কাঠগড়ায় মিডিয়া। পুলওয়ামায় আত্মঘাতী বিস্ফোরণ। ৪৪ জন জওয়ানের মৃত্যু। ভারতের এয়ারস্ট্রাইক। পাকিস্তানের হাতে উইং কম্যান্ডার অভিনন্দন বর্তমানের বন্দিত্ব। পাক প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা। বিস্তর টালবাহানা। এবং অবশেষে কম্যান্ডারের মুক্তি। এই পুরো পর্বে কূটনৈতিক ভাবে ভারত সরকার কাদায় পড়ল না নৈতিক জয় পেল, এসব ছাপিয়েও যা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে, তা হলো মিডিয়ার ভূমিকা।
সন্দেহ নেই, এই রকম ঘটনা, উত্তেজনাময় ঘটনার ক্ষেত্রে মিডিয়ার ব্যাপক ভূমিকা আছে। তথ্য তুলে ধরা, পরিস্থিতি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল করার পাশাপাশি পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষেত্রেও বিশেষ দায়িত্ব আছে। যে কোনও তথ্যই যেমন খবর নয়, তেমনই যে কোনও খবরই যে সদাসর্বদা পরিবেশনযোগ্য নয়, তাও সত্যি। পরিস্থিতির বিচারে কিছু খবরকে সাময়িক পিছিয়ে রাখতে হয়। মিডিয়া তার কর্মপদ্ধতিতে এই সম্পাদনা অনুশীলন করে। অর্থাৎ কোন পরিস্থিতিতে কোন খবরটা কীভাবে পরিবেশিত হবে, তা ঠিক করা মিডিয়ার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। সেরকমই একটা টালমাটাল পরিস্থিতি আমাদের দেশে তৈরি হয়েছিল গত কয়েকদিন। এবং সেখানে মিডিয়ার ভূমিকায় সাধারণ মানুষ যে যারপরনাই অসন্তুষ্ট, তা সোশ্যাল মিডিয়ার দিকে তাকালেই স্পষ্ট বোঝা যায়।
ভারত ও পাক নাগরিকের টুইট চালাচালি ছড়িয়ে পড়েছে সোশ্যাল মিডিয়ায়, যেখানে সরাসরি যুদ্ধবাজ হিসেবে দায়ী করা হচ্ছে মিডিয়াকে। এবং দুই দেশ যখন শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের দিকে এগোচ্ছে, তখন মিডিয়াই যেন যুদ্ধ বাধাতে চাইছিল, অতএব মিডিয়াই যুদ্ধ করুক, এরকম একটা মতবাদ বেশ জোরাল হচ্ছে। মিডিয়াকর্মীদের তো সরাসরি বর্ডারে পাঠানোরও সুপরামর্শ দিচ্ছেন কেউ কেউ। সন্দেহ নেই, প্রশ্ন যখন উঠেছে, তখন মিডিয়ার কাজের পদ্ধতিতে কিছু গাফিলতি নিশ্চিতই আছে। কোথাও হয়তো মিডিয়া যে ভাষা ব্যবহার করেছে, যেভাবে সুর চড়িয়েছে তা অসন্তোষের কারণ হয়ে উঠেছে। নিশ্চিত মিডিয়ার আরও দায়িত্বশীল হওয়া উচিত।
কিন্তু খটকা বাধে এখানেই। মিডিয়া নিজের দায়িত্ব জেনেও পালন করতে পারছে না কেন? কেনই বা মিডিয়াকে নিজেদের চরিত্র বদলে ফেলতে হচ্ছে? কেন এমন ভাষা ব্যবহার করতে হচ্ছে শিরোনামে, যা মিডিয়াচিত নয়? সবই মিডিয়া আর মিডিয়াকর্মীদের ব্যক্তিগত স্বার্থে? ব্যবসায়িক স্বার্থ আংশিক সত্যি হতে পারে, কিন্তু সেটাকেই ধ্রুব ধরে নিলে সত্যের অপলাপ হয়। বরং এক সার্বিক সমস্যা থেকে আমাদের মুখ ফিরিয়ে থাকার প্রবণতাই স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
আরও পড়ুন, তোমার স্থান – ফাঁকিস্তান
“...বুদ্ধিবাদী সংস্কৃতির একটা নীতি আছে। নীতিটা এই যে, শত্রুপক্ষের সব অপরাধ আমরা লেজার রশ্মির তীব্রতা নিয়ে তদন্ত করে দেখব। কিন্তু নিজেদের অপরাধের দিকে কখনও তাকাব না।” নোয়াম চমস্কির এই কথার আশ্রয় নিয়ে এই বিন্দু থেকে আমরা এগোতে থাকি। শুধু একটা ছোট্ট পরিবর্তনের সাহস করি। শত্রুপক্ষ সরাসরি না বলে এখানে আমরা ব্যাপারটাকে অপছন্দের পক্ষ ধরে নিই। এই মুহূর্তে মিডিয়া জনগণের তীব্র অপছন্দের। অভিযোগ, মিডিয়াকর্মীরাই যুদ্ধে উসকানি দিচ্ছেন।
এটা ঠিক, রাষ্ট্র গণমাধ্যমকে চালিত করে সম্মতি আদায়ের ক্ষেত্রে। চমস্কির ভাষাতেই, "লোকে যা চায় না, সে ব্যাপারেও তাদের ক্রমশ এক জায়গায় আনা।" এক্ষেত্রে মিডিয়ার বিরুদ্ধে মূল অভিযোগটা এই বিন্দুতেই যে, মিডিয়ার একটা অংশ যেন জোর করে যুদ্ধে সম্মতি আদায় করতে চাইছিল। কিন্তু এটাও সত্যি যে, মিডিয়ার অভ্যন্তরে সর্বাধিক চালু কথাটি হল, 'লোকে যা চায়'। এই খবর কেন দেওয়া হচ্ছে? না, লোকে চায়। মিডিয়া সকাল থেকে মাঝরাত অবধি যত নিয়ম পালন করে, তার মধ্যে অদৃশ্য ছায়া হয়ে ঘুরে বেড়ায় এই 'লোকে চায়'-এর ভূত। এক্ষেত্রেও কি তার বিশেষ ব্যতিক্রম হয়েছে?
খেয়াল করলে দেখব, গণমাধ্যম যদি সম্মতি আদায়ের চেষ্টাও করে থাকে, তবে অবশ্যই তার টার্গেট অডিয়েন্স আছে। লক্ষ্য যদি ক্রমাগত বিফল হত, তাহলে সে পথ বদলাত। যদি ধরে নিই যে, মিডিয়াই অহোরাত্র যুদ্ধ যুদ্ধ বলে চিৎকার করেছে, তবে নিশ্চিত সেই চিৎকার শোনার লোকও ছিল। নচেৎ ভোক্তার অভাবে যে কোনও ব্যবসার মতোই মিডিয়াও তার কন্টেন্ট বদলাতে বাধ্য হত। এবং এই কন্টেন্ট নির্মাণের ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা নিয়েছে সোশ্যাল মিডিয়া। এটা বেশ কিছুদিন যাবতই হচ্ছে। এবারে এই পরিস্থিতে তা আরো চোখে আঙুল দেওয়া সত্য হিসেবে প্রতীয়মান হল। বাক স্বাধীনতার লাইসেন্সধারী আম্পায়ার হিসেবে সোশ্যাল মিডিয়ার ভূমিকা যদি গত কয়েকদিনের নিরিখে বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, তবে দেখব, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তা যুদ্ধমুখী চিন্তাভাবনাকে ছোটখাটো ফাউল হিসেবে অনুমোদন দিয়েছে। কোথাও লাল কার্ড দেখায়নি।
হ্যাঁ, আপামর আমার আপনার দ্বেষের যেমত উদ্গীরণ সোশ্যাল মিডিয়া মারফৎ প্রতিফলিত হয়েছে, মূলস্রোতের মিডিয়া তা গুরুত্ব সহকারে পর্যালোচনা করেছে। সে দেখেছে, মুখ্য সংখ্যক মানুষ মুখে না বললেও যুদ্ধের উন্মাদনায় ফুটছে। যেন এখুনি শত্রুপক্ষকে আক্রমণ করলে শান্তি হয়। এই অ্যাটিটিউডে তার বেঁধেই মিডিয়া তার চরিত্র ও কন্টেন্ট বদলেছে। কখনও তা মাত্রা ছাড়িয়ে গিয়েছে। এবং আমরা লেজার-রশ্মি ফেলে মিলিয়ে নিয়েছি, সে কতটা অপরাধী বা শয়তান, উন্মাদ এবং যুদ্ধবাজ। কিন্তু পাশাপাশি এও কি দেখেছি, এই মিডিয়াকে ভোক্তা জুগিয়েছে কারা? আমরা নয়! আমরাই কি দেখিনি এই কচকচানিকে? যা মিডিয়ার কাছে ধরা দিয়েছে এইভাবে - এতে মানুষের আগ্রহ আছে, দেখছে, অতএব এই কন্টেন্ট বজায় থাকুক। ফলত মিডিয়াকে এই সুরে কথা বলার ছাড়পত্র অজান্তে বা সজ্ঞানে হয়তো আমরাই দিয়েছি। আমরা তাদের বয়কট করি নি।
দ্বিতীয়ত, স্ব-নিয়ন্ত্রণের সহজপাঠ আমাদেরও কি ততখানি আয়ত্তে আছে? ভিড়ে গুজব ছড়ালে পদপিষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা আছে। এ সত্য জানা বলেই কেউ সে কাজ পারতপক্ষে করে না। তেমনই দেশের এই কঠিন পরিস্থিতে আমরা কি বিন্দুমাত্র আত্মসংযমের পরিচয় দিয়েছি? বরং আমারা মত প্রকাশের স্বাধীনতা নামে শিখণ্ডিকে সামনে রেখে এমন সব কথা অহরহ বলে গেছি যাতে যুদ্ধের ইঙ্গিত প্রচ্ছন্ন ছিল। প্রতি পোস্টেই প্রায় অলিখিত যা লেখা ছিল, তা হল, পাকিস্তানকে 'সবক' শেখাতে মারো ওদের। ও যে ভাষায় বোঝে তাতেই জবাব দাও। এখন, আমরা এও জানি যে, আমাদের এই কথা আমাদের ইনস্ট্যান্ট গ্র্যাটিফিকেশন এনে দেবে, এরকম পরিস্থিতিতে আমাকে প্রাসঙ্গিক করে রাখবে ঠিকই, কিন্তু তাতে বৃহত্তর কোনও উদ্দেশ্য সাধিত হবে না। তাও আমরা বলেছি, বলে চলেছি।
এই সামগ্রিক পরিস্থিতি যে সুর বেঁধে দিয়েছে, মিডিয়ার সুর কি তার থেকে খুব ভিন্ন ছিল? হ্যাঁ, কিছু মানুষ এর বিপক্ষে নিশ্চিতই ছিলেন। কিছু মিডিয়াও নিশ্চিতই সম্মতি আদায়ের চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছে। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে যা হয়েছে তা হল, মানুষ রাগে ফুঁসছে। সে যুদ্ধ দেখলেই লাফিয়ে খবর পড়ছে বা শুনছে। সুতরাং প্রতিযোগিতাময় ও ব্যবসায় টিকে থাকতে মিডিয়া আবারও সেই সহজ পথ ধরেছে, লোকে যা চায়। লোকে যা চায় না তা আদায়ের চেষ্টা যেমন অপরাধ, তেমনই লোকে যা চায় তাই দিতে হচ্ছে বলে যদি কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়, তবে তা নিশ্চিতই আয়রনি।
এবং বুদ্ধিবাদী সংস্কৃতির স্রোতে এই ‘লোক’ নিজের গা বাঁচিয়ে ভারত-অস্ট্রেলিয়া ম্যাচের দিকে চলে যাবে। কিন্তু সমস্যা থেকে মুখ ফিরিয়ে থাকলে, পরবর্তী সময়ে যে আবার একই পরিস্থির উদ্ভব হবে না, তার তো কোনও গ্যারান্টি নেই। সুতরাং মিডিয়াকে অপরাধী করার সঙ্গে সঙ্গে বোধহয়, লোকের এবং তার একক হিসেবে আমাদের প্রত্যেকের দায়িত্ববোধে আলো ফেলারও সময় হয়েছে। প্রশ্ন করার সময় হয়েছে যে, মিডিয়াকে তথাকথিত যুদ্ধবাজ হয়ে উঠতে আমরাই গোপনে ইন্ধন দিচ্ছি না তো?
সোশ্যাল মিডিয়া ও জনরুচির নিরিখেই মিডিয়ার এই বদলের যুক্তিকে হয়তো অতিসরলীকরণ বলবেন অনেকেই। তবুও প্রাসঙ্গিক আরও দু-একটা কথা বলা বোধহয় অনুচিত হবে না। এই কিছুদিন আগে পর্যন্তও গোষ্ঠী সংঘর্ষের খবর পরিবেশিত হত অতি সাবধানে। কারণ তা সেনসিটিভ। ক্রমে সোশ্যাল মিডিয়ার উত্তুঙ্গ জনপ্রিয়তার মধ্যে দেখা গেল, ‘দাঙ্গা’ কথাটি বহু শিক্ষিত মানুষ দায়িত্ব নিয়ে ছড়িয়ে দিচ্ছেন। সে সম্পর্কিত তথ্য শেয়ার করছেন, যা আরও উত্তেজনা তৈরি করতে পারে। এমন ছবি ছড়াচ্ছেন সকলে, যা ছড়ানো উচিত নয়। কিন্তু এ মাধ্যমে সম্পাদনার বালাই নেই। অতএব একসময় এটাই রেওয়াজ হয়ে দাঁড়াল। যে কোনও বীভৎস ঘটনার ছবি বা ভিডিওর উপর লোকদেখানো একটা পর্দা ফেলে সেই নিষ্ঠুরতা ছড়িয়ে দেওয়া হল নির্বিচারে। ক্রমে আমরা অভ্যস্ত হয়ে পড়লাম এই বীভৎসতায়। তা আর আমাদের মধ্যে তত আলোড়ন ফেলে না।
মূলস্রোতের মিডিয়াও এখান থেকে খানিকটা রাখঢাক ঝেড়ে ফেলতে শিখল। যে কারণে সে সাবধানী ছিল, সেই উদ্দেশ্যই আজ আর পূরণ হওয়ার নয়। বরং উলটে তার উপর এই চাপ দেওয়া হল যে, যখন ছবি আছে ভিডিও আছে, যখন লোকে সব জানে, তখন মিডিয়া জেনেও চুপ করে আছে। খেমটাই যখন চলছে, তখন ঘোমটার কী মানে? এই প্রশ্নের মুখেই মূলস্রোতের মিডিয়া অনেকখানি বদলেছে। তার ভাষাতেও আজ যে পরিবর্তন তা মিডিয়াকর্মীদের অশিক্ষা হেতু নয়। আজ কথায় কথায় অন্য পেশার মানুষ মিডিয়াকর্মীদের উদ্দেশ্যে বলেন, এরা কি মাধ্যমিকও পাশ করে নি? এদের কী যোগ্যতা? ঘটনা হল, মিডিয়া কর্মীর কাজের ঠিক-ভুল সবই প্রকাশ্য। যিনি বা যাঁরা এ প্রশ্ন তোলেন, তাঁরা কি হলফ করে বলতে পারেন, কর্মজীবনে তাঁরা একটিও ভুল করেন নি?
যাই হোক, প্রসঙ্গে ফিরি। আজ মিডিয়ার ভাষার উৎস তলিয়ে দেখতে গেলে দেখব মানুষের মুখের ভাষাতেও অনেক পতন এসেছে। গালিগালাজ নয়, এসেছে প্রকাশভঙ্গিতে। এসেছে তার শালীনতায়। এই গূঢ় সংযোগ অস্বীকার করে মিডিয়ার সমালোচনা করা অনর্থক কেবল নয়, সময়ের অপব্যয়ও বটে।
কিন্তু তাহলে কি মিডিয়া শুধু লোকে যা চায় – এই মন্ত্র মেনেই চলবে? নিশ্চিত নয়। সে তার দায়িত্ব পালন করেই চলবে। আলো ফেলার কাজ নিশ্চয়ই করবে। তবে একটা প্রসঙ্গ এখানে অবধারিত উঠে আসে। তা হল, সেই কাজ মানুষের সমর্থন পাবে তো? কেন বলছি? সাংবাদিক পরঞ্জয় গুহঠাকুরতা কিছুদিন আগে ইকোনমিক অ্যান্ড পলিটিক্যাল উইকলির সম্পাদকের পদ থেকে সরে দাঁড়িয়েছিলেন। নেপথ্য কারণটি ছিল, এক বৃহৎ শিল্পগোষ্ঠীর আর্থিক অনিয়ম এবং তার সঙ্গে সরকারের সম্পর্ক নিয়ে তিনি কলম ধরেছিলেন। ওই গোষ্ঠী মানহানির মামলার উল্লেখ করে চিঠি (পড়ুন হুমকি) পাঠানোর পরই সম্পাদক এই সিদ্ধান্ত নেন। পারিবারিক কারণ দেখিয়ে সরে যান। তাঁর লেখাটিও সরিয়ে ফেলতে হয়। কর্পোরেটের বলি সংবাদমাধ্যমকে যে হতে হয়, এই বোধহয় ছিল তার প্রকৃষ্ট ও একদম উপরের স্তরের উদাহরণ।
কিন্তু সেদিন নাগরিক সমাজ কি দায়িত্ব পালন করেছিল? যে নাগরিক সমাজ কুকুর, বিড়াল মায় গাছের জন্যও মঞ্চ বেঁধে প্রতিবাদী কবিতা বলে, তা কি এক সাংবাদিকের কাজের স্বাধীনতার পক্ষ নিয়ে সুসংবদ্ধ প্রতিবাদের পথে গিয়েছিল? যা দেখে দেশের সংবাদমাধ্যম ও সাংবাদিকরা সাহস পেতে পারতেন যে, জনগণের শক্তি তাঁদের সঙ্গে আছে, ফলে তাঁরা তাঁদের দায়িত্বে অটল থাকতে পারেন। গৌরী লঙ্কেশ বা সুজাত বুখারির নাম হয়তো শোনা। কিন্তু নবীন নিশ্চল, অচ্যুৎ নন্দ সাহু, চন্দন তিওয়ারি, সন্দীপ শর্মাদের মৃত্যুর বিরুদ্ধে একটাও প্রতিবাদী মঞ্চ কি তৈরি হয়েছে? সিনেমার নিরিখে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ে যে বুদ্ধিজীবী সমাজ উদ্বেল হয়ে ওঠেন, তাঁরা কি বিন্দুমাত্র উদ্বিগ্ন হয়েছেন যখন একের পর এক কেলেঙ্কারির কথা সামনে এনে খুন হতে হয়েছে এই সাংবাদিকদের? সর্বক্ষেত্রে স্বাধীনতার অনুশীলনকারী সোশ্যাল মিডিয়া কি একটাও পিটিশন তৈরি করে এর প্রতিবাদ জারি করেছে, যেমনটা এই মাধ্যমের অতিসক্রিয় জনতা কুকুরের গায়ে আঁচড় লাগলে করেন?
কেউ যে করেন নি, তা বলতে পারি না। কিন্তু তা যে সার্বিক চিত্র নয়, তা আমরা সবাই জানি। ফলে এই সংশয়ের মুখে, এই বৃহৎ শিল্পগোষ্ঠীদের চাপের মুখে মিডিয়ার পক্ষে তার কাজ করে যাওয়া যে কতটা কঠিন, তা নিশ্চয়ই বুঝতে অসুবিধা হয় না। কেন তাকে 'লোকে চায়'-এর মন্ত্রে পুষ্পাঞ্জলি দিতে হয় তাও স্পষ্ট। অবস্থা বদলাত যদি মানুষ মিডিয়ার পাশে থাকত। দুর্ভাগ্য, তারা যতখানি সোশ্যাল মিডিয়ার, ততখানি মিডিয়ার নয়। ফলে এক ব্যূহ রচনা হয়েছে। যাকে অবহেলা করে যাওয়ার অর্থ গণতন্ত্রের একটি বড় শক্তির অপচয়কে ইন্ধন দিয়ে চলা। জনতা এই অপরাধ থেকে মুক্ত হতে পারে না।
সোশ্যাল মিডিয়া বা তার ব্যবহারকারীদের অভিযুক্ত করা এ লেখার উদ্দেশ্য নয়। বরং দোষারোপের পালা ছেড়ে আমরা যাতে পারস্পরিক সম্পর্কটিকে ঝালিয়ে নেওয়া যায়, সেটাই উপপাদ্য। আজ যখন মিডিয়াকে ক্রমাগত যুদ্ধবাজ, শয়তান বনে হচ্ছে, আসুন Bertolt Brecht-এর এই কবিতাটিতে চোখ রাখি:
On my wall hangs a Japanese carving,
The mask of an evil demon, decorated with gold lacquer.
Sympathetically I observe
The swollen veins of the forehead, indicating
What a strain it is to be evil.
অপ্রতিদ্বন্দ্বী মেধায় Brecht এখানে শয়তানের সঙ্গে সিমপ্যাথি কথাটি আনতে পেরেছেন। আনতে পেরেছেন, তার কপালে ফুলে ওঠা শিরার কথা। এনেছেন শয়তান হয়ে থাকার যন্ত্রণার কথা। হয়তো এরপর যখন টিভি চালাবেন, মনে পড়বে ওই মুখোশ আর তার কপালের ফুলে ওঠা শিরার কথা। শয়তান শব্দটিও হয়তো আনাগোনা করবে। শুধু সমবেদনা শব্দটিকে তখন আবার ভুলে যাবেন না তো?
(লেখক একটি প্রকাশনা সংস্থার সম্পাদক, মতামত ব্যক্তিগত)