মহারাষ্ট্রের মালেগাঁও। আম ভারতীয়ের মনে যে শহরের নামের সঙ্গে চিরকাল যুক্ত হয়ে থাকবে 'বিস্ফোরণ' শব্দটি। তবে এবারে বিষয় অন্য। এবারের বিষয় করোনাভাইরাস।
দেখা যাচ্ছে, এপ্রিলের গোড়ার দিকে প্রথম সংক্রমণ ধরা পড়ার পর থেকে মালেগাঁওয়ে সরকারিভাবে মৃত স্রেফ ১২ জন, অথচ গত বছরের তুলনায় শহরে আপাত সাধারণ কারণে মৃতের সংখ্যা বেড়েছে অস্বাভাবিক হারে। ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের হাতে আসা পুরসভার তথ্য বলছে, মালেগাঁওয়ে এপ্রিল মাসে মৃত্যু হয়েছে ৫৮০ টি, যেখানে ২০১৯-এর এপ্রিলে এই সংখ্যা ছিল ২৭৭, অর্থাৎ প্রায় অর্ধেক। এমনকি এ বছরেরও মার্চ মাসের তুলনায় শহরে মৃত্যুর হার বেড়েছে ৪৮ শতাংশ (নীচে দেওয়া চার্ট দেখুন)।
এই অস্বাভাবিক বৃদ্ধির ব্যাখ্যা দেওয়া কঠিন হয়ে পড়ায় কিছু আধিকারিক দোষ চাপাচ্ছেন তালাবন্ধ স্থানীয় বেসরকারি হাসপাতালগুলির ওপর। তবে ব্যাখ্যা খুঁজতে ১০ এপ্রিলের পর থেকে মৃতদের পরিবারের সদস্যদের এলোপাথাড়ি পরীক্ষা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে রাজ্য সরকার। এই সিদ্ধান্তের একটি অন্যতম কারণ এই যে, মৃতদের অনেকেই করোনার উপসর্গ গোপন করেছিলেন, এবং তাঁদের ঘনিষ্ঠরাও সেই কারণে সংক্রমিত হয়েছেন, এই আশঙ্কা ছড়াচ্ছে ক্রমশ।
নাসিক জেলায় অবস্থিত মালেগাঁওয়ের জনসংখ্যা আনুমানিক ৬ লক্ষ। এই জনসংখ্যার প্রায় ৭৯ শতাংশ মুসলমান। গত ৮ এপ্রিল নথিভুক্ত হয় শহরের প্রথম Covid-19 সংক্রমণ ও মৃত্যুর ঘটনা। তারপর থেকে ক্রমশ হটস্পটে পরিণত হয়েছে এই শহর, এবং রবিবার পর্যন্ত সংক্রমণ ও মৃত্যুর সংখ্যা ছিল যথাক্রমে ২২৯ এবং ১২। সরকারি নথি অনুযায়ী, ২৭ এপ্রিলের পর থেকে Covid-19 আক্রান্ত কেউ মারা যান নি।
এদিকে গত বৃহস্পতিবার এই প্রতিবেদক স্বচক্ষে দেখেন, দুঘণ্টার মধ্যে শহরের বৃহত্তম গোরস্থানে কবরস্থ করার জন্য নিয়ে আসা হয় ন'টি দেহ। গোরস্থানের পরিচালক রঈস আহমেদ আনসারি বলেন, "সাধারণত দিনে ছয় থেকে সাতজনকে কবর দিতে হয় আমাদের। গত তিনদিনে আমরা প্রতিদিন ৩০ টিরও বেশি কবর খুঁড়েছি।" চলতি বছরের এপ্রিলে কবরস্থ করা হয়েছে ৪৫৭ জনকে, যেখানে গত বছরের এপ্রিলে কবর দেওয়া হয় মাত্র ১৪০ জনকে।
ওদিকে আধিকারিকরা জানাচ্ছেন, হিন্দুদের মধ্যে শবদাহের সংখ্যা বাড়ে নি বললেই চলে। এবছরের এপ্রিলে দাহ করা হয়েছে ২৬ জনকে, গত বছরের এপ্রিলে সেই সংখ্যা ছিল ২২।
শহরে Covid-19 প্রাদুর্ভাবের মোকাবিলায় গঠিত মালেগাঁও ইমারজেন্সি অপারেশন সেন্টারের দায়িত্বে থাকা আইএএস অফিসার পঙ্কজ আশিয়া জানাচ্ছেন, "এপ্রিলে নিঃসন্দেহে অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে মৃতের সংখ্যা। সংক্রমণ ছড়িয়েছে কিনা, তা দেখতে ১০ এপ্রিলের পর যাঁদের মৃত্যু হয়েছে, তাঁদের পরিবারের সদস্যদের র্যান্ডম টেস্টিং-এর সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমরা।"
এপ্রিলে মৃতদের পরিবারের একাধিক সদস্য, স্থানীয় চিকিৎসক, এবং স্বাস্থ্য আধিকারিকদের সঙ্গে কথা বলেছে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস। এঁদের কারোর কারোর মতে, বেসরকারি হাসপাতাল বন্ধ হয়ে যাওয়া, এবং চিকিৎসা পরিষেবা ব্যাহত হওয়ার ফলেই এই বৃদ্ধি। আধিকারিকরা জানিয়েছেন, পাঁচজন চিকিৎসকের মৃত্যুর পরই আতঙ্ক ছড়ায় হাসপাতালগুলিতে। এঁদের মধ্যে তিনজন Covid-19 আক্রান্ত ছিলেন।
মালেগাঁওয়ের স্বাস্থ্য আধিকারিক গোবিন্দ চৌধুরী বলেন, "এইসব মৃত্যুর একাংশের জন্য লুকিয়ে রাখা করোনাভাইরাস দায়ী কিনা, তা এখনও খতিয়ে দেখতে হবে আমাদের। প্রথমদিকে বেসরকারি হাসপাতাল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সমস্যায় পড়ে মালেগাঁও। অসুস্থ অনেকেই সময়মত চিকিৎসা এবং ওষুধ পান নি, যার ফলে বেড়ে যায় মৃত্যু।"
এই মুহূর্তে ২০ জন করোনা রোগীর চিকিৎসা চলছে কোভিড হাসপাতালে; ৭০ জন রোগী রয়েছেন কোভিড হেলথ কেয়ার সেন্টারে, যেগুলি অপেক্ষাকৃত মৃদু সংক্রমণের চিকিৎসা করছে; আরও মৃদু সংক্রমণের জন্য রয়েছে কোভিড কেয়ার সেন্টার, যেখানে চিকিৎসাধীন রয়েছেন ২৩২ জন, এবং ২৪৫ জন রয়েছেন কোয়রান্টিন সেন্টারে।
রাজ্যের স্বাস্থ্যমন্ত্রী রাজেশ তোপে গত সপ্তাহে মালেগাঁও সফরের পর বলেন, তাঁর নজরে পড়েছে যে উপসর্গ দেখা দেওয়া সত্ত্বেও হাসপাতালে জানাচ্ছেন না অনেকেই। তাঁর কথায়, "বেসরকারি হাসপাতালগুলিকে খোলার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, এবং কালেক্টরকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে যেন সেগুলিতে করোনা ছাড়াও অন্যান্য রোগীদের চিকিৎসা নিশ্চিত করা হয়। বাড়ি বাড়ি সমীক্ষা চালানোর জন্য ফিভার ক্লিনিক এবং মোবাইল ভ্যানও চালু করা হয়েছে।"
তবে বাস্তবে করোনা সন্দেহভাজনদের ক্ষেত্রে ছবিটা এখনও একটু অন্যরকম। যেমন ধরুন ৬০ বছরের শামিম বানো আব্দুল কায়ুমের কথা। গত শনিবার তাঁর শারীরিক অস্বস্তি হচ্ছে বলে জানান তিনি। তাঁর ছেলে তাঁকে নিয়ে যান এক বেসরকারি হাসপাতালে, যেখানে উপসর্গ ধরা পড়ায় তাকে কোভিড সেন্টারে পাঠানো হয়।
তাঁর পুত্র তৌসিফ কায়ুম বলেন, "রবিবার (২৬ এপ্রিল) মা আমাকে ফোনে জানান, মনসুরা হাসপাতালের যে ওয়ার্ডে তিনি আছেন, সেখানে আর একজনও মহিলা নেই, চারদিকে পুরুষ, এবং তাঁর ডায়াবেটিসের ওষুধ দেওয়া হচ্ছে না তাঁকে। সোমবার সকালে পাশের বেড-এর এক পেশেন্ট ফোন করলেন আমাকে বলতে যে তাঁর মনে হচ্ছে মা বোধহয় ঘুমের মধ্যেই চলে গেছেন।"
তৌসিফ আরও বলেন, "আমার ভাই মায়ের দেহ চাদরে মুড়ে নিলেন। সেদিনই আরও দুজন মারা গিয়েছিলেন, তাঁদের দেহও মুড়ে নিলেন। আমার মায়ের লালা পরীক্ষার জন্য নমুনা নেওয়া হলো, কিন্তু রিপোর্ট এখনও আসে নি।" তৌসিফ এবং তাঁর দুই ভাইয়ের পরীক্ষা হয় নি এখনও।
মালেগাঁও পুরসভার ডেপুটি কমিশনার নীতিন কাপাড়নিস বলছেন, "আমাদের অত্যন্ত সীমিত সাধ্যের মধ্যে যতটা পারা যায়, করছি। শহরে এত বেশি মৃত্যু নিশ্চয়ই চিন্তার বিষয়, তবে সকলেই ভাইরাসে মারা যান নি। অনেকেই বেসরকারি হাসপাতাল বন্ধ থাকার ফলে মারা গিয়েছেন। এইসব হাসপাতাল যাতে খোলে, তার জন্য আমরা খুব বেশিমাত্রায় তৎপর হয়ে উঠেছি।"
শহরের জন্য 'কন্টেইনমেন্ট প্ল্যান' গঠন করার দায়িত্বও ডেপুটি কমিশনারেরই। তাঁর বক্তব্য, "অত্যন্ত ঘনবসতির শহর। ১০০ থেকে ১৫০ ফুট জায়গায় ১০-১৫ জন করে থাকেন। এই অবস্থায় সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা খুবই কঠিন। তাছাড়াও বাসিন্দাদের একটা বড় অংশ দৈনিক রোজগারের ওপর নির্ভর। টাকার এবং থাকার জায়গার অভাব, এই দুই মিলে তাঁদের আরও বেশি বিপদের দিকে ঠেলে দেয়।"
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন