Advertisment

'কৃষ্ণাদিকে দেখলে বয়সের কথা মাথায় আসত না'

প্রয়াত শিক্ষাবিদ তথা প্রাক্তন সাংসদ কৃষ্ণা বসুকে এক দশক ধরে খুব কাছ থেকে দেখেছেন কলকাতার দুই নবীন সঙ্গীতশিল্পী সৌরেন্দ্র-সৌম্যজিৎ। কৃষ্ণা দেবীর অন্তিম যাত্রার ক্ষণে রইল তাঁদের স্মৃতিচারণ

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
krishna basu

অলঙ্করণ: অভিজিৎ বিশ্বাস

কৃষ্ণাদির সঙ্গে আমাদের প্রথম দেখা শিল্পী শুভাপ্রসন্নর 'পাখিরালয়ে', মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার কয়েকদিন আগে। একটি ঘরোয়া বৈঠকে আমরা সঙ্গীত পরিবেশন করেছিলাম, সেখানে কৃষ্ণা বসুও ছিলেন। সেদিনই বলে গিয়েছিলেন, "তোমাদের গান খুব ভালো লাগল, আমার বাড়িতে তোমাদের ডাকার ইচ্ছে রইল।"

Advertisment

তারপর দীর্ঘ দশ বছর ধরে ঘনিষ্ঠতা বেড়েছে, এবং আমাদের সমস্ত কাজেই ওঁর কাছে আবদার করলে অসুবিধে থাকলেও চলে আসতেন। যেমন বছর দুয়েক আগে নারীদিবসের একটি অনুষ্ঠানে, যেখানে আমরা কয়েকজন মহিলাকে সংবর্ধনা জানিয়ে তাঁদের সঙ্গেই অনুষ্ঠান করেছিলাম, সেখানে অত্যন্ত অসুস্থ শরীর সত্ত্বেও কৃষ্ণাদি এলেন। আমরা কেউ ভাবি নি আসতে পারবেন, শুধু আমাদের মুখের কথায় এলেন।

তারও বেশ কিছু বছর আগে, ২০১১ সালেই, আমরা 'দেখা হবে এই বাংলায়' বলে একটি মিউজিক ভিডিও বানাই, যাতে দেখা গিয়েছিল বাংলার ১০০ জন কৃতী মানুষকে। সেই ভিডিওর জন্য কৃষ্ণাদি, বাণী বসু, এবং নবনীতা দেবসেনকে নিয়ে গড়িয়াহাটের রাস্তায় শুটিং করেছিলাম। ওই ভিড়ভাট্টা সত্ত্বেও তিনজনেই শুধু মহানন্দে শুটিং করেছিলেন তাই নয়, রীতিমতো গড়িয়াহাটের ফুটপাথের বইয়ের দোকানের বেঞ্চে বসে আড্ডা দিয়েছিলেন। আমাদের ওই বয়সে সে এক অনন্য অভিজ্ঞতা।

আরও পড়ুন: প্রয়াত প্রাক্তন সাংসদ ও শিক্ষাবিদ কৃষ্ণা বসু

কৃষ্ণাদি আমাদের গানবাজনা ভালবাসতেন বলে নেতাজী ভবনে তিন-চারবার অনুষ্ঠান করেছি, সে নেতাজী জয়ন্তীর জমকালো অনুষ্ঠানই হোক, অথবা এই তো সেদিন শিশির বসুর জন্মশতবর্ষ উপলক্ষ্যে ২ ফেব্রুয়ারি অপেক্ষাকৃত ঘরোয়া অনুষ্ঠান। সেদিনও কিন্তু কৃষ্ণাদিকে দেখে মনে হয় নি গুরুতরভাবে অসুস্থ। বরং বরাবরের মতোই তাঁর প্রখর স্মৃতিশক্তির পরিচয় পেয়েছিলাম। এমনিতেও ওঁকে দেখলে বয়সের কথাটা মাথায় আসত না, ব্যক্তিত্বটাই মুখ্য হয়ে উঠত।

তাঁর প্রয়াত স্বামী শিশির বসু সম্পর্কে আমাদের বলতেন, কীভাবে তাঁদের বিয়েটা ১৯৫৫ সালে না হয়ে আরও অনেক আগে হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু শিশির বসু জেলে থাকার ফলে বিয়ের সুযোগ পাওয়া যাচ্ছিল না! (১৯৪১ সালে নেতাজীকে কলকাতা থেকে পালাতে সাহায্য করায় প্রথমে লাহোর ফোর্ট, এবং পরে লাল কেল্লায় হাজতবাস করতে হয় নেতাজীর ভ্রাতুষ্পুত্র শিশির বসুকে)।

আরও একটা ব্যাপারে কৃষ্ণাদি বরাবর সজাগ ছিলেন। তা হলো বসু পরিবারের নাম। পরিবার নিয়ে কোনোরকম ভ্রান্ত ধারণা ছড়াতে দিতে চাইতেন না, সে ধারণা ভালো হোক বা খারাপ। বারবার ইতিহাসে নথিভুক্ত তথ্যের কথা বলতেন, তথ্য বিকৃতি একেবারেই সহ্য করতে পারতেন না, যেমন গুমনামী বাবার জল্পনা নিয়ে আমাদের স্পষ্ট বলেছিলেন, "এরকম কোনও ব্যাপার নেই।"

অগাধ পাণ্ডিত্য, নেতাজী রিসার্চ ব্যুরোর সুদক্ষ পরিচালনা, এবং ঘরে ও বাইরে আরও অজস্র কাজ সত্ত্বেও তাঁর চরিত্রের এমন অনেক দিক ছিল, যা সচরাচর নজরে পড়ত না। যেমন আমাদের গানবাজনার একনিষ্ঠ শ্রোতা হিসেবে তাঁর সমালোচনা, যা সবসময়ই ইতিবাচক হতো। গানের সুর-তাল যত না, গানের ভাব নিয়ে কথা বলতেন বেশি। এই ধরনের সমালোচক সবসময়ই বিশেষ। সেট বা মঞ্চের আলো নিয়েও কথা বলতেন, সব ব্যাপারেই একটা সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি ছিল। এমনকি কোনও অনুষ্ঠানে মঞ্চে কী ধুতি পরে উঠেছি, তাও নজরে রাখতেন, পছন্দ না হলে বলে দিতেন।

যে কোনও বিষয় নিয়ে কথা বলা যেত ওঁর সঙ্গে। যেমন খাওয়াদাওয়া। পৃথিবীর নানা দেশের খাওয়াদাওয়া, খাবার পরিবেশন করার ঢং, সম্পর্কে অগাধ জ্ঞান ছিল। দেশভ্রমণ অনেকেই করেন, কিন্তু কৃষ্ণাদির প্রধান গুণ হলো, তিনি ছিলেন ইংরেজিতে যাকে বলে অত্যন্ত observant, ফলে খুঁটিয়ে দেখার বা তলিয়ে বোঝার ক্ষমতা খুব বেশি মাত্রায় ছিল। যে কোনও বিষয়ে স্পষ্ট ধারণা, এবং সেই ধারণা যুক্তি দিয়ে প্রতিষ্ঠা করার ক্ষমতা ছিল। ক'জনের থাকে আজকাল?

Advertisment