Advertisment

ঘরে ঘরে মায়েদের হাহাকার, সবাই ‘আদার্স’

আমি একটা ব্যাপার চুপিচুপি বলি, বরাবর লক্ষ্য করেছি, ছেলেরা ছেলেদেরই দিকেই দেখে, আর মেয়েরা মেয়েদের দিকেই। কী পোষাক পরেছে, কীরকম চুল, কীরকম লাগছে। সে পাড়ার পুজোতেই হোক আর বিয়েবাড়িতেই হোক আর ফিল্মস্টারদের অনুসরণ করাই হোক।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
Letter from Canada blog

অলংকরণ: অরিত্র দে

সম্প্রতি নেটফ্লিক্সে একটা ভারতীয় ছবি দেখলাম, 'ইভনিং শ্যাডোজ'। সেটা আবার 'মায়েদের উদ্দেশে' উৎসর্গ করা। দেখেই আমার চক্ষু চড়কগাছ!

Advertisment

যুগ যুগ ধরে ব্যঙ্গ বিদ্রূপের পর, দুনিয়ায় বেশ কিছুদিন যাবৎ একটা মুক্ত হাওয়া বইছে। তাতে অনেকেই অন্ধ-কুঠুরি থেকে বেরোচ্ছে ঠিকই, কিন্তু আমাদের সাধারণ ঘরের ছেলেমেয়েদের অস্তিত্ব তাতে বোধহয় একটু বেশিই টালমাটাল হয়ে পড়েছে। তারা আর সাধারণ হয়ে সাধারণ জীবনযাপন করতে চাইছে না। ঘরে ঘরে এখন ‘আদার্স’। তারা দেখছে পুরুষ-মহিলার সহাবস্থান ব্যাপারটা একটু দুরূহ, কিছুটা আজব। প্রতিনিয়ত বিয়ে ভেঙে যাচ্ছে। আশ্চর্য সব সম্পর্ক। মেয়েরা দেখছে বিয়ের নামে মেয়েদের ওপর জুলুম। মেয়েদেরকেই রাতারাতি অন্য এক পরিবেশে গিয়ে মানিয়ে নিতে হচ্ছে। চাকরি, বাচ্চা-প্রতিপালন, শ্বশুর-শাশুড়ি-দেওরের দেখাশোনা, এক কথায়, 'সুপার উওম্যান' হওয়া। এদিকে ছেলেরা দেখছে মেয়েদের বোঝা মুশকিল, তাদের মালিকানাবোধ, একটুতেই মান-অভিমানবোধ, অভিযোগ-অশান্তি, কথায় কথায় ডিভোর্স, এবং ডিভোর্সের নামে মানসিকভাবে, আর্থিকভাবে লুটপাট।

এই অস্থিরতার রাজ্যে ছেলেমেয়েদের একে অপরের সম্বন্ধে এই অল্পবিদ্যাটা জন্মাচ্ছে ধীরে ধীরে, যেটা আমরা এখনও বুঝে উঠতে পারছি না। আমাদের যুব-সমাজে একটা রিভার্স আইডেন্টিটি ক্রাইসিস হচ্ছে, যা চুপি চুপি মধ্যবিত্তের ঘরেও প্রবেশ করছে। বিগত কয়েক বছর ধরে যেভাবে চারিদিক থেকে 'আমিও', 'আমিও' বলে হাত তুলছে যুব-সমাজ, তাতে কে যে জন্মগত, আর কে যে নকল, তা বোঝা দায়।  চারিপাশে সাধারণ মানুষ খুঁজে পাওয়া মুশকিল, সবাই অসাধারণ, ‘আদার্স’।  ঘরে ঘরে মায়েদের হাহাকার। এদেশে, ওদেশেও। এটাই টপ ফ্যাশন স্টেট্‌মেন্ট। সঙ্গীতশিল্পী থেকে শুরু করে অভিনেতা, ডিজাইনার, গায়ক, যাকেই দেখো, মাথায় একটা করে ঝুঁটি আর কপালে লেখা, আমি 'আদার'। আমায় মেনে নিতে হবে।

আরও পড়ুন: কে ছিলেন গান্থার ভন হ্যাগেন্স?

আগে এরকম অনেক ছবি দেখেছি, কখনও মনে হয় নি গায়ে লাগছে। নেটফ্লিক্সের 'ইভনিং শ্যাডোজ' ছবিটা বড্ড গায়ে লাগল। আমিও মা তো। এখানে ওই একই ব্যাপার, অত্যন্ত সম্ভ্রান্ত এবং গোঁড়া পরিবারের ছেলে ‘গে’, এবং তাকে তার রক্ষণশীল মা কীভাবে মেনে নিচ্ছে, এই নিয়েই গল্প।

আমার বন্ধু জয় বলল, "আরে, আমার ছেলে ঘরে ছেলে আনছে না এতেই আমি ধন্য!" আমার মতন মায়েদের বুক ধড়ফড় করছে, কে জানে কবে ছেলে ঘরে আর একটা ছেলে এনে বলে, এই নাও মা, তোমার বৌমা। বা মেয়ে আর একটা মেয়ের হাত ধরে এল, এই প্রণাম কর। মা, তোমার জামাই। এসব নিয়ে তো এখনো ছেলেমেয়েদের সঙ্গে কথা বলা যায় না, স্কুলের পাঠ্যেও শেখায় না। তাই ইন্টারনেট দেখে-টেখে ভেবে নেয় তারাও ‘আদার’।

ভাবলাম ব্যাপারটা খুঁটিয়ে দেখা দরকার। ছুটলাম ইন্টারনেটের দিকে।

একটু পড়াশোনা করতে করতে একটা ভালো বুদ্ধি এল। ভাবলাম, আচ্ছা, আমাদের টাইমে তো এসব ছিল না, দেখি তো আমিও 'আমি' কী না? তাই এই ৫০ বছর বয়েসে, বিবাহিতা, এক সন্তানের জননী আমি কতগুলো অনলাইন কুইজ খেলতে শুরু করলাম। বারে বারে জিজ্ঞেস করছে, "তুমি কী রঙ পছন্দ করো? রেনবো?" হ্যাঁ, রামধনু কে না ভালোবাসে? "তুমি কি নাচতে ভালোবাসো?" হ্যাঁ রে বাবা! আমি কত্থক ডান্সার ছিলাম। গোল্ড মেডালিস্ট। তো? "তুমি সাজতে ভালোবাসো?" হ্যাঁ কেন ভালবাসবো না? "তুমি পার্লারে যেতে ভালোবাসো?" মাঝেসাঝে। "তুমি ছোটোবেলা থেকে মেয়ে, না ছেলে, কাকে পছন্দ করো?" যাঃ বাবা! তাই যদি জানবো তো এই মাঝ-বয়েসে এসে কুইজ খেলতে যাবো কেন? "তুমি সিনেমা দেখে কাঁদো?" কোন মেয়ে কাঁদে না? ও না, আমি মেয়ে, না ছেলে, না আদার্স, সেটা জানতেই তো বসেছি।

এইসব কিছু আজব প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার পর জানতে পারলাম আমি ২০ শতাংশ বাই-সেক্সুয়াল, ৪০ শতাংশ প্যান-সেক্সুয়াল (এটাও আছে), আর ১০ শতাংশ মাত্র হেটেরো-সেক্সুয়াল, যেটা ভেবে এতদিন বেঁচে আছি। মানে আমি বেশ খানিকটা ‘প্যান-সেক্সুয়াল’, অর্থাৎ যে জীবন যাপন করেছি আমি, তা সত্য নয়। আমার কোনো প্রেম সত্য নয়। ভালোবাসা সত্য নয়, সম্পর্ক সত্য নয়। আমার সবটা মিথ্যা। পুরো জীবনটা মিথ্যা।

আরও পড়ুন: না খেয়ে আর কতদিন? একটা মিছিল হোক ওঁদের জন্য?

নিজেকে আয়নায় দেখলাম বেশ খানিকক্ষন ধরে। যাঃ বাবা! আমি মেয়ে নই? আমি ‘প্যান’? প্যান-প্যান করে কাঁদা মেয়ে না, ‘প্যান-সেক্সুয়াল’? মানে যে নাকি অন্যদের ‘ব্যক্তিত্ব’ দেখে প্রেমে পড়ে। তা তো অনেকেই পড়ে জানতাম। বুদ্ধিদীপ্তদের কার না ভালো লাগে, সে মেয়েই হোক আর ছেলেই হোক। এটা মানে ‘আদার্স’?

আর একটু রিসার্চ করতে লাগলাম। ‘আদার্স’ আসলে কী? এটা কি স্বাভাবিক? প্রাকৃতিক?

বিজ্ঞান বলে, ‘প্রাকৃতিক’ কথাটা কীভাবে সংজ্ঞায়িত করা হচ্ছে তার উপর উত্তরটা নির্ভর করে। প্রাকৃতিক যদি জেনেটিক্যালি বা জৈবিকভাবে নির্ধারিত হয় তবে এতদিন ধরে যা রিসার্চ হয়েছে তাতে সমকামিতা স্বাভাবিক নয়। বৈজ্ঞানিক গবেষণা গত কয়েক দশক ধরে রিসার্চ করে কোন 'গে জিন' খুঁজে পায়নি, ২০১৭ অবধি। আমেরিকান সাইকোলজিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন, আমেরিকান সাইকিয়াট্রিক অ্যাসোসিয়েশন এবং গে গবেষকরা স্বীকার করেছিলেন যে সমকামিতা শুধুমাত্র জৈবিক নয়, মানসিক এবং সামাজিক। মানুষ সমকামি হয়ে জন্মায়, এ তথ্য এতদিন কোথাও পাওয়া যায়নি।

তবে ২০১৭ সালে ‘নিউ সায়েন্টিস্ট’ পত্রিকার এক লেখায় ঘোষণা করা হয়েছিল যে সমকামিদের মধ্যে দুটি 'জিনের' সন্ধান পাওয়া গেছে, যা একটু অন্যরকম বলে মনে করা হচ্ছে। সমকামিতা যে প্রাকৃতিক, অন্তত আংশিকভাবে এই দুটি 'জিন' তা প্রমাণ করে। 'নিউ সায়েন্টিস্টের' তথ্য অনুযায়ী, একটি 'জিন', SLITRK6 নামে পরিচিত, ক্রোমোজম ১৩ তে আছে, যেটা মস্তিষ্কে ‘ডায়েন্সেসফ্যালন’ নামে সক্রিয়। মজার ব্যাপার হল, এই মস্তিষ্কের অঞ্চলে হাইপোথালামাস রয়েছে, যাতে ১৯৯১ সালে সমকামি এবং হেটেরো-সেক্সুয়ালদের মধ্যে আকারের প্রভেদ দেখা গিয়েছিল। এই 'জিনের' আবিষ্কর্তা নিউরো সায়েন্টিস্ট সাইমন লেভ, যিনি বলেন, উনি যেটা খুঁজছিলেন, এটা সেই 'জিন'।

অন্য জিনটি অবস্থিত ক্রোমোজোম 14 এবং সক্রিয় থাইরয়েডে, কিছুটা মস্তিষ্কেও। এটির নাম রাখা হয়েছে TSHR, যার কাজ এক ধরনের রিসেপ্টর প্রোটিন তৈরি করা, যা হরমোনকে স্বীকৃতি দিয়ে থাইরয়েডকে উদ্দীপিত করে। এই ভাবে, এই জিনটি থাইরয়েড ফাংশন নিয়ন্ত্রণে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যেহেতু এটা মানা হয় যে থাইরয়েডের সঙ্গে যৌনতার সম্পর্ক আছে, TSHR যৌনতার সাথে জড়িত বলে মনে করা হয়।

তবে যেসব পুরুষের মধ্যে এই 'গে জিন' আছে, সবাই কি সমকামি? না, ইলিনয় নর্থশোর ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক অ্যালান স্যান্ডার্স বলেছেন, পরিবেশ সহ অন্যান্য অনেক কারণ এক্ষেত্রে ভূমিকা পালন করে। অর্থাৎ, এই সূক্ষ্ম প্রমাণ থাকা মানেই যে ‘গে’ হতেই হবে, তার কোন মানে নেই। মানসিকতা, সামাজিকতা এবং পরিবেশ অনেক সময় এটা নির্ধারণ করে।

এই ঝাপসা ‘গে’ শব্দটার ছাতার তলায় আছে ‘ট্রান্সসেক্সুয়াল’, ‘ট্রান্সজেন্ডার’ অর্থাৎ আমাদের হিজড়া, ‘ট্রান্সভেস্টাইট’, ‘ক্রসড্রেসার্স’... ইন্টারনেটে উইন্ডোর পর উইন্ডো খুলতে খুলতে পাহাড় হয়ে গেল। আমার মাথা ঘেঁটে ঘ! কে যে জন্মগত, কারা যে শারীরিক দিক থেকে ক্রমবর্ধমান, আর কারা যে শখের, তা বুঝতে কালঘাম ছুটে গেল।

কিছু কিছু স্কুলে তো সবেমাত্র ‘সেক্স এডুকেশন’ চালু হয়েছে, ‘সেক্সুয়ালিটি এডুকেশন’ চালু করতে আরো বছর শয়েক লাগবে। বাই-সেক্সুয়াল, না প্যান-সেক্সুয়াল, না ট্রান্সজেন্ডার - সেটা জন্মগত, সমাজতাড়িত, না বন্ধুতাড়িত, এইসব জটিল বিষয় নিয়ে আলোচনা কবে যে শুরু হবে কে জানে। বিজ্ঞান তো শুধু এর অস্তিত্ব আছে একটু আভাস দিয়েই খালাস, এবার বাচ্চাদের হাত ধরে কে দেখাবে কে কী জেন্ডার? তাই হুড়হুড় করে 'আমিও' বলার আগে বোধহয় আমাদের একবার ভাবতে হবে, কী কারণে এটা বলছি।

আরও পড়ুন, ক্যানাডায় মাথার ওপরে কোনো ছাদ নেই

আমি একটা ব্যাপার চুপিচুপি বলি, বরাবর লক্ষ্য করেছি, ছেলেরা ছেলেদেরই দিকেই দেখে, আর মেয়েরা মেয়েদের দিকেই। কী পোষাক পরেছে, কীরকম চুল, কীরকম লাগছে। সে পাড়ার পুজোতেই হোক আর বিয়েবাড়িতেই হোক আর ফিল্মস্টারদের অনুসরণ করাই হোক। যুবকেরা যদি ভাবে আমিতাভ বচ্চনের মতন চুল কাটবে, আর যুবতীরা ভাবে শ্রীদেবীর মত ফিগার রাখবে, তবে তারাও কি ‘আদার্স’? সমাজে অনেক ছেলে আছে যারা রাঁধতে ভালোবাসে, নিপাটভাবে ঘরদোর গোছায়। অনেক মেয়ে আছে যারা পাঁচিলে ওঠে, শুধু ছেলেদের সাথে খেলে, শুধুই শার্ট-প্যান্ট পরে। রান্না করতে চায় না। তবে তারাও কি...?

ছোটবেলায় অনেকের প্রিয় সাথী থাকে, খুব ভালোবাসে তারা একে অপরকে, তারাও কি ‘গে’? আগে যেমন হত, আজকাল কাঁধে হাত দিয়ে ছেলে বন্ধুরা আর হাতে হাত ধরে মেয়ে বন্ধুরা আর খুব একটা বেরোয় না। কোথায় যে এই ধুসর রেখাটি টানা হয়েছে, কোথা থেকে যে এর গন্ডি শুরু হয়েছে, আর কোথায় গিয়ে যে এটার নিষ্পত্তি হবে, তা কে জানে?

তবে একটা কথা। 'অপোজিটস অ্যাট্রাক্ট' বলে একটা প্রচলিত কথা আছে। আমার মন বলে, তার জন্যেই এতো সৃষ্টি। এতো প্রাণ। এই পুরো পৃথিবীটাই। ব্রহ্মাণ্ডে এই একটি মাত্র জীবনদায়ী গ্রহ। সম্পূর্ণ বিপরীত প্রকৃতির একটি পুরুষ একটি নারীকে ‘ভুল’ করে জীবনসাথী করে বলেই তো জীবনে এতো ঘটনা, অঘটনা। তারা একে অপরকে ভালোবাসতে শেখে বলেই তো পৃথিবীটা চলছে। প্রজন্ম সৃষ্টি হচ্ছে। সেই প্রজন্মকে চালু রাখার ক্ষমতা কি উড়িয়ে দেওয়া যায়? এই অশান্তির মধ্যেই তো থাকে জীবনের গতি। জীবনের উচ্ছলতা। অশান্তিকে ভয় পেলে চলবে কী করে? সবাই শান্তি পেয়ে গেলে তো প্রগতিই থেমে যাবে। মানবজাতি অদৃশ্য হয়ে যাবে।

"It is because we are so different that we have so much to share," কোথায় যেন পড়েছিলাম কথাটা।

তথাস্তু!

Advertisment