Advertisment

কলকাতার কাছেই, অথচ এক পৃথিবী দূরে 'ডানলপ চর'

কলকাতা শহরের এত কাছে চরের বসতি খুব একটা দেখা যায় না। তবে ডানলপ চরের বাসিন্দাদের জীবনযাপন একটু অন্যরকম।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
dunlop river hooghly

নদীই জীবন, নদীতেই যাপন। ছবি: শশী ঘোষ

পঞ্চদশ শতাব্দীতে কবি বিপ্রদাস পিপলাই মনসামঙ্গলে লিখে গেছেন, 'গঙ্গা আর সরস্বতী/ যমুনা বিশাল অতি/ অধিষ্ঠান উমা মহেশ্বরী।' গঙ্গা, যমুনা, সরস্বতী, এই তিন নদীর মিলনস্থলই হল ত্রিবেণী সঙ্গম। আর এই সঙ্গমের প্রধান গঙ্গা নদী, হুগলির জেলা সদর চুঁচুড়ার বুক চিরে একেঁবেঁকে চলে গিয়েছে বাঁশবেড়িয়া শহরের উপর দিয়ে। পঞ্চদশ শতাব্দীর গঙ্গাপারের এই প্রাচীন শহরের ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট ছাড়া তেমন কোনও বড় পরিবর্তন চোখে পড়ে না আজও। তবে এই শহরের পাশ দিয়ে বয়ে চলা গঙ্গার যে অনেক পরিবর্তন হয়েছে, তা স্বীকার করবেন অনেকেই।

Advertisment

মাঝ গঙ্গায় মাথা উঁচিয়ে রয়েছে চর, ইংরেজিতে যাকে বলে 'স্যান্ডব্যাঙ্ক' (sandbank)। এই চরেই গড়ে উঠেছে নতুন জীবন-জীবিকা। কলকাতা থেকে গঙ্গা ধরে উত্তরে এগোলেই প্রথমে পড়বে বাঁশবেড়িয়ার ডানলপ চর। নদীর বুকে এরকম চড়া পড়ে গিয়ে বসতি গড়ে ওঠা নতুন ব্যপার নয়। চর যে নদীর সুস্বাস্থ্যের লক্ষণ নয়, তা বুঝলেও আপাতদৃষ্টিতে মানুষেরও কিছু করার নেই বলেই মনে হয়।

dunlop river hooghly চর যে নদীর সুস্বাস্থ্যের লক্ষ্মণ নয়, তা জেনেও এখানে কারোর কিছু করার নেই। ছবি: শশী ঘোষ

dunlop river hooghly যাতায়াতের একমাত্র উপায় হলো নৌকো। ছবি: শশী ঘোষ

কলকাতা শহরের এত কাছে চরের বসতি খুব একটা দেখা যায় না। তবে ডানলপ চরের বাসিন্দাদের জীবনযাপন একটু অন্যরকম। একপার থেকে আরেক পারে অর্থাৎ চরে যেতে হলে চিৎকার করে নৌকো ডাকতে হয়। এখানকার বাসিন্দাদের যাতায়াতের একমাত্র মাধ্যমই হলো নৌকো। প্রতিটি পরিবারেরই একটি করে নৌকো আছে। এখানের ছেলে, মেয়ে, বুড়ো সকলেই নৌকো বাইতে জানেন। আর পাঁচটা ঘরের ছেলেমেয়ে যেখানে সাইকেল চালানো শিখে বড় হয়, সেখানে এই চরের খুদেরা শেখে নৌকো চালানো। বাজারহাট, স্কুল-কলেজ, হাসপাতাল, সবই তো নদীর ওপারে।

ডানলপে এই চর কবে সৃষ্টি হয়েছে, তা কেউ মনে করতে পারেন না। বাঁশবেড়িয়া থেকে ডানলপ ঘাটে এসে পূর্বদিকে হঠাৎ তাকালে এই চরকে গঙ্গার ওপার বলেই মনে হয়। ডানলপ ঘাটের ধারে ৩০ বছর ধরে মুদির দোকান চালান বছর ষাটের সুকান্ত মণ্ডল। তাঁর বক্তব্য, তিনি ছোটবেলা থেকেই এই চর দেখছেন, এবং চরের বয়স নয় নয় করে একশো পার হয়ে গিয়েছে বলে তাঁর ধারণা।

dunlop river hooghly সামান্য কাদামাটি পেরিয়ে চরে পা দিলেই দেখা যায়, আস্ত একখানা গ্রাম। ছবি: শশী ঘোষ

dunlop river hooghly প্রতিবছর বর্ষায় জল উঠে আসে এই চরে। বাড়িঘর ভেঙ্গে যায়। ছবি: শশী ঘোষ

ওই চরে যেতে হলে এই পার থেকে হাঁক দিতে হয়। সামান্য কাদা-মাটি পেরিয়ে চরের জমিতে উঠতেই দেখা যায়, আস্ত একখানা ছোট্ট গ্রাম। শান্তি মাহাতো চল্লিশ বছর আগে বিয়ে করে এখানে এসেছিলেন। তারপর থেকে এখনও এখানে। গঙ্গা দিয়ে বয়ে গিয়েছে অনেক জল। বদলে গিয়েছে নদীর গতিপথও। বদলায়নি শুধু এখানকার মানুষের জীবনযাপন। আগে এই চরে ছিল ৩০ থেকে ৪০টি পরিবারের বাস। এখন তা কমে দাঁড়িয়েছে দশে। প্রতিবছর বর্ষায় জল উঠে আসে এই চরে। বাড়িঘর ভেঙ্গে যায়। সেই সময় এখানকার বাসিন্দাদের মাথা গোঁজার ঠাঁই হয় শ্মশান।

চরের অনেকটা জুড়েই নানারকম সবজির চাষ হয়েছে। আছে আম, বাতাবি লেবু, পাতিলেবু, জাম, কাঁঠালের পাশাপাশি নারকেল, সুপারি, তালগাছও। আর আছে চরজুড়ে প্রচুর কুলের গাছ। গোলাবিয়া দেবী সকালবেলা নৌকো চালিয়ে ডানলপ বাজার থেকে বাজার নিয়ে আসেন। নিজের হাতে সবজির ক্ষেত পরিচর্যা করেন। বাতাবি লেবু গাছে নতুন ফল ধরায় বেজায় খুশি। এই চরেই বিয়ে দিয়েছেন ছেলে রাজুর। নতুন বউয়ের সঙ্গে নদীতে মাছ ধরতেও যান।

dunlop river hooghly ভোটের আগে নেতারা নৌকো করে আসেন, ভরসা দিয়ে যান গঙ্গার পাড়ে নতুন বসতি করে দেওয়ার। ছবি: শশী ঘোষ

এখানকার ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের খেলা বলতে গাছে চড়া, সাঁতার কাটা, আর নদীতে গামছা দিয়ে চিংড়ি মাছ ধরা। এই চরে আগে যাঁরা থাকতেন, তাঁরা অনেকেই কলকাতায় কাজ করতে এসে কিছু পয়সা জমিয়ে শহরে ঘর ভাড়া করে চলে গিয়েছেন। গোলাবিয়া দেবীর মতন যাঁরা আছেন, তাঁরা এখানেই চাষবাস করে মাছ ধরে জীবন জীবিকা চালিয়ে যাচ্ছেন।

৭০ বছরের রাম দীনু ঝাড়খণ্ড থেকে কলকাতায় এসেছিলেন। এরপর ভাগ্যচক্রে এখানে চলে আসা। এই চরে যাঁরাই থাকেন, সবাই নৌকো রাখার জায়গাও নির্দিষ্ট করে নিয়েছেন। প্রত্যেকবার ভোটের আগে নেতারা নৌকো করে এখানে আসেন, ভরসা দিয়ে যান গঙ্গার পাড়ে নতুন বসতি করে দেওয়ার। এসব যে মিথ্যে প্রতিশ্রুতি, তা এতদিনে রাম দীনু বুঝে গিয়েছেন।

dunlop river hooghly ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের খেলা বলতে গাছে চড়া, সাঁতার কাটা, আর নদীতে গামছা দিয়ে চিংড়ি মাছ ধরা। ছবি: শশী ঘোষ

উন্নতি বলতে শুধু হয়েছে জলের। জল সমস্যা মেটাতে গত বছর এখানে একটি কল বসানো হয়েছে। কিন্তু এখনও বিদ্যুতের লাইনও পৌঁছয়নি। চরের জমিতে চাষ করা থেকে শুরু করে গঙ্গায় মাছ ধরা, নৌকো বেয়ে ওপারের হাটেবাজারে গিয়ে সেই সব সবজি, মাছ বেচে ঘর-সংসার চালানোর কাজ করে চলেছেন বাসিন্দারা। যারা স্কুলে পড়াশোনা করছে, তারা স্বপ্ন দেখে, একসময় ডাঙ্গায় নিজেদের স্থায়ী ঠিকানা বানানোর। বয়স্করা মনে করেন, যতদিন মা গঙ্গা এই চরকে নিজের বুকে টেনে না নেন ততদিন এখানে এভাবেই বাঁচবেন তাঁরা। এই একটুকরো জমির পাহারাদার হয়েই।

kolkata news
Advertisment