Advertisment

সকাল থেকে রাত পর্যন্ত সঙ্গী ঢোল, নিজের দুনিয়ায় মগ্ন ছ'বছরের রাঘব

দাদু ব্যান্ড পার্টিতে ঢোল বাজান। রাঘবকে দু'বছর বয়স থেকে একটু ভালোমন্দ খাওয়ানোর জন্যে সঙ্গে করে নিয়ে যেতেন বিভিন্ন অনুষ্ঠানে। বাড়ি ফিরে দুটো কাঠি নিয়ে ভাঙ্গা টিনের বাক্সে ঢোল বাজানোর চেষ্টা করতো ছোট্ট রাঘব।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
kolkata dhol player viral

বাজনায় মগ্ন রাঘব। ছবি: শশী ঘোষ

"পাড়ার ছোট্ট পার্ক, ঘাস নেই আছে ধুলো/ ঘাসের অভাব পরোয়া করে না সবুজ বাচ্চাগুলো" কবীর সুমনের এই গানের সঙ্গে অদ্ভুত মিল পাওয়া যায় সন্তোষ মিত্র স্কোয়ারের। মাস দুয়েক আগে এখানেই অধিষ্ঠিত ছিলেন সোনায় মোড়া দুর্গা ঠাকুর। মাঠের চারপাশে এখনও ছড়িয়ে সেই পুজোরই প্যান্ডেলের কাঠামো। সকাল ১০টা, অফিস টাইম। সন্তোষ মিত্রের মূর্তির অপর দিকে মাঠ, তার মাঝে পিচ ঢালাই রাস্তা। সেখান দিয়ে ছুটছেন নিত্য অফিসযাত্রীরা।

Advertisment

আচমকা সেই মাঠ থেকেই ভেসে আসে ফ্যাশফ্যাশে ফাটা ঢোলের শব্দ, যে শব্দে এই অকালেও যেন ফুটে ওঠে কাশফুল। উৎস খুঁজতে গিয়ে নজর পড়ে বছর ছয়েকের এক খুদের ওপর। ছোট্ট ঢোল নিয়ে আনমনে বাজিয়ে চলেছে ক্রমাগত। কখনও মাথা ঝাঁকাচ্ছে, কখনও নাচছে। এতই আকর্ষণীয় তার উপস্থাপনা, যে পথচলতি অতি ব্যস্ত অফিসযাত্রীরাও দু'দণ্ড দাঁড়িয়ে দেখে নিচ্ছেন তার কার্যকলাপ। এবং একবাক্যে সকলেই বলছেন, এই খুদের দক্ষতা পাল্লা দেবে অনেক পেশাদারকেও। যার ঢোলের বাজনা নিয়ে এত কথা, তার নাম রাঘব। ঠিকানা, পথের ধারে ওই একচিলতে ফুটপাথ।

kolkata dhol player viral ফুটপাথেই সংসার রাঘব আর তার মায়ের। ছবি: শশী ঘোষ

সন্তোষ মিত্র স্কোয়ার মাঠের দু-ধারেই রয়েছে ফুটপাথ। সেখানেই সন্তান-সন্ততি নিয়ে সংসার পেতেছেন বাস্তুহারা কিছু মানুষ। এঁদের ছেলেমেয়েদের খেলার জায়গা বলতে এই পার্ক। সকাল থেকে ভাঙ্গা কাঠের টুকরো দিয়ে কেউ খেলে ক্রিকেট, কেউ ফুটো হওয়া বল দিয়ে ফুটবল, কেউ বা ছেঁড়া পুতুল নিয়ে রান্নাবাটি।

তবে এদের মাঝে রাঘব আলাদা। সকালবেলা ঘুম ভাঙ্গা থেকে রাতে ঘুমোতে যাওয়ার আগে পর্যন্ত নিত্যসঙ্গী তার ওই ফাটা ঢোল। সারাদিন নিজের মতন গলায় ঝুলিয়ে ঘুরে বেড়ায়। রাঘবের জন্ম এই ফুটপাথেই। তার বাবা যখন ছেড়ে চলে যায় তার মাকে, তখন তিনি অন্তঃসত্ত্বা। তখন তাঁদের ঠিকানা ছিল ট্যাংরা এলাকার এক ফুটপাথ। এরপর দাদুর কাছে এখানেই ঠাঁই হয় মা-ছেলের।

আরও পড়ুন: মাত্র পাঁচ দিনে হয়ে উঠুন ‘তেজস্বিনী’, সৌজন্যে কলকাতা পুলিশ

দাদু সাজন মালিক। ব্যান্ড পার্টিতে ঢোল বাজান। রাঘবকে দু'বছর বয়স থেকে একটু ভালোমন্দ খাওয়ানোর জন্যে সঙ্গে করে নিয়ে যেতেন বিভিন্ন অনুষ্ঠানে। তখন থেকেই বাড়ি ফিরে দুটো কাঠি জোগাড় করে ভাঙ্গা টিনের বাক্সে দাদুর মতনই ঢোল বাজানোর চেষ্টা করতো ছোট্ট রাঘব। তার আগ্রহ দেখে তিন বছর আগে মাঠের মেলা থেকে একটা ঢোল কিনে দেন দাদু। তারপর থেকেই এই ঢোল তার নিত্য সঙ্গী।

kolkata dhol player viral সকাল থেকে রাত পর্যন্ত সঙ্গী ঢোল। ছবি: শশী ঘোষ

দাদু কোনোদিন হাতে ধরে ঢোল বাজানো শেখান নি। নিজের আগ্রহেই দেখে দেখে শেখা। সারাদিন ঢোল বাজাতে বাজাতে ঢোলের একপাশ গিয়েছে ফেটে। তাতেও ভ্রূক্ষেপ নেই তার। মা অঞ্জু বাড়ি বাড়ি কাজ করেন। সকাল হতেই ছেলেকে ঘুমন্ত অবস্থায় রেখে বেরিয়ে পড়তে হয়। মা কাজ সেরে বাড়ি ফিরলেই খাওয়া জোটে। এর মাঝে সন্তোষ মিত্র স্কোয়ারের মাঠই তার ঢোল বাজানোর মঞ্চ।

আরও পড়ুন: কলকাতার অধিকাংশ দোকানে এই গ্রাম থেকেই আসে রাবড়ি

পুজোর মাঠের এক কোণায় ফুটপাথের ধারের বড় বাড়ির নিচে রাঘব আর রাঘবের মায়ের সংসার। এর জন্য বাড়ির মালিকের সঙ্গে লেগে রয়েছে নিত্য অশান্তি। ঢোলের শব্দ শুনলেই উপর থেকে চিৎকার শুরু হয়। রাঘবের ছোটবেলা থেকেই এই নিয়ে আতঙ্ক। তাই এখানে কেউ ঢোল বাজাতে বললেও সে রাজি হয় না। ঢোল শুনতে হলে যেতে হবে মাঠে।

তার বয়সী ফুটপাথের অনান্য যে বাচ্চারা রয়েছে, তাদের থেকে সে একটু আলাদা। লাজুক এবং শান্ত প্রকৃতির, নিজের মনেই থাকতে ভালোবাসে। মা অঞ্জুর এতেই শান্তি। ছেলের প্রতিভা দেখে তাঁর ভালো লাগে। চান ছেলে যাতে মানুষের মত মানুষ হয়। স্কুলে ভর্তি করানোর ইচ্ছে থাকলেও সামর্থ্য নেই। পড়ার জন্যে বইখাতা কিনলে তাঁর অবর্তমানে তা রাস্তায় থেকে নষ্ট হয়ে যাবে কিংবা কেউ ছিঁড়ে ফেলে দেবে। তাই পড়াশোনা শেখানোর কথা চিন্তা করতে পারেন না। রাঘব একটু বড় হয়ে নিজের দায়িত্ব নিজে নিতে শিখলে তবেই স্কুলে পাঠাবেন। ততদিন নিজের মতন ঢোলই বাজিয়ে যাক সে।

viral
Advertisment