কে লেখে? কে লেখে ওঁর চিত্রনাট্য? কে লেখে এত নিখুঁত স্ক্রিপ্ট?
একটা আদতে প্রশাসনিক ঘটনা ঘটল, যা শেষ বিচারে দুই সরকারি সংস্থার মধ্যে দড়ি-টানাটানি ছাড়া কিছু নয়। অথচ তিনি, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, তা থেকে শুধু চূড়ান্ত রাজনৈতিক ফায়দাই তুললেন না, পাশাপাশি কিছু অবিশ্বাস্য সমাপতন ঘটে গেল। এবং এমন একটা সময়ে, যখন এই কাকতালীয় ঘটনাপরম্পরার প্রয়োজন সবচেয়ে বেশি ছিল তাঁর। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে ভূমিকায় নিজেকে দেখতে সবচেয়ে বেশি স্বচ্ছন্দ, কলকাতা পুলিশের সঙ্গে সিবিআই-এর দ্বৈরথ সেই স্ট্রিট ফাইটারের ভূমিকা যেন প্লেটে করে সাজিয়ে দিল তাঁকে। আর, কে না জানে, ঘাত-প্রতিঘাতে ভরা দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে রাস্তাই চিরকাল রাস্তা দেখিয়েছে মমতাকে?
বর্তমান প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি সোমেন মিত্রর ছত্রছায়ায় থাকা অগ্নিকন্যা থেকে তাঁর এ পর্যন্ত উল্কাসদৃশ উত্থানের যাঁরা সাক্ষী, তাঁরা মমতার এই যুদ্ধং-দেহী রূপের সঙ্গে পরিচিত বিলক্ষণ। ক্ষমতায় আসার পর নিজের 'স্ট্রিট ফাইটার' ভাবমূর্তিকে খোলসের মধ্যে রাখতে অনেকটা বাধ্যই হয়েছেন মমতা। কারণ সহজবোধ্য, বিরোধী দলনেত্রী হলে আচরণে লাগাম পরানোর দায় থাকে না। সরকারের প্রধান হলে থাকে। অলিখিত একটা বেড়ি পরানোই থাকে। সে বেড়ি নিজেকে নিয়ন্ত্রণের। তাই রাজীব কুমার কাণ্ডে একবার রাস্তায় নেমে পড়ার সুযোগ পেতেই যে তার সদ্ব্যবহার করতে মমতা ঝাঁপাবেন, তাতে আর আশ্চর্য কী! রাস্তার লড়াইয়ে তো তিনি বরাবরের অপ্রতিদ্বন্দ্বী।
চিট ফান্ড নিয়ে কলকাতা পুলিশের কমিশনার রাজীব কুমারের বাড়িতে সিবিআই-হানা এবং কলকাতা পুলিশের সঙ্গে সংঘাতের কয়েক ঘন্টার মধ্যেই ময়দানে নেমে পড়লেন মমতা। ময় দানবকেও লজ্জা দেবে, এমন দ্রুততায় তৈরি হয়ে গেল ধর্মতলার ধর্না মঞ্চ। প্রকাশ্য রাস্তায়, অসংখ্য মানুষের দৃষ্টির সামনে, এবং সর্বোপরি সাধারণ ভোটারদের নাগালের মধ্যে, ফের একবার 'পথের হদিশ পথই জানে' ভঙ্গিতে বসে পড়লেন সপারিষদ। একটি প্রশাসনিক সংঘাত নিমেষে পরিণত হয়ে গেল রাজনৈতিক ভাল-খারাপের দ্বন্দ্বে, সংবিধান বাঁচানোর লড়াইয়ে। এবং অসম্ভব ক্ষিপ্রতায় তাঁর পয়লা নম্বর শত্রু বিজেপির বিরুদ্ধে দেশের প্রায় সমস্ত বিরোধী দলগুলিকে একত্রিত করে ফেললেন মমতা, বিরোধী নেতানেত্রীদের সমর্থনের স্রোত বইতে শুরু করল আসমুদ্রহিমাচল।
আরও পড়ুন: ‘ঠিক যেন সিঙ্গুর’; মমতার ধর্না মঞ্চ দেখে জনতার প্রতিক্রিয়া
যদি ভাবেন, চিত্রনাট্যের এখানেই শেষ, ভুল। গোটা রাজ্য প্রশাসনকে শহরের ব্যস্ততম মোড়ে এনে ফেলা শুধু নয়, পশ্চিমবঙ্গ এবং কলকাতা পুলিশের বার্ষিক সম্মাননা প্রদান অনুষ্ঠানকেও ঘটিয়ে ফেললেন ধর্না মঞ্চের পাশেই রাতারাতি তৈরি হওয়া অস্থায়ী মঞ্চে। যে অনুষ্ঠান আদতে হওয়ার কথা ছিল আজই, আলিপুরের 'উত্তীর্ণ' সভাগৃহে। প্রিয় পাঠক, মনে রাখুন, পুলিশকে ঘিরেই কিন্তু চলতি বিতর্কের অবতারণা। পরিস্থিতির ফায়দা সুদে-আসলে তুললেন মমতা, পুলিশ পরিবারের কাছে রাস্তায় কর্মসূচি পালনের জন্য ক্ষমা চাইলেন, এবং স্বভাবসিদ্ধ দৃপ্ত ভঙ্গিতে ঘোষণা করলেন, "আমার পুলিশ, দেশের সেরা পুলিশ।"
কে লেখে ওঁর স্ক্রিপ্ট, যা অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠে এমন অভাবিত সমাপতনে?
চিত্রনাট্যের তুরুপের তাস আরও আছে। সত্যাগ্রহ ধর্নার মঞ্চ। কলকাতার সেই মেট্রো চ্যানেল, যেখানে শেষ অবস্থান-ধর্না হয়েছিল ২০০৬ সালে। যার কেন্দ্রে ছিলেন খোদ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, ইস্যু ছিল সিঙ্গুর এবং টাটার ন্যানো কারখানা। তখন তিনি বাম-বিরোধী আন্দোলনে রাজ্যের অবিসংবাদী প্রতীক। সে কর্মসূচি ছিল আমরণ অনশনের, মমতাকে শেষ পর্যন্ত হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়েছিল। তখনও, এবারের মতোই মমতার সামনে ছিল ভোট এবং ২৬ দিনের সেই অনশন বাম সরকারের অবসান এবং তৃণমূল জমানার উত্থানের সোচ্চার ইঙ্গিত দিয়ে গিয়েছিল।
এবার মমতার পাখির চোখ সাংবিধানিক সংকট। ফলে তাঁর রাজনৈতিক বিরোধীরা হয় মুখে কুলুপ আঁটতে বাধ্য হচ্ছেন, নয় এমন সব যুক্তি খাড়া করছেন, যা পাতে দেওয়ার মতো নয়। প্রত্যাশিত ভাবেই এদিনের সম্মাননা প্রদান অনুষ্ঠানের ভাষণে ৩৫৫ ও ৩৫৬ ধারার প্রসঙ্গ তুলেছেন মুখ্যমন্ত্রী। এবং তাঁর তূণে যে ১৪৪ ধারার তীর রয়েছে, সে কথাও জানিয়ে দিয়েছেন।
কী দাঁড়াচ্ছে? আবার রাস্তায় নেমে পড়েছেন মমতা, রাস্তাই যাঁর চিরকালীন গাণ্ডীব, রাস্তাই যাঁর অব্যর্থ পাশুপত।
এই ডামাডোলের দাঁড়ি ঠিক কোথায় গিয়ে পড়বে, বলা কঠিন। তবে মুখ্যমন্ত্রীকে যাঁরা চেনেন-জানেন, তাঁরা বুঝবেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যখন এত গুরুত্ব দিয়ে কোনও রাজনৈতিক আন্দোলনের মাঠে নেমে পড়েছেন কোমর বেঁধে, ভেবেচিন্তেই নেমেছেন। এবং জয় ছাড়া কিছু ভাবছেন না। ভাববেনই বা কেন? রাস্তা তো বরাবর প্রাপ্তির ভাণ্ডার ভরিয়ে দিয়েছে তাঁর, ফেরায়নি তো কখনও।
Read the article in English