেয়েরা। পরবর্তীকালে পেশাদার রাগবি না খেললেও, যে এক্সপোজার এবং আত্মবিশ্বাস তারা পাচ্ছে জীবনের সব ক্ষেত্রেই, কোনোদিন ভেবেছিল কেউ?"
"আমরা দেখছি, মেয়েরা ছেলেদের চেয়ে অনেক বেশি ডিসিপ্লিন্ড, অনেক কমিটেড," বলছেন ঝিঙ্গন। সুজাতা যোগ করছেন, "আমাদের আন্ডার-ফিফটিন দল সিঙ্গাপুরে গিয়ে যা দক্ষতা দেখিয়েছে, সবাই অবাক, বিশেষ করে ওদের ট্যাকলিং-এর বহর দেখে।"
অতএব ধরে নেওয়া যায়, এরাজ্যে অন্তত রাগবির ভবিষ্যৎ উজ্জ্বলতর হচ্ছে। এখনই বিশ্বমানের কথা না ভাবলেও, স্বপ্ন দেখতে বাধা নেই।