সংসদের আসন্ন অধিবেশনের দিকে তাকিয়ে বিরোধীদের মধ্যে একটা বৃহত্তর বোঝাপড়ার প্রস্তাবনা তৈরি হতে চলেছে। কোনও অভিন্ন মঞ্চ গড়ার বাস্তবতা এতে স্পষ্ট নয়। একটা ধোঁয়া ধোঁয়া, ছাড়া ছাড়া কাছাকাছি আসা। যার আশু পরিণতি লোকসভা বা রাজ্যসভার ফ্লোর কোঅর্ডিনেশন। সভার ভেতরে সমন্বয়। সংসদের অধিবেশন চলাকালীন এই সমন্বয় বা বোঝাপড়া সরকারকে বেগ দেবে। নীরব মোদি, রিজার্ভ ব্যাংক, সিবিআই, কাশ্মীর, পাকিস্তান বা অযোধ্যার মতো ইস্যুতে কোণঠাসা হওয়ার কথা মনে রেখেই পা ফেলতে হবে প্রধানমন্ত্রীকে। তবে তাঁর দলের একক গরিষ্ঠতা এখনও নিরঙ্কুশ। বিরোধী-ভয়ে কম্পিত নন তিনি। ইনার সার্কেল বা বস্তুত অন্তরঙ্গে এখনও ২৭২ নিয়ে ভাবনা নেই ভাজপার। তাছাড়া বহিরঙ্গ বা দৃশ্যত আউটার সার্কেলে আছে এনডিএ-র সংসার। শিবসেনা যতই তর্জন করুক, হিন্দুত্ব, মন্ত্রিত্বের পিছুটানে শেষ বেলায় বিজেপির সঙ্গ ছেড়ে যাবেনা। তাছাড়া নরেন্দ্র মোদী মহাশয় মেরুকরণের এমন বাণ মেরে রেখেছেন যে ভারতের রাজনীতিতে তৃতীয় ভূখণ্ড লুপ্ত হয়ে গেছে। বলি রাজার মতো সেই ভূখণ্ড যদি হয় দিল্লির মসনদ তাহলে আসন্ন উনিশে তা দখলের জন্য চাই বামন অবতার। আপাতত সীতারাম, দেবগৌড়া, চন্দ্রবাবু এবং লালু আ্যন্ড কোং রাহুল গান্ধীকেই বামন অবতার বানাতে মরিয়া।
এমনই একটা বোঝাপড়ার জমি ২০১৪ থেকেই গড়ে ওঠার মতো পরিস্থিতি থাকলে সংসদের সমন্বয় থেকে মঞ্চ এবং মঞ্চ থেকে বিরোধী জোট অনায়াসেই গড়ে উঠত পাঁচ বছরে। কিন্তু তিরিশ বছর পর প্রথম কোনও দল একা লোকসভায় ২৭২ এর ম্যাজিক সংখ্যা পেরিয়ে যাওয়ায় রীতিমতো হকচকিয়ে গিয়েছিল বিরোধীরা। শুধু কি তাই? বাংলায় বামেদের মাত্র ২, তাও নামমাত্র মার্জিনে, উত্তরপ্রদেশে সপার মাত্র ৫, কংগ্রেসের মাত্র ২, বসপার ০ এবং সারাদেশে সাকুল্যে ৪৪ মূল বিরোধীদল কংগ্রেসের ছিল সর্বকালের সর্বনিম্ন গ্রাফ। দশবছর রাজত্ব করার পর ইউ পি এ অস্তিত্বহীন। শরিকরা ছন্নছাড়া। শুধু মুক্তকচ্ছ তৃণমূল যেহেতু মোদি ফরমুলার মেরুকরণেই বাংলার মসনদে, তাই মাত্র তিনবছরে পরিবর্তনের আমেজ কাটেনি ভোটারদের। তাছাড়া ২০১১ - য় তো বাংলায় জোটসঙ্গী ছিলই কংগ্রেস। যেমন সিপিএম বিরোধী আন্দোলন পর্বে ছিল রামধনু জোট। কে না ছিল তাতে? এমনকি বামফ্রন্টের কোনও কোনও শরিকও মনে মনে । সঙ্গী ছিল পিডিএস, এসইউসি । সুতরাং দক্ষিণের জয়ললিতার পরই লোকসভায় মমতার স্থান। সংখ্যায় ৩৪। এবার সেই ৩৪কেই ৪২ বানিয়ে বাংলায় নিরঙ্কুশ হওয়ার ডাক দিয়েছেন মমতা। যাতে বিরোধী জোটে তৃণমূলের অঙ্কুশ চলে। ঠিক এইখানেই বাম রাজনীতির অমিল অঙ্ক অন্ত্যমিল খুঁজে পেয়েছে।
আরও পড়ুন দেবেশ রায়ের নিরাজনীতি
বাংলায় পরিবর্তনের ঝড় জোরালো হয়েছিল কংগ্রেসের হাত বদলে। পেছনে ছিল সিপিএমের কারাট-লাইন।যার দরুণ সপ্তম বামফ্রন্টের সর্বকালীন রেকর্ড ২৩৫-এর পরই ২০০৯-এর লোকসভার ধস। দিল্লির মসনদ থেকে কলকাতার মহাকরণ দখল ছিল শুধু সময়ের প্রতীক্ষা। যেন ইউ পি এরই পার্শ্ব পরিবর্তন হল দিল্লি থেকে বাংলায়। ক্রমশ ত্রিভঙ্গ হল বাংলার রাজনীতি। সাতবছরে সর্বহারা সিপিএম । এবং কংগ্রেস। নন্দীগ্রামের রোষের প্রতীক লক্ষ্মণ শেঠ যেমন ভিড়লেন কেন্দ্রের শাসকদলে , তেমনি মমতার মন্ত্রী মানস ভুঁইয়া মন্ত্রীত্ব ছেড়ে নারায়ণগড়ে সূর্যকান্তর গলা জড়িয়ে এবং শেষে গলা ছেড়ে, হাত ছেড়ে ঘাসফুলের পাসওয়ার্ড নিয়ে রাজ্যসভায়। এভাবেই বাংলার গ্রামেগঞ্জে ৩৪ বছরের বেনোজল বাম ছেড়ে ডানে। পদ পেলে তৃণমূল, না পেলে বিনাপদেই পদ্মফুল। সুতরাং ভোটের বিভাজনও সেইরকম। কেন্দ্রের শক্তিমান শাসকের বাংলায় পা রাখার লড়াই চোখে পড়ছে। আবার মার খেয়ে মাটি কামড়ে তিল তিল করে দল গড়ার ঝক্কি নেবে কে? সাড়ে তিন দশকের সিপিএম জমানায় জন্মে শাসকদলে নাম লেখানোর পর এই শেষ যৌবনে বা মধ্য বয়সে কি চালচুলোহীন দল করা যায়? এটাও এক জ্বলন্ত বাস্তবতা। ওদিকে বাংলার পর ত্রিপুরার ধস। না তৃণমূল না কং , এক্কেবারে সরাসরি বিজেপি। শুধু শিবরাত্রির সলতে বলতে কেরালা। তবু সেটাই সিপিএমের কারাট লাইনের ফসিল হতে চলেছে। বাংলার বাস্তবতা আমূল বদলে গিয়ে তৃণমূল যখন মূল প্রতিপক্ষ, আগ্রাসী শাসকের গ্রাসে গ্রামবাংলার কংগ্রেসের কর্মি সমর্থক যখন যৌথ প্রতিরোধে সামিল বাম বন্ধুদের সঙ্গে, যখন তারা একই নৌকার যাত্রী, তখনও পরপর পার্টি কংগ্রেসে কংগ্রেসের ছায়া মাড়ানো চলবেনা বলে বিধান দিয়েছেন মালয়ালি তাত্ত্বিকেরা। যেসব রাজ্যে দলের অস্তিত্ব সামান্য কিছু পকেট সংগঠন, ভোট ক্রমশ কমে চলেছে মেরুকরণের দাপটে, রাজ্য বিধানসভায় উপস্থিতি ০ কিংবা ১/২, সংগঠনে তারাই দলে ভারি। দক্ষিণী রাজ্যগুলোই এই গরিষ্ঠতার সিংহভাগ অংশীদার। সেই সঙ্গে এমন কিছু রাজ্যের সাংগঠনিক প্রতিনিধিরা দলের ঊর্ধ্বতন কমিটিতে নির্বাচিত হয়ে আসেন যাদের টিকে থাকাটাই সম্পূর্ণ নির্ভরশীল দলের দক্ষিণী গোষ্ঠীর ওপর। এই সব রাজ্যের মধ্যে আছে উত্তর প্রদেশ, গুজরাত, মহারাষ্ট্র, অসম, ওডিশা, ঝাড়খণ্ড, উত্তরাখন্ড, মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিশগড়, রাজস্থান এবং দিল্লির মতো রাজ্যের কেন্দ্রীয় কমিটি সদস্যরা। যেসব রাজ্য থেকে একজনও সাংসদও আসেননা ভারতের লোকসভায়, তারাই সিপিএম কেন্দ্রীয় কমিটিতে বসে ঠিক করেন ভারতের জাতীয় রাজনীতির গতিপ্রকৃতি। কারণ, বামেরা সংখ্যায় কম হলেও জাতীয় রাজনীতিতে অণুঘটক ও নির্ণায়ক হিসেবে নিজেদের উপস্থিতি ও প্রভাব বিস্তার করেছে। জাতীয় জীবনের সংকট মুহূর্তে সব প্রধানমন্ত্রীরাই বাম, বিশেষত দুই কমিউনিস্ট পার্টির নেতাদের ডেকে পরামর্শ চেয়েছেন ও পথনির্দেশ ঠিক করেছেন। এক্ষেত্রে একমাত্র ব্যতিক্রম নরেন্দ্র মোদি। যদিও শুধু ত্রিপুরার প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ও সিপিএম পলিটব্যুরো সদস্য মানিক সরকারকে ডেকে উত্তর পূর্বাঞ্চলের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে আলোচনা করতেন। এই সংক্রান্ত কমিটিতেও রেখেছিলেন তাঁকে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, বাংলার ভাগ্য নির্ধারণের সময় পর্যন্ত মানিক সরকারও ছিলেন কট্টর কং-বিরোধী কারাট-লাইনের অন্যতম প্রধান সমর্থক। কিন্তু বঙ্গের মতো ত্রিপুরাতেও কংগ্রেস মূল বিরোধী শক্তির মর্যাদা খোয়ানোর পর তিনি রণনীতি বদলানোর পক্ষে রায় দেন। কিন্তু ততদিনে অনেক দেরি হয়ে যায় বাস্তব পরিস্থিতির সঠিক মূল্যায়নে।
এবার কঠোর বাস্তবতার মুখোমুখি কেরল। ভারতের শেষ লাল দুর্গ। অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টি ক্ষমতায় এসেছিল একমাত্র এই রাজ্যেই। নির্বাচিত সেই প্রথম বাম সরকারকে ভেঙে দিয়েছিল জওহরলাল নেহরুর নেতৃত্বাধীন কংগ্রেস সরকার। প্রথম কমিউনিস্ট মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন ইএমএস নাম্বুদিরিপাদ। প্রকাশ কারাট থেকে শুরু করে সিপিএমের কেরল লবির প্রত্যেকেই তাঁর মন্ত্রশিষ্য। কংগ্রেস থেকে কমিউনিস্ট পার্টিতে এলেও সিপিএমে আগাগোড়া কট্টর কংগ্রেস বিরোধী লাইনের অন্যতম প্রধান মুখ ছিলেন ইএমএস। কিন্তু রামমন্দির আন্দোলনের সূত্রপাত ও আডবানির সোমনাথ থেকে অযোধ্যা রথযাত্রার সময়ই তিনি বৃহত্তর বিরোধী জোটের পরিধিতে বিজেপিকে রাখার প্রস্তাব রুখে দেন। '৮৯-তে ভিপি সিংয়ের নেতৃত্বাধীন রাষ্ট্রীয় মোর্চার সরকারকে বাইরে থেকে সমর্থন করেছিল সিপিএম ও বিজেপি। কিন্তু এই দুই দলের মধ্যে সমণ্বয়ের মঞ্চ রাখা হয়নি সিপিএম কেন্দ্রীয় কমিটির সিদ্ধান্তে। তখন কেন্দ্রীয় কমিটিতে ইএমএসই ছিলেন গরিষ্ঠ অংশের নেতা এবং দলের সাধারণ সম্পাদক। তিনি কং বিরোধিতার পাশাপাশি বিজেপি বিরোধিতায় জোর দেন। এবং রাজীব গান্ধির মৃত্যুর পর ত্রিশঙ্কু লোকসভায় কংগ্রেসের নেতৃত্বে সংখ্যালঘু সরকার গড়ার প্রশ্নে দ্ব্যর্থহীন অবস্থান নেন সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে।
আরও পড়ুন, শিখদাঙ্গায় গুজরাতের রক্তদাগ মুছতে চায় বিজেপি
১৯৯১-এর লোকসভা ভোটের ফলাফলে দেখা গেল, কংগ্রেস গরিষ্ঠতা থেকে অনেকটাই দূরে। যদিও তারাই লোকসভার প্রথম দল। বিজেপি দ্বিতীয়। পিভি নরসিংহ রাও তখন বরিষ্ঠ নেতা হিসেবে সবারই আস্থাভাজন। যদিও নেতৃত্ব থেকে কার্যত কোণঠাসা। পুরো ফলাফল বেরনোর পর আমরা ক'জন সাংবাদিক রাওয়ের কাছে যাই সরকার গড়া ও তাঁর নেতা হওয়ার সম্ভাবনা কতদূর জানতে। যাওয়া মাত্রই নরসিংহ রাও বললেন, এই মাত্র চলে গেলেন ইএমএস। উনি বলে গেলেন, সাম্প্রদায়িক শক্তিকে রুখতে পাঁচ বছরের মেয়াদের সরকার গড়তেই হবে। কারও গরিষ্ঠতা নেই বলে ফের নির্বাচন কিছুতেই নয়। গরিব দেশের ওপর আর্থিক চাপ আমরা চাইনা। তাছাড়া এখন নির্বাচন করে সাম্প্রদায়িক শক্তিকে সুযোগ দেওয়া যাবেনা। এছাড়া যে মোক্ষম কথাটি রাও জানালেন তা হল, ইএমএস বলেছেন, প্রথম দল হিসেবে সরকার গড়ুক কংগ্রেস। সংখ্যালঘু সরকারও তো চলতে পারে সর্বসম্মতির ভিত্তিতে। সেকুলার সরকারকে ফেলে আমরা বিজেপির পথ প্রশস্ত করবনা।
তার পরের ইতিহাস কারও অজানা নয়। সরকার চলেছিল পাঁচ বছরই। কিন্তু বামেদের বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখিয়ে বিরোধী জনতাদল ভেঙেছিল কংগ্রেস অনৈতিক পথে। যদিও বাম পথেই ২বছর যুক্তফ্রন্ট সরকারকে সমর্থন দিয়েছিল কংগ্রেস , ' ৯৬ থেকে '৯৮. ফের বাম সমর্থিত সরকার চালিয়েছিলেন মনমোহন ২০০৪ থেকে। ২০০৮ থেকে ২০১৪ ফের তিক্ততার পর্ব পেরিয়ে কংগ্রেস ও বামেরা তাদের চরম সংকটকালে কাছাকাছি আসতে শুরু করে। বিশাখাপত্তনম পার্টি কংগ্রেস পর্যন্ত কং বিরোধী কট্টরপন্থায় অটল কারাট শিবির। কিন্তু জোটপন্থী সীতারাম ইয়েচুরি দলের সাধারণ সম্পাদক হলেন ওই পার্টি কংগ্রেসেই, লাইন পরিবর্তনের সংকেত দিয়ে। ইনার পার্টি স্ট্রাগলে প্রয়াত নেতা জ্যোতি বসুর শৈলীকে হাতিয়ার করে বাংলা লবিকে সঙ্গে নিয়ে এগোলেন। হায়দরাবাদ কংগ্রেস কংগ্রেসকে আর অচ্ছুৎ রাখেনি। গত কেন্দ্রীয় কমিটি আরও খোলসা করেছে বিজেপিকে হারিয়ে কেন্দ্রে সেকুলার সরকার গড়ায় উদ্যোগী হওয়ার প্রয়াস। তবে বিজেপিকে রুখতে তৃণমূলকে কোনও মতেই সঙ্গী করতে চায়না সিপিএম। স্পষ্ট সংকেত দিচ্ছে পলিটব্যুরো, কেন্দ্রীয় কমিটি, ভোটের আগে জোট নয়। ভোটের পর জোটে সবচেয়ে বড় সেকুলার দল পাবে সিপিএমের সমর্থন। সে দল কংগ্রেস ছাড়া আর কে ? কেন্দ্রে '৬৭ সাল থেকে কংগ্রেস সরকারের সংকটে পাশে থেকেছে বামেরা। দলের দলীল কংগ্রেসকে মূল শত্রু চিহ্নিত করেছে যখন তখন মতাদর্শের তাগিদে দক্ষিণপন্থীদের বাড়া ভাতে ছাই দিয়েছে বামপন্থা। প্রেম-ঘৃণার দ্বৈত লয়ে। সনিয়ার সিলমোহরে বাম আ্যজেন্ডা জাতীয় কর্মসূচি হল। পরোক্ষে যা হয়েছিল নেহরু, ইন্দিরা জমানায়। কখনোই কং-সঙ্গী বাম তিন দুর্গে দুর্বল হয়নি। হল ভুল অঙ্কে মানুষের ম্যানডেট ভুলে। কিন্তু শবরীমালায় শিয়রে শমন। শবরীর প্রতীক্ষায় রাম। মেরুকরণের স্বপ্ন দেখছেন মোদি-শাহ। এবার কেরলে কারাটের কমরেড বিজয়ন কেন্দ্রীয় কমিটিতে বুদ্ধবাবুর মতো সওয়াল করছেন। পার্ক সার্কাসে বুদ্ধ-রাহুল সভা মনে পড়ছে ? কেরলের কমরেডরা দারুণ চটেছিলেন।