Advertisment

লোকসভা নির্বাচন ও সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা

আজকের দিনে সংবাদপত্রের একটা বড় আয় সরকারি বিজ্ঞাপন। কেন্দ্র বা রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে লিখলে সে বিজ্ঞাপন বন্ধ হয়ে যাচ্ছে কিনা তার সঠিক পরিসংখ্যানও সাংবাদিক হত্যার মত আর একটি গুরুত্বপূর্ণ সূচক।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
NULL

সংবিধান বর্ণিত বাক-স্বাধীনতার সঙ্গে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার প্রত্যক্ষ সম্পর্ক আছে

লোকসভা নির্বাচন দোরগোড়ায়। রাজনীতিটির সবটাই তো আর উচ্ছের রসের পর নকুলদানা নয়। তবে ভাষা সন্ত্রাস অবশ্যই ভারতীয় রাজনীতির (বলা ভালো বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গের) একটা বিশেষ সমস্যা। রাজনীতি সচেতনতা এ রাজ্যে কমেছে অনেকটা। তবু তুলনায় রাজনীতির আর একটু গভীর বিষয় নিয়ে আলোচনা করার দায় থেকেই যায়। তার পেছনে মূল যুক্তি হল রাজনীতি তো আর ছেলেখেলা কিংবা গুণ্ডামো নয়। রাজার নীতিও নয়। রাজনীতি হল নীতির রাজা। রাজা মানেই সৎ এবং স্বচ্ছ হতে হবে এমনটাও কেউ সংজ্ঞায়িত করে যান নি। তবে রাজা বলতে সাধারণত আমরা উৎকর্ষতার কথা ভাবি। সেই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে আর একবার ফিরে দেখা যাক রাজনৈতিক পরিসরে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার বিষয়টি, আসন্ন লোকসভা ভোটের প্রেক্ষিতে। সংবিধান বর্ণিত বাক-স্বাধীনতার সঙ্গে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার প্রত্যক্ষ সম্পর্ক আছে। তাই এই রাজত্বের শেষের দিকে এ প্রশ্নের উত্তর খোঁজা প্রয়োজন যে ছাপান্ন ইঞ্চি ছাতিওলা চৌকিদারের ছাপান্ন মাসাধিক শাসনে জনমতের স্বাধীনতা হননের সূচক ঠিক কতটা ঊর্ধ্বমুখী।

Advertisment

আরও পড়ুন, আমাদের (রাজ)নীতি

এই তুলনা করতে গেলে প্রথমেই যে পরিসংখ্যানে যেতে হবে তা হল সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা। দেখতে হবে ভারত জুড়ে বিজেপি বিরোধী লেখা ছাপা হচ্ছে কতগুলো। তার সঙ্গে তুলনা করতে হবে প্রতিটি রাজ্যে ক্ষমতাসীন দলের বিরুদ্ধে লেখার ঘনত্ব। একটু ভাবলে বোঝা যায় বিজেপি বিরোধিতার হাওয়া দেশজুড়ে যে ভাবে দানা বেঁধেছিল (কিছুটা হাওয়া বদলেছে সীমান্ত সংঘর্ষের পর), সংবাদমাধ্যমে লেখা না প্রকাশিত হলে সে চেহারা বুঝতে অসুবিধে হত অনেক বেশি। যে রাজ্যে বিজেপি ক্ষমতায় নেই, সেখানে তো বিজেপি বিরোধিতা প্রকট। যে রাজ্যে তারা ক্ষমতায়, সেখানেও স্থানীয় খবরের কাগজ কিংবা টেলিভিশনে বিজেপির সমালোচনা যথেষ্ট শুনতে পাওয়া যাচ্ছে। অনেক কাগজেরই আজকাল অন্তর্জাল সংস্করণ আছে। আর বেশির ভাগ বাঙালিই বাংলা ছাড়াও ইংরিজি আর হিন্দিটা মোটামুটি বোঝেন। ফলে উত্তরপ্রদেশে বিজেপি ক্ষমতায় থাকা সত্ত্বেও সেখানে অনেক সময়েই মোদী বিরোধিতার হাওয়া বুঝতে অসুবিধে হয় না। তাহলে কি বিজেপির পক্ষে সংবাদমাধ্যমের একটা অংশ নেই? অবশ্যই আছে। কোন দল যে নিজেদের প্রচারে সংবাদমাধ্যমকে ব্যবহার করবে তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। সংবাদমাধ্যম রাজনীতি-বিচ্ছিন্ন নয়। পাঠক, শ্রোতা বা দর্শকের সংখ্যা বাড়ানোর একটা দায় থাকে সংবাদ বিক্রেতাদের। সেক্ষেত্রে যে দিকে সত্যিকারের হাওয়া বইছে সেই পথে যাওয়া অনেক সময় সুবিধাজনক। আবার অনেক সময় বেসরকারি সংবাদ সংস্থার মালিকপক্ষ কোন একটি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত থাকেন। সেই নিরিখেও কোন একটি সংবাদমাধ্যম এক রাজনৈতিক দলের পক্ষে আবার অন্য কোন দলের বিপক্ষে ঝুঁকে যায়। এই পন্থা সম্পর্কে আজকের পাঠক পাঠিকারা অবহিত।

নতুন মাত্রার প্রশ্ন উঠবে যদি বিরোধী মত প্রকাশ করা সাংবাদিকদের মুখ পুরোপুরি বন্ধ করে দেওয়া হয়। অত্যন্ত সাহসী সাংবাদিক গৌরী লঙ্কেশেকে হত্যা অবশ্যই তার একটা উদাহরণ। বিষয়টি যে অত্যন্ত নিন্দনীয় এবং গণতন্ত্র বিরোধী এ নিয়ে কোন সন্দেহ নেই। পরোক্ষভাবে এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে বিভিন্ন রাজনৈতিক মতের প্রভাব থাকতে পারে। অতি দক্ষিণপন্থী একটি দলের নাম এই ধরণের অপরাধে উঠে এসেছে বারবার। সেই সংস্থা এর আগেও বামপন্থী বুদ্ধিজীবীদের মুখ বন্ধ করতে চেয়েছে হিংসার মাধ্যমে। বিজেপি সমর্থক দুএকটি সর্বভারতীয় ইংরেজি টেলিভিশন চ্যানেল এই হত্যার খবর পরিবেশনে বেশ দায়িত্বজ্ঞানহীন ভূমিকা নিয়েছিল। পারিষদবর্গ এরকমই করে থাকে, তবে এ প্রসঙ্গে অন্য ধারার মত হল তার জন্যে শাসক বিজেপিকে সংবাদমাধ্যমের ওপর সার্বিক নিয়ন্ত্রণের অপরাধে দায়ী করার জায়গা কম। এই অন্যদিকের যুক্তি হল ছত্তিশগড়ের প্রত্যন্ত প্রান্তে অতিবামরা সাধারণ পুলিশ খুন করলে যেমন তার জন্যে কেরালার বাম সরকারকে দায়ী করা যায় না, বিজেপিকেও সেই সুবিধে দিতে হবে। অর্থাৎ এখানে মূল দাবি হল বিজেপি সংবাদমাধ্যমের কণ্ঠরোধ ঠিক কী মাত্রায় করছে সে বিষয়ে সামগ্রিক সিদ্ধান্তে আসতে গেলে আরও বেশি তথ্যের প্রয়োজন।

আরও পড়ুন, ভোট সমীক্ষার শুরুতেই কিছু প্রশ্ন

মনে রাখতে হবে, আজকের দিনে সংবাদপত্রের একটা বড় আয় সরকারি বিজ্ঞাপন। কেন্দ্র বা রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে লিখলে সে বিজ্ঞাপন বন্ধ হয়ে যাচ্ছে কিনা তার সঠিক পরিসংখ্যানও সাংবাদিক হত্যার মত আর একটি গুরুত্বপূর্ণ সূচক। বিজেপি এই দোষে দোষী এবং দেশের বাকি রাজনৈতিক দলগুলি ধোয়া তুলসীপাতা, এরকম স্ট্যাটিস্টিক্স খুব পরিষ্কার নয়। সাম্প্রতিক অতীতে জম্মু-কাশ্মীরের কিছু সংবাদপত্র প্রথম পাতা সাদা রেখে প্রতিবাদ জানিয়েছিল সরকারের বিজ্ঞাপন বন্ধের বিরুদ্ধে। আমাদের রাজ্যেও এই ধরণের অভিযোগ কম ওঠে নি। অর্থাৎ সারমর্ম হল শুধু মোদী সরকারের আমলে ভারতে সংবাদমাধ্যমের যে হঠাৎ করে ব্যাপক স্বাধীনতা হনন করা হয়েছে এমনটা জোর গলায় বলা মুশকিল। ইন্দিরা গান্ধীর আমলে জরুরি অবস্থার সময়ের থেকেই এই ঐতিহ্য বিদ্যমান। বাম রাজত্বেও দুএকবার সংবাদমাধ্যমের কণ্ঠরোধের অভিযোগ উঠেছে। বছর দুই আগে বসুন্ধরা রাজে সরকারের বিতর্কিত আইনের প্রতিবাদে হিন্দি দৈনিক “রাজস্থান পত্রিকা” তাদের সম্পাদকীয়র জায়গাটা সাদা রেখে দিয়েছিল, চারপাশে আঁকা হয়েছিল শুধু মোটা কালো সীমারেখা। সে সরকার অবশ্য বদলেছে। ত্রিপুরায় বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর অল্প সময়ের জন্যে হলেও ঝামেলায় পড়েছিল বাম মনোভাবাপন্ন দৈনিক ডেইলি দেশের কথা। মোদী রাজত্বে এরকম উদাহরণ রয়েছে প্রচুর। আবার খুঁজলে বিজেপি ছাড়াও ভারতের ভিন্ন রাজ্যের শাসকদের ক্ষেত্রে একই অভিযোগ উঠেছে। সমাজবিজ্ঞানে সবসময় প্রমাণ মেলে না, তবে এ রাজ্যেও সংবাদমাধ্যমের একটা বড় অংশকে শাসক দলের মন যুগিয়ে চলতে হয় এমন ফিসফিস প্রায়শই শোনা যায়।

আমাদের দেশের মধ্যে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা সংক্রান্ত সঠিক পরিসংখ্যান সেভাবে ধরে রাখা হয় না। তাই গণমাধ্যমের স্বাধীনতার সূচকে কার পরিসংখ্যান ব্যবহার করে স্বস্তি পাবেন, আন্তর্জালের যুগে সে আপনার নিজের অধিকার।

রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্স সংস্থার হিসেবে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার নিরিখে মোট ১৮০টি দেশের তালিকায় ২০১৮তে ভারতের স্থান ১৩৮। তার আগের বছর তা ছিল ১৩৬, ২০১৬ তে ছিল ১৩৩, আর ২০১৫-য় ১৩৬। বাকি অঙ্কটুকু থাক আপনার পেন্সিলের সিসের ডগায় আর চান যদি তাহলে মুঠোফোনে খুঁজতে পারেন আরও কিছু তথ্য। সেটুকু স্বাধীনতা এখনও এ দেশে আছে। তবে শাসকদের টুঁটি চেপে ধরার গল্পগুলো মোটেও আজকের নয়, তার ইতিহাস অনেক গভীরে। আর সেজন্যেই তো বহুব্যবহার সত্ত্বেও অজীর্ণ চিরন্তন কিছু উদ্ধৃতি, যা বারবার ফিরে ফিরে আসে অসহায় রচনায়।

আরও পড়ুন, রাষ্ট্র, সরকার, দেশ: প্রেম

“সংবাদপত্র যতই অধিক এবং যতই অবাধ হইবে, স্বাভাবিক নিয়ম-অনুসারে দেশ ততই আত্মগোপন করিতে পারিবে না। যদি কখনো কখনো ঘনান্ধকার অমাবস্যারাত্রে আমাদের অবলা ভারতভূমি দুরাশার দুঃসাহসে উন্মাদিনী হইয়া বিপ্লবাভিসারে যাত্রা করে তবে সিংহদ্বারের কুক্কুর না ডাকিতেও পারে, রাজার প্রহরী না জাগিতেও পারে, পুররক্ষক কোতোয়াল তাহাকে না চিনিতেও পারে, কিন্তু তাহার নিজেরই সর্বাঙ্গের কঙ্কণকিঙ্কিণীনূপুরকেরয়ূর, তাহার বিচিত্র ভাষার বিচিত্র সংবাদপত্রগুলি কিছু-না-কিছু বাজিয়া উঠিবেই, নিষেধ মানিবে না। প্রহরী যদি নিজহস্তে সেই মুখর ভূষণগুলির ধ্বনি রোধ করিয়া দেন তবে তাঁহার নিদ্রার সুযোগ হইতে পারে, কিন্তু পাহারার কী সুবিধা হইবে জানি না।”

জনগণের আওয়াজ কানে তোলার দরকার নেই, বিভিন্ন দলের লবণ বিলোনো চৌকিদার এবং ঢাকের চামড়ায় কম্পন তোলা সম্পদেরা রবীন্দ্রনাথের বাণী শুনবেন কি?

(লেখক ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইন্সটিটিউটের অধ্যাপক, মতামত ব্যক্তিগত।)

Advertisment