/indian-express-bangla/media/post_attachments/wp-content/uploads/2020/01/bhanga-ayna-LEAD.jpg)
অলঙ্করণ: অভিজিৎ বিশ্বাস
আমরা বলে থাকি দুর্গাপূজা বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসব। আমরা, মানে মধ্যবিত্ত হিন্দু বাঙালিরাই এটা বলি। এটা বলি, এবং দেশের বাকি বাঙালিদের ওপর চাপিয়ে দিতে চাই। চাপানোর বেশ কিছুটা কাজ হয়েও গেছে। আজকাল রাঢ়ের লোকেরাও সমারোহে দুর্গোৎসব করে। দুর্গাপূজাটার মধ্যেই বেশ একটু হৈহৈ ভাব আছে। ক্যানভাসটা বেশ বড়। কত বৈচিত্র্য। মাঝখানে যুদ্ধ হচ্ছে, আর কী অদ্ভুত ব্যাপার। মেয়াছেলের কাছে হেরে যাচ্ছে হদ্দমদ্দ ব্যাটাছেলে। একদিকে ফর্সাপানা বিদ্যেদেবী, অন্যদিকে হলুদমুখো টাকাপয়সার দেবী। বাবরি চুল নিয়ে কার্ত্তিক তার ধনুক বাগিয়েছে। নির্ঘাত একটা বুনো মুরগী দেখেছে, শিকার করে ফেলবে...রাঢ়ের লোকেরা এরকম মূর্তি দেখে অবাক হয়েছে। জমিদারবাবুদের বাড়িতে পুজো, ঢাক, বাদ্যি, হুলাহুলি টানা চারদিন ধরে...অবাক হয়েছে রাঢ়ের মানুষ, কিন্তু দুর্গাপুজোকে নিজেদের উৎসব বলে সহজে মেনে নেয়নি।
উৎসব তো শুরু করেছিলেন রাজা নবকৃষ্ণ দেব। পলাশীর যুদ্ধে সিরাজ হারল, ক্লাইভ জিতল। ক্লাইভকে 'ট্রিট' দিতে হবে, কারণ ক্লাইভের হাতেই নবকৃষ্ণের ব্যবসাপাতির চাবি। তখন দুর্গোৎসব করলেন বাড়িতে। খাওয়াদাওয়া, বাদ্যি, বাইজী - এলাহি ব্যবস্থা করে ক্লাইভ সহ কোম্পানির উপরওয়ালাদের ডাকলেন। শোভাবাজারের দেখাদেখি অন্যান্য রাজা-জমিদার-মুৎসুদ্দিরাও ক্রমশ চালু করে দিল দুর্গাপুজো, জমিদারবাড়ি আর বড়লোকের বাড়ি থেকে বাইরে নিয়ে এল গুপ্তিপাড়া, পরে বাগবাজার-সিমলে পাড়া। 'বারো ইয়ারি' বা বারোয়ারী পুজো শুরু হলো। শহর থেকে ক্রমশ গ্রামে ঢুকল। দুর্গাপুজোর জাঁকজমকের সঙ্গে পেরে উঠল না মকর-মনসা।
আসলে মকরই হলো বাঙালির আদি উৎসব, এবং ধর্ম বিবর্জিত উৎসব। মকর উৎসব একেবারেই ধর্মীয় উৎসব নয়। এই উৎসব আসলে নতুন বছরের উৎসব। তখনও বৈশাখ থেকে নতুন বছরের হিসেব চালু করেন নি আকবর বাদশা। মাঘ থেকেই বছর শুরু হতো, পৌষ সংক্রান্তি ছিল বছরের শেষ দিন।
আমরা ছোটবেলায় ভূগোল বইতে পড়েছিলাম ২০শে মার্চ আর ২৩শে সেপ্টেম্বর দিনরাত সমান থাকে। ২১শে জুন সবচেয়ে লম্বা দিন। আর ২১শে ডিসেম্বর সবচেয়ে ছোট দিন। এই ২১শে ডিসেম্বর আর পৌষ সংক্রান্তি একই সময় পড়ত উত্তর গোলার্ধে। সবচেয়ে ছোট দিনের পর থেকেই দিন একটু একটু করে বাড়তে থাকত। মানুষের মনে আনন্দ আসত। নতুন বছরের সঙ্গে এই বাংলায় মিলে যেত নতুন ধান। অঘ্রাণ-পৌষেই ধান উঠত।
খেজুরের গাছ রস দিতে শুরু করত, ট্যাংরা-পার্শেদের পেটে ডিম, জলও কমে এসেছে, মাছও ধরা পড়ছে এন্তার। সারা বর্ষা ভালো খাওয়াদাওয়া করে মাছেরা বেশ গায়ে গতরে হয়েছে। ঘরের চালায় নতুন লাউ, উঠোনে ধনেপাতা, মুলো, এই তো উৎসবের সময়। বর্ষা নেই, রোদ্দুরটা মিঠে। ফুল পাতাও, মিতে পাতাও, সারা দুপুর হাডুডু খেলো, হাটে চালাও মুরগীর লড়াই, তাসের জুয়া। পিঠে বানাও, কতরকমের পিঠে।
এই সময়ই যতরকমের মেলা। প্রকৃতিটা এই সময়ে যেন স্নো-পাউডার মেখে, সেজে থাকে। মানুষের মনেও বেশ উড়ন উড়ন ভাব থাকে। মানুষ, ঘুড়ি হয়ে যায়। রাঢ়ের মানুষ টাকা জমায়, মকরের নতুন জামাকাপড়ের জন্য। পরিবারের সবাই যতটা পারে নতুন জামাকাপড় পরে। মেয়েরা মাথায় সাদা ফুল গোঁজে। মেলায় গিয়ে বেলুন ফাটায়, দিলীপ কুমার, সায়রা বানু থেকে অমিতাভ বচ্চন, ঐশ্বর্য্যা রাই, কিম্বা ফোয়ারাওয়ালা জমিদারবাড়ি বা তাজমহল কিম্বা যা কখনও হবে না এমন ছবি পেছনে রেখে ছবি তোলে। পেছনে লালরঙের চারপেয়ে গাড়িও হতে পারে।
একটা মকর মেলার কথা বলি, চাইবাসার কাছাকাছি একটা পাহাড়ের পাশে। বাঙালি, কুর্মি, মাহাতোদের সঙ্গে মুন্ডা এবং হো-রাও আছে। নাগরদোলা, মরণকূপের খেলা, ইলেকট্রিক যুবতী - এসবও আছে। আর ছিল বেশ কিছু ফটোক তাম্বু। মানে স্টুডিও আর কী। স্টুডিওগুলি স্বপ্ন বিক্রি করে। মনের ইচ্ছেগুলোকে রূপবান করে। বেশ কিছু কাট-আউট থাকত। প্রমাণ সাইজের মানুষ। কেউ বুট, স্যুট, হ্যাট পরা সাহেব, কেউ বা চোগা, চাপকান, পাগড়ি পরা মহারাজা, কোনও কাট-আউটের গায়ে জামা নেই, প্রশস্ত বুক, পেশি, মাসল, সেভেন-প্যাক, নাইন-প্যাক, ইত্যাদি, এইসব কাট-আউটের মুখ নেই। মুখ যেখানে থাকার কথা, সেখানে নিজেদের মুখ বসে যাবে।
ওরকম ফাইভ-প্যাক বা সেভেন-প্যাক আটচল্লিশ ইঞ্চি ছাতির যে কবন্ধ কাট-আউট, তার ঠিক পেছনে দাঁড়িয়ে যাবে হাড় জিরজিরে বত্রিশ ইঞ্চি ছাতির সুখেন্দু মাহাতো। যদি বেঁটে হয়, ইটের বন্দোবস্ত আছে। ইটের ওপর দাঁড়িয়ে মুণ্ডুটা সেট করে দেবে। নিত্যানন্দ মাহাতোর ছবি উঠবে। ছবিটা নিয়ে হয়তো বাঁধিয়ে রাখবে। এরকম নিত্যানন্দ মাহাতো, গোপাল খুঁটিয়া, লখাই বাগদিরা দশ-বিশ টাকা খরচ করে মহারাজা, জমিদার, নবাব, কিম্বা সাহেবও হয়ে যেতে পারে। শুধু সেইসব কবন্ধ কাট- আউটের পেছনে দাঁড়িয়ে মুণ্ডুটা সেট করে দিলেই হলো। ভ্যানচালকটি মহারাজা, হোটেলের বয় নবাব। আবার মহিলাদের জন্যও বন্দোবস্ত আছে। চোলি আর জরির ঘাগরা পরা বডি আছে। ওর গলার উপরে মুণ্ডুটা ফিট করে দিচ্ছে হাটে মহুয়া বেচা সুফলা মান্ডি।
আবার অন্যরকম ইচ্ছাপূরণও আছে। কোনও ধনঞ্জয় সাধু করিশমা কাপুরের কোমর ধরে নেত্য করতে চাইলেই করতে পারে। করিশমার কোমরটা ধরে দাঁড়িয়ে যাও, ক্যামেরার দিকে চাও। ক্যামেরা বলল ওয়ান টু থিরি। ব্যস, হয়ে গেল। শাহরুখ আছেন, বচ্চন আছেন, মিঠুন আছেন, আর ধুতিপরা উত্তমকুমারও। কোনও নবীনচন্দ্র সেনাপতি সস্ত্রীক গিয়েছেন মেলায়, নবীনচন্দ্রের স্ত্রী প্রথমে আড়চোখে, পরে জুলজুল করে উত্তমকুমারের দিকে তাকাচ্ছে। নবীনচন্দ্র বলছেন - শখ মিটিয়ে নাও। মকর মেলায় সব হয়, লজ্জা কোরোনে। নবীনচন্দ্রও দু'কান কাটা, জুয়ায় বসে গেলেন। বিশ টাকা খরচ করে একটা প্লাস্টিকের চামচ আর একটা ছোট বান্ডিল বিড়ি। নবীন তো যাহোক বিড়ির বান্ডিল পেয়েছেন, তিন টাকা দাম। অন্যরা তো একটা টকঝাল লজেঞ্চুষ, ব্যস।
পরপর মেলা হয়ে যায় পৌষ-মাঘ মাসে। ফাল্গুনেও চলে। গালুডি শেষ হলে বান্দোয়ান। তারপর বাঘমুন্ডি, শুধু তাই নয় - বেশ কয়েক জায়গায় মেলা চলে একসঙ্গে। ওদিকে মানকড়, হাঁসোয়া, বানডিহা, কিম্বা পরকুল, রায়পুর, রানীবাঁধের মকর মেলা। নদীর ধারের মকর মেলার আরেক বড় আকর্ষণ হলো টুসু ভাসান। টুসু হলেন ওদিকের এক আঞ্চলিক দেবী। কী করে টুসু দেবীর উৎপত্তি, সেদিকে যাচ্ছিনা এখন, একটা মূর্তি হয়, অনেকটা যেন লক্ষ্মীদেবীর মতো। ধানের থেকে বের হয় তুষ। তুষের দেবী 'তুষু' বা টুসু।
মেয়েরাই টুসুর পুজো করে। একটা মাটির ভাঁড়ে কিছু শস্যের বীজ পুঁতে দেয়। সারা পৌষ মাস সেই মৃত্তিকা ভাণ্ডটিকে যত্নে রাখে। মেয়েরা একসঙ্গে গান গায়। সে গানে সমসাময়িক প্রসঙ্গ-টসঙ্গ এসেই যায়। টুসু লোকসমাজের, বিশেষত মেয়েদের, খুব আপনজন। নিজের দুঃখের কথা বলা যায়, স্বামীর গঞ্জনার কথাও যেমন, কোনও প্রেমিক 'ডিচ' করেছে, সেই নালিশও জানানো যায় টুসুর কাছে।
'অন্য ফুলে গেঞছে ভ্রমর
বল লো টুসু কী করি
ভোমরা জাতির এমন স্বভাব
আমি ক্যান দিব গলায় দড়ি?'
টুসুর কাছে মানসিক সমর্থন চাইছে মেয়েটি। সে বাঁচতে চায়।
টুসুকে নিয়ে যে কতরকমের গান তার শেষ নেই। টুসুকে সঙ্গে নিয়ে বেড়ানোর ইচ্ছে।
'হামার টুসু কাজে যাবেন
পাল্কি চড়ে উ বেলা
ফিরার বেলায় দেখায়ে আনব
কয়লা খাদের জল তোলা'
টুসুকে সাজানোর কথাও বলা হচ্ছে।
'চল গো সঙ্গতি সবাই
খোলাইচণ্ডীর হাটে যাব
সোনো পাউডার চুড়ি কিনে
টুসু ধনকে সাজাব'
যেহেতু মকরে পিঠে পায়েস হয়, টুসুকে পেট পুরে পিঠে খাওয়ানোর ইচ্ছেও রয়েছে গানে। টুসুকে নাগরদোলা চড়ানোর কথাও। একটু ঠাট্টা ইয়ার্কিও। টুসুকে ফেসিয়াল করে দেওয়ার কথাও আছে।
'কে বলে কে বলে লো
হামার টুসু কালো
বিষ্টুপুরের হলদি আনেঞ
টুসুর গা করিব আলো'
উৎসবের ক'দিন টুসুও সাজুগুজু করবে, নিজেরাও করবে। মানে নিজেদের সঙ্গে সঙ্গে টুসুকেও সাজাবে।
মকর পরবে টুকটাক প্রেম প্রেম চলতেই পারে। টুসুকেও সেসব না জানিয়ে থাকা যায়?
'চোখ টিপে চোখ টিপে টুসু
হামার দিকে তাকায়ে
হামিও কী করলাম টুসু
মুখটা দিলাম বাঁকায়ে'
যদিও এত অন্তরঙ্গ সখি টুসু, তবু শেষ অবধি তো দেবীই। তাই বর চাইতেই হয়। আশীর্বাদ ভিক্ষা।
'তুষ তুষলা তুষ তুষলা তোমার কাছে মাগি বর
ধন লক্ষ্মী পুত্র দিয়া পূর্ণ করো আমার ঘর'
আগেই বলেছি, মকর সংক্রান্তিতে এই টুসুকে জলে বিসর্জন করা হয়। মূর্তি সব জায়গায় নেই। আগে কোথাও ছিল না, এখন হয়েছে। সুন্দর করে চৌদোলা সাজিয়ে জলে ফেলা হয়। যেখানে মূর্তি নেই, সেখানে ওই অঙ্কুরিত শস্যের মৃত্তিকা ভাণ্ড। বিসর্জনের সময় একটা গান শুনে চমকে উঠেছিলাম। গানটা হলো -
'জল জল যে করহ টুসু
জলে তুমার কে আছে
মনেতে ভাবিঞে দেখো
জলে শ্বশুরঘর আছে'
এই গানটি যেন শঙ্খ ঘোষের এই বিখ্যাত কবিতাটির লৌকিক রূপ।
'জল কি তোমার কোনো ব্যথা বোঝে?
তবে কেন, তবে কেন জলে কেন যাবে তুমি?
নিবিড়ের সজলতা ছেড়ে?'
------------------------------------------