"এক সভা থেকে আরেক সভায় ভ্রমণ করতে করতে আমার শ্রোতাদের আমি শোনাতাম আমাদের এই ইন্ডিয়ার কথা, যা হিন্দুস্তান এবং ভারত, আমাদের জাতির পৌরাণিক প্রতিষ্ঠাতাদের নামে দেশের প্রাচীন সংস্কৃত নাম।"
ভারতের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করে লেখা তাঁর 'দ্য ডিসকভারি অফ ইন্ডিয়া' গ্রন্থে এই কথা লেখেন পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু। দেশ তখন স্বাধীন হওয়ার মুখে। মনে করা হয় যে ভারতের বর্ণনা দিতে গিয়ে নেহরু সচেতনভাবে সেই সমস্ত নাম নথিভুক্ত করেন যেগুলি গড়ে তুলেছে ভারতের পরিচিতি, এবং যেগুলির উর্ধ্বে বরাবর রয়েছে দেশের নাগরিক ঐক্য। বইটি প্রকাশিত হওয়ার চার বছর পর গঠিত হয় স্বাধীন ভারতের সংবিধান, যার প্রথম অনুচ্ছেদে নেহরু দ্বারা উল্লেখিত তিনটি নামের মধ্যে একটি বাদ দিয়ে বলা হয় - 'ইন্ডিয়া, অর্থাৎ ভারত, বিভিন্ন রাজ্যের সমষ্টি হবে।'
আজ সাত দশক পরে দেশের নাম নিয়ে ফের শুরু হয়েছে আলোচনা, যার মূলে রয়েছে দিল্লির এক ব্যবসায়ীর আদালতের কাছে আবেদন যে সংবিধানের প্রথম অনুচ্ছেদ সংশোধন করা হোক। এর সমর্থনে তিনি যে যুক্তি দিয়েছেন, তার সারমর্ম হলো, প্রতীকী হলেও এই অনুচ্ছেদ থেকে ইংরেজি নামটা সরিয়ে দিলে আমাদের জাতির প্রতি গর্ব অনুভূত হবে, বিশেষত পরবর্তী প্রজন্মদের ক্ষেত্রে। তাছাড়াও 'ইন্ডিয়া'র বদলে 'ভারত' ব্যবহার করলে আমাদের পূর্বপুরুষদের কষ্টার্জিত স্বাধীনতার প্রতিও সম্মান দেখানো হবে।
দক্ষিণ এশীয় উপমহাদেশের ক্ষেত্রে তিনটি সবচেয়ে ব্যবহৃত নাম - ইন্ডিয়া, ভারত, এবং হিন্দুস্তান - বাদ দিলেও, বিভিন্ন সময়ে এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক-সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে একাধিক নাম ব্যবহার করা হয়েছে ভারত বা তার বিভিন্ন ভৌগোলিক অংশের বিবরণে। ফলত, যখন সংবিধান লেখা হচ্ছে, সেসময় দেশের নামকরণ নিয়ে তীব্র বিতর্কের সৃষ্টি হয়, যাতে ভারতের নানা বৈচিত্র্যময় জনগোষ্ঠীকে সন্তুষ্ট রাখা যায়।
ভারতের নানা নাম
আজ যে ভৌগোলিক অস্তিত্বকে 'ইন্ডিয়া' নামে অভিহিত করা হয়, বিগত শতাব্দীগুলিতে তা কিন্তু কখনোই একটি ধারাবাহিক অস্তিত্ব ছিল না। পণ্ডিতেরা হামেশাই বলেছেন যে ভারতীয় উপমহাদেশের সঙ্গে যুক্ত প্রাচীনতম নামগুলির একটি হলো মেলুহা, যে নাম ব্যবহৃত হয়েছে খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় সহস্রাব্দে লেখা প্রাচীন মেসোপটেমিয়ার গ্রন্থে, সিন্ধু সভ্যতা বা ইন্ডাস ভ্যালি সিভিলাইজেশনের বর্ণনায়।
তবে এই অঞ্চলে আধুনিক রাজনৈতিক ব্যবস্থা প্রচলিত হওয়ার অনেক আগেই নাম হিসেবে বিলুপ্ত হয়ে যায় মেলুহা। প্রাচীনতম যে নামের এখনও চর্চা হয়ে থাকে, তা হলো 'ভরত', 'ভারত', অথবা 'ভারতবর্ষ', যে নাম ভারতের সংবিধানেও ব্যবহার করা হয়েছে। এই নামের উৎস যদিও পৌরাণিক সাহিত্য, বিশেষ করে মহাভারত, তা সত্ত্বেও আধুনিক যুগে এর জনপ্রিয়তার কারণ হলো স্বাধীনতা সংগ্রামে 'ভারত মাতা কি জয়' জাতীয় স্লোগানে এর ধারাবাহিক প্রয়োগ।
'India, that is Bharat…': One Country, Two Names' শীর্ষক প্রতিবেদনে ক্যাথারিন ক্লেমেনট্যাঁ-ওঝা লিখছেন, ভারত বলতে বোঝায় একটি "অঞ্চল-নির্বিশেষে উপমহাদেশীয় ভূমি যেখানে ব্রাহ্মণ্যবাদী সমাজের প্রাধান্য"। পুরাণে বলা আছে, ভারতের ভৌগোলিক বিস্তার 'দক্ষিণে সমুদ্র থেকে উত্তরে হিমের আলয়' পর্যন্ত। তবে এর আকার এবং আয়তন বিভিন্ন যুগে পরিবর্তিত হয়েছে। সেদিক থেকে দেখতে গেলে ওঝার বর্ণিত ভারত ঠিক রাজনৈতিক বা ভৌগোলিক ভূমি নয়, বরং একটি ধর্মীয় এবং সামাজিক-সাংস্কৃতিক পরিচয়। তবে একথাও সত্য যে এই জাতির পৌরাণিক পিতা ছিলেন ভরত, এই বিশ্বাসও রয়েছে।
বৈদিক সাহিত্যে কিন্তু আরও কিছু নামের উল্লেখ রয়েছে। যেমন মনুস্মৃতি গ্রন্থে যে 'আর্যাবর্তের' কথা বলা হয়েছে, তা হলো আর্যদের দ্বারা অধিকৃত উত্তরে হিমালয় এবং দক্ষিণে বিন্ধ্যপর্বতের মধ্যবর্তী ভূখণ্ড। এছাড়াও প্রাচীন সাহিত্যে পাওয়া যায় 'জম্বুদ্বীপ' নামটি, অর্থাৎ 'জামগাছের ভূমি'। এই নামটি দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার কিছু দেশে আজও ব্যবহৃত হয় ভারতীয় উপমহাদেশের বর্ণনায়।
ওদিকে জৈন সাহিত্যেও ভারত নামের উল্লেখ রয়েছে, কিন্তু একথাও বলা হয়েছে যে এই দেশের নাম আগে ছিল 'নভিবর্ষ'। "রাজা নভি ছিলেন (প্রথম তীর্থঙ্কর) ঋষভনাথের পিতা এবং ভরতের পিতামহ," তাঁর বই 'Mapping Place Names of India'-তে লিখেছেন ভূগোলবিদ অনু কাপুর।
নাম হিসেবে 'হিন্দুস্তান' প্রথম, যাতে রাজনৈতিক রঙের আভাস পাওয়া যায়। প্রথম এই নাম ব্যবহৃত হয় যখন খ্রিস্টপূর্ব সপ্তম শতাব্দীতে সিন্ধু উপত্যকা অধিকার করে পারসিকরা, অর্থাৎ পারস্য দেশের বাসিন্দা। সংস্কৃত 'সিন্ধু' শব্দটি তাদের মুখে মুখে হয়ে যায় 'হিন্দু'। প্রথম খ্রিস্টাব্দ থেকে এই নামের সঙ্গে পার্সি প্রত্যয় 'স্তান' জুড়ে তৈরি হয় 'হিন্দুস্তান'।
পাশাপাশি পারসিকদের মুখে শোনা 'হিন্দ' নামটির আক্ষরিক অনুবাদ করে 'ইন্ডাস' করেন গ্রীকরা। ম্যাসেডোনিয়ার রাজা অ্যালেকজান্ডার খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দীতে যখন ভারত আক্রমণ করেন, ততদিনে সিন্ধুনদ পার করে যে অঞ্চল, তার নাম হয়ে গেছে 'ইন্ডিয়া'।
ষোড়শ শতাব্দী নাগাদ দেখা যায়, বেশিরভাগ দক্ষিণ এশীয়ই তাঁদের বাসভূমির পরিচয় দিচ্ছেন 'হিন্দুস্তান' হিসেবে। 'From Hindustan to India: Naming change in changing names' শীর্ষক একটি প্রতিবেদনে ঐতিহাসিক ইয়ান যে ব্যারো লিখেছেন যে "অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকে শেষ পর্যন্ত হিন্দুস্তান বলতে বোঝাত মোগল সম্রাট অধিকৃত ভূমি, যা ছিল দক্ষিণ এশিয়ার সিংহভাগ"। তবে ওই শতাব্দীর শেষ দিক থেকে ব্রিটিশদের তৈরি মানচিত্রে বেশি করে দেখা যেতে লাগল 'ইন্ডিয়া' নামের ব্যবহার, এবং দক্ষিণ এশিয়ার সঙ্গে 'হিন্দুস্তানের' যোগসূত্র ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হতে থাকল।
গ্রীক-রোমান উৎস, ইউরোপে এই নাম ব্যবহারের দীর্ঘ ইতিহাস, বা সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার মতো তৎকালীন বৈজ্ঞানিক এবং প্রশাসনিক সংস্থা দ্বারা এর ব্যবহার, এই সব কারণেই বাড়তে থাকে 'ইন্ডিয়া' নামের আকর্ষণ, বলছেন ব্যারো। তিনি আরও লিখেছেন, 'ইন্ডিয়া' নামটিকে যেভাবে গ্রহণ করা হয়, তার দ্বারা ঔপনিবেশিক নামকরণের মাধ্যমে কীভাবে এই উপমহাদেশকে একটি একক ব্রিটিশ রাজনৈতিক ভূখণ্ডে পরিণত করা হয়, তার প্রমাণ মেলে।
স্বাধীন ভারতের নামকরণ বিতর্ক
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ২৯ অগাস্ট, ১৯৪৯ সালে বিআর আম্বেদকরের নেতৃত্বে গঠিত হয় কন্সটিটুয়েন্ট অ্যাসেম্বলি, যার কাজ ছিল সংবিধানের খসড়া তৈরি করা। তবে দেশের নাম এবং ক্ষেত্র সংক্রান্ত আলোচনা শুরু হয় ১৭ সেপ্টেম্বর, ১৯৪৯। এবং একেবারে প্রথম থেকেই, প্রথম অনুচ্ছেদে ‘India, that is Bharat shall be a union of states’ বাক্যটি নিয়ে অ্যাসেম্বলির সদস্যদের মধ্যে বিভাজন দেখা দেয়।
ফরোয়ার্ড ব্লকের সদস্য হরি বিষ্ণু কামাথ পরামর্শ দেন, প্রথম অনুচ্ছেদে ‘Bharat, or in the English language, India, shall be and such' বলা হোক। আবার মধ্যপ্রদেশ এবং বেরারের প্রতিনিধি শেঠ গোবিন্দ দাসের প্রস্তাব ছিল: “Bharat known as India also in foreign countries”। ওদিকে ইউনাইটেড প্রভিন্সেস (পরবর্তীকালে উত্তরপ্রদেশ)-এর পাহাড়ি অঞ্চলের প্রতিনিধি হরগোবিন্দ পন্থ স্পষ্ট করে দেন যে উত্তর ভারতের মানুষ 'ভারতবর্ষ ছাড়া আর কিছুই চান না'।
পন্থের বক্তব্যের সারমর্ম: "আমি বুঝতে পারছি না, কিছু সদস্যের 'ইন্ডিয়া' শব্দটির প্রতি কেন এত টান। আমাদের জানা আবশ্যক যে এই নামটি বিদেশীদের দেওয়া, যারা এই ভূমির অশেষ ধনসম্পত্তির লোভে এখানে আসে, এবং আমাদের স্বাধীনতা কেড়ে নেয়। তা সত্ত্বেও যদি আমরা 'ইন্ডিয়া' আঁকড়ে ধরে থাকি, তবে তা থেকে এই প্রমাণ হয় যে আমরা এই অপমানজনক শব্দটি ব্যবহার করতে লজ্জিত নই, যা আমাদের ওপর চাপিয়ে দিয়েছে বিদেশি শাসক।"
উপরোক্ত প্রস্তাবগুলির কোনোটিই গৃহীত হয় নি, তবে ওঝা যেমন লিখেছেন, "সদ্য বিকশিত রাষ্ট্র সম্পর্কে পরস্পরবিরোধী দর্শন" দেখা যায় এক্ষেত্রে। উল্লেখযোগ্য ভাবে, বিতর্কে কোথাও স্থান পায় নি 'হিন্দুস্তান'।
সংবিধান লাগু হয়ে যাওয়ার পরেও থেমে যায় নি বিতর্ক। উদাহরণস্বরূপ, ২০০৫ সালে অবসরপ্রাপ্ত আইএএস অফিসার তথা ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক ভি সুন্দরম একটি প্রতিবেদনে লেখেন যে 'ইন্ডিয়া' নামের অবসান ঘটিয়ে 'ভারত' ব্যবহার করা উচিত। ওঝা লিখছেন, "ভি সুন্দরমের মতে, 'ভারত' শব্দটিকে বড্ড বেশি হিন্দু ভাবাপন্ন মনে করেছিলেন সংবিধানের স্রষ্টারা, সুতরাং 'ইন্ডিয়া' রাখা হয়েছিল সংখ্যালঘুদের আশ্বাস দিতে যে তাঁদের ওপর হিন্দুত্ব চাপানো হবে না। কিন্তু তাঁর মতে এটি ভ্রান্ত ধারণা: ভারত শব্দটির মধ্যে কোথাও সাম্প্রদায়িক ছোঁয়া নেই, সুতরাং দেশের একমাত্র সরকারি নাম ভারত হওয়া উচিত।"
২০১২ সালে রাজ্যসভায় ওই একই প্রস্তাব দিয়ে একটি বিল পেশ করেন কংগ্রেসের শান্তারাম নায়েক। তাঁর যুক্তি, "ইন্ডিয়া বলতে বোঝায় একটুকরো ভূখণ্ড, যেখানে ভারত কিন্তু ভূখণ্ডের চেয়ে অনেকটা বেশি কিছু। আমরা যখন দেশের জয়গান করি, তখন বলি 'ভারত মাতা কি জয়', 'ইন্ডিয়া কি জয়' বলি না।"
নাম বদলের ক্ষেত্রে সর্বশেষ আবেদনটি ফের একবার বাতিল করেছে সুপ্রিম কোর্ট এই ভিত্তিতে যে "সংবিধানেই ইন্ডিয়াকে ভারত বলা হয়েছে", সুতরাং আদালতের কিছু করনীয় নেই, তবে আবেদনকারীকে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে, তিনি যেন কেন্দ্রের কাছে তাঁর আবেদন জমা দেন।
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন