রবি ঠাকুর মারা যাওয়ার মাস কয়েক আগের কথা।শান্তিনিকেতনে দেখা করতে যান লেডি রানু মুখার্জি। কবি তখন রোগশয্যায়। রাণুকে একটি রত্নখচিত পারিবারিক আংটি তিনি উপহার দেন। হোয়াইট মেটালের আংটি। তাতে নীলা বসানো।পাশ থেকে সারি দিয়ে ছোট ছোট হিরে। দেখে চোখ ফেরানো সম্ভব নয়।এই উপহার প্রদানের ঘটনা ১৯৪১ সালের। মূল্যবান তথা কবির স্মৃতিবিজরিত এই আংটি চুরি হয়ে যায় ১৯৭৪ সালে। এর প্রায় বারো বছর পর আবার সে আংটি রাণুর হাতে আসে ১৯৮৬ সালে।
কী হয়েছিল ঘটনাটা ?
পুলিশকে দেওয়া লেডির বয়ান থেকে জানা যায়, রাত ন'টা নাগাদ ডিনারে বসেছিলেন তিনি। তাঁর অভ্যাস ছিল খাওয়ার সময়ে আংটি খুলে টেবিলে রাখা, হাত ধোয়ার পর ফের পরে নেওয়া। কিন্তু সংশ্লিষ্ট দিনে লোডশেডিং হয়ে যায়। মনের খেয়ালে আংটি না পরেই ডাইনিং রুম থেকে বেরিয়ে যান লেডি। পরদিন সকালে মনে পড়ায় ওই ঘরে ফিরে এসে আর আংটি দেখতে পাননি। এরপরই পুলিশে খবর দেওয়া হয়।
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন
সামাজিক অবস্থানে বিচার করলে লেডি রাণু তখন চূড়ান্ত প্রভাবশালী। ডিসিডিডি বিভূতি চক্রবর্তীর নির্দেশে তদন্তে নামেন গোয়েন্দারা। খোঁজাখুঁজির পর জানতে পারা যায়, নানা হাত ঘুরে নিউমার্কেটের একটি দোকানে ঠাঁই হয়েছে আংটির। পুলিশের পরামর্শে লেডি নিউ মার্কেটের সন্দেহভাজন দোকানগুলিতে গিয়ে নীলার আংটি দেখতে চান। একটি দোকানে দেখেই তিনি আংটি চিনতে পারলেন। দোকানটির ঠিকানা ও নম্বর নিয়ে রাখেন তিনি। ওই আংটি-সহ কয়েকটি আংটি নিয়ে তিনি দোকানদারকে দেখা করতে বলেন অ্যাকাডেমির বাড়িতে। টোপও দিলেন একাধিক আংটি কেনার। বিক্রেতা এলে তিনি তাঁকে অপেক্ষা করতে বলে সোজা পুলিশে ফোন করেন। এমনিতেই কয়েকজন পুলিশকর্মী বাইরে সাদা পোশাকে অপেক্ষা করছিলেন আগে থেকেই। পীতাম্বর, বিমলচাঁদ, চন্দুলাল ও লালচাঁদ নামে চার জনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। মামলা ইত্যাদি পর্বের পর বারো বছর বাদে লালবাজারের মালখানা থেকে আংটি পুনরায় লেডির হাতে আসে।
অনিমেষ বৈশ্যের কলাম: সাইকেলের রডে বনলতা সেন
তবে আংটি নিয়ে পরবর্তী সময়ে অবশ্য অনেক জলঘোলা হয়েছিল। সে সময়কার একাধিক পত্র-পত্রিকায় পত্রযুদ্ধও হয়। রবি ঠাকুরের স্নেহের পাত্রী হিসেবে পরিচিত মৈত্রেয়ী দেবী একটি সংবাদপত্রে চিঠি দিয়ে গভীর সন্দেহের সঙ্গে প্রশ্ন তোলেন, কবি যেখানে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় গড়ার টাকা তোলার জন্য নানা দেশের নানা মানুষের কাছে ঘুরে বেড়িয়েছেন, তিনি কেমন করে কাউকে দামি অলংকার উপহার দিতে পারেন! তাঁর স্পষ্ট ইঙ্গিত ছিল যে এমন দামি আংটি নিজের কাছে থাকলে তা দান না করে বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্যই খরচ করতেন কবি। লেডি সংক্ষেপে সে সময়ে জানিয়েছিলেন যে তাঁকে এই উপহার দেওয়ার কথা দু'জন নির্দিষ্টভাবে জানেন, তাঁরা হলেন কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং এলমহার্স্ট সাহেব।
আবার কারও কারও প্রশ্ন ছিল, রবি ঠাকুর কাউকে কিছু উপহার দিলে সাধারণত সঙ্গে এক-দু লাইন কবিতা লিখে দিতেন। আংটির জন্য কবিতা লেখা হয়নি কেন ? লেডি উত্তরে জানান, তিনি এবং তাঁর পরিবারের মানুষ কবির এতোটাই নিকট ছিলেন এবং কবি এতবার এত রকম উপহার দিয়েছেন যে প্রতিবার আলাদা করে আর তার জন্য কবিতা লেখেননি। এই প্রসঙ্গে কবি তাঁকে একবার নিজের চুল উপহার দিয়েছিলেন সে প্রসঙ্গও তুলে আনেন লেডি।
অনিমেষ বৈশ্যের কলাম: লকডাউন ও মহম্মদ রফির ভাই
কবির চুল বড্ড সুন্দর, এমন কথা নাকি বার বার বলতেন রাণু।“আমাকে আপনার চুল কেটে দেবেন?”, এমন আবদারও নাকি তিনি করেন। শোনা যায়, রাণুর মজার ছলে বলা এমন কথার রেশ ধরে রাণুকে বিয়েতে সত্যি সত্যি সোনার কাসকেটে নিজের চুল উপহার দেন কবি। উল্লেখ্য, সেই চুলই পরে স্থান পায় অ্যাকাডেমির সংগ্রহশালায়!
(গত কয়েক দশকে কলকাতার নানা অপরাধমূলক ঘটনার সময়ে তখনকার সংবাদপত্র ও পত্রিকায় প্রকাশিত খবর এবং ক্রাইম সংক্রান্ত নানা বইয়ে প্রকাশিত তথ্যের ভিত্তিতেই প্রকাশ করা হচ্ছে এই ফিচার-ধর্মী কলামটি। সংশ্লিষ্ট বিষয়ের তথ্য, অপরাধী-আইনজীবী, বাদী-বিবাদী পক্ষ, পুলিশ-গোয়েন্দা, মামলার খুঁটিনাটি ইত্যাদির দায় কোনও অবস্থাতেই কলামের লেখক কিংবা ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা কর্তৃপক্ষের নয়। শহরে শোরগোল ফেলে দেওয়া ক্রাইমগুলির কয়েকটি এ কলামে গল্পাকারে জানাতে চাওয়া হয়েছে মাত্র।)