Advertisment

কলকাতার বিখ্যাত লর্ড সিনহার বাড়িতে দগ্ধ নাতি-নাতনি

সন্দেহ দানা বাঁধল। মামলা হল ঠিকই। কিন্তু এমন নামী ও প্রভাবশালী আইনজীবী সিনহা পরিবারের পক্ষ থেকে দাঁড় করানো হল যে...

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
NULL

অলঙ্করণ: অভিজিৎ বিশ্বাস

সত্তরের দশকের পার্কস্ট্রিট। সে এক অন্য কলকাতা। সন্ধে নামলেই বিদেশি গাড়ির আনাগোনা। নানা রেস্তোরাঁ। গ্লাসের টুংটাং। ভিনদেশি পারফিউমের সুবাস। জ্যাজ- ব্লুজের সুরে শরীর ডুবে যাওয়া। সম্ভ্রান্ত মানুষের সাহেবিয়ানা। কেতাদুরস্ত চাল- বোল। আলো-আঁধারির মাঝে হঠাৎ নিয়ন আলোর রঙিনতা। এমনই এক মাহোলে আলাপ হল ছেলে-মেয়ে দুটোর। এলিট বাঙালি বাড়ির ছেলের সঙ্গে প্রেম হয়ে গেল এক অ্যাংলো ইন্ডিয়ান কন্যার। প্যাট্রিসিয়াকে ভালোবেসে ফেললো সুশান্ত।

Advertisment

কেমন করে আলাপ? প্যাট্রিসিয়ার দাদা জন আর্থার পিয়ানো বাজাতেন পার্ক স্ট্রিটেরই এক রেস্তোরাঁয়। তাঁর সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছিল সুশান্ত-র। জনই একদিন বোনের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেন। দার্জিলিংয়ে সেন্ট যোসেফ স্কুলে পড়া, কলকাতায় সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের ছাত্র সুশান্তর মধ্যে ইংরেজি আদপের প্রতি একটা ভালোবাসা এসেই পড়েছিল। প্যাট্রিসিয়াকে পেতে চাওয়া যেন সেই অনুরাগেরই একটা পরিবর্ধিত রূপ। সুশান্ত-র পরিবার কিন্তু বিষয়টিকে একেবারেই ভালো ভাবে নিতে পারলো না।

publive-image

সুশান্ত-র মহা-পরিবারের দিকে একবার চোখ বুলিয়ে নেওয়া যাক। সুশান্ত-র বাবা সুধীন্দ্র প্রসন্ন-র ঠাকুর্দা সত্যেন্দ্র প্রসাদ সিনহা-র জন্ম ১৮৬৩ সালে। পড়াশোনা বিলেতে। অবিভক্ত ভারতে তিনিই প্রথম ‘লর্ড’ উপাধি লাভ করেন। ভারতের প্রথম অ্যাডভোকেট জেনারেল হন। হয়েছিলেন নিখিল ভারত কংগ্রেস কমিটির সভাপতি। প্রভাবশালী মানুষজনের সঙ্গে তাঁর ওঠা-বসা ছিল। রবি ঠাকুরের সঙ্গেও ছিল বন্ধুত্ব। তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়েই তাঁদের বাড়ির সংলগ্ন রাস্তার নাম রাখা হয় লর্ড সিনহা রোড। সুশান্ত-র বাবা সুধীন্দ্র প্রসন্ন ছিলেন ম্যাকলিন অ্যান্ড মেগোরের চেয়ারম্যান। কালো সাহেবের মেয়ের সঙ্গে প্রেমটা এমন বাড়ির লোকেরা মেনে নিতে পারলেন না।

কিন্তু প্রেম তো তখন দুর্বার। তাই পরিবারের অমতেও প্যাট্রিসিয়াকে বিয়েটা করেই ফেললেন সুশান্ত। সেটা ১৯৭২ সাল। বাড়িতে রাশভারি বাবার সঙ্গে স্বাভাবিক হওয়া কঠিন। তাই অসমের চা বাগানে চাকরি নিলেন সুশান্ত। সেখানে সত্যি ভালো সময় কাটালেন দুজনে। চা বাগানের সবুজে, খোলা আকাশের মাঝে, প্রকৃতির সান্নিধ্যে পরস্পরের প্রেমে ডুবে রইলেন দুজন। তিন বার সন্তানের জন্ম দিলেন প্যাট্রিসিয়া। সংসার সুখে, শান্তিতে ভরে গেল। ৭৮ সালে তাঁরা কলকাতায় ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নিলেন। ভাবলেন এতদিন পর বাড়ি ফিরলে নাতি-নাতনিদের দেখে সকলে আগের সবকিছু ভুলে তাঁদের আপন করে নেবেন।

ভুলটা হয়ে গেল সেখানেই। সিনহা পরিবার প্যাট্রিসিয়াকে আবারও প্রত্যাখ্যান করলো। আবার সুশান্তর সঙ্গে সম্পর্কটাও দুর্বল হয়ে গেল প্যাট্রিসিয়ার। বড় মেয়ে ক্যারোলিনাকে নিয়ে রিপন স্ট্রিটে নিজেদের বাড়িতে ফিরে গেলেন তিনি। ছোট শ্যেন আর শ্যারনকে তিনি রেখে গেলেন সিনহা বাড়িতে। মাস ঘুরতে না ঘুরতেই ঘটে গেল একটা ভয়াবহ ঘটনা। সিনহা বাড়ির তিন তলায় আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেল শ্যেন-শ্যারন।

আরও পড়ুন: মাদার টেরিজার লাখ লাখ টাকার চেক জালিয়াতি, পার্কস্ট্রিট খেকে সিঙ্গাপুরে লালবাজার!

আগুন লাগলো নাকি লাগানো হল, এই প্রশ্নে তখন সংবাদপত্রের পাঠকরা জেরবার। অনেকগুলো প্রশ্ন উঠল। তিন তলার অন্য একটি ঘরে সুশান্ত ঘুমাতেন। তিনি কেন বুঝতে পারেননি যখন আগুন লাগলো। সুশান্ত-র বিবাহ-বিচ্ছিন্না বোন মঞ্জুলাও তিনতলাতেই ঘুমাতেন তাঁর ছেলে জিগমিকে নিয়ে। তিনিও বুঝতে পারেননি! আবার সুশান্ত-র বাবাও জানিয়ে দেন, ঘুমিয়ে ছিলেন বলে বুঝতে পারেননি। পরিবারের কেউ আবার বললেন, শর্ট সার্কিট থেকে আগুন লেগেছে। আশ্চর্যের ব্যাপার, দমকলকে নাকি সিনহা পরিবার থেকে কেউ ফোন করেনি। আতঙ্কিত হয়ে ফোন করেন এক প্রতিবেশী।

বাইরের লোক এবং প্যাট্রিসিয়ার বাড়ির লোক অন্য যুক্তি তুললেন। তাঁদের মত ছিল, প্যাট্রিসিয়ার সঙ্গে নিজেদের পরিবারের যোগসূত্র মুছে দিতে চাইছিল সিনহা  পরিবার। আবার মঞ্জুলাও নাকি চাইছিলেন তাঁর সন্তানই সিনহা পরিবারের সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হোক। যাহোক, ঘটনার পর সুধীন্দ্র প্রসন্ন, তাঁর স্ত্রী অঞ্জু, কন্যা মঞ্জুলা, পুত্র সুশান্তকে পুলিশ নিজের হেপাজতে নিল। জেরা করল। সন্দেহ দানা বাঁধল। মামলা হল ঠিকই। কিন্তু এমন নামী ও প্রভাবশালী আইনজীবী সিনহা পরিবারের পক্ষ থেকে দাঁড় করানো হল যে প্যাট্রিশিয়া-রা দাঁড়াতেই পারলেন না অসম লড়াইয়ে। সিনহা পরিবারের অভিযুক্তরা বেকসুর খালাস পেলেন। তিন আর চার বছরের দুটো শিশু শ্যেন আর শ্যারনের আগুনের পুড়ে মারা যাওযার যন্ত্রণাদগ্ধ চীৎকার হারিয়ে গেল আদালতের বিপুল হই-চইয়ের মধ্যে। তারা সুবিচার পেলো তো?

(গত কয়েক দশকে কলকাতার নানা অপরাধমূলক ঘটনার সময়ে তখনকার সংবাদপত্র ও পত্রিকায় প্রকাশিত খবর এবং ক্রাইম সংক্রান্ত নানা বইয়ে প্রকাশিত তথ্যের ভিত্তিতেই প্রকাশ করা হচ্ছে এই ফিচার-ধর্মী কলামটি। সংশ্লিষ্ট বিষয়ের তথ্য,অপরাধী-আইনজীবী, বাদী-বিবাদী পক্ষ, পুলিশ-গোয়েন্দা, মামলার খুঁটিনাটি ইত্যাদির দায় কোনও অবস্থাতেই এই প্রতিবেদক কিংবা ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা-র নয়। শহরে শোরগোল ফেলে দেওয়া ক্রাইমগুলির কয়েকটি এ কলামে গল্পাকারে শোনাতে চাওয়া হয়েছে মাত্র।)

ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন

Advertisment