/indian-express-bangla/media/post_attachments/wp-content/uploads/2019/08/0.jpg)
গুপ্তযুগ। ব্যস্ত তাম্রলিপ্ত বন্দর। দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্যিক যোগাযোগের কেন্দ্রস্থল। তরী এসে ভে়ড়ে এখানে, পসরা ওঠা নামা করে। তামার বাণিজ্য থেকেই নাম তাম্রলিপ্ত। গুপ্ত যুগ ভারতের স্বর্ণযুগ। বিকাশ লাভ করেছিল হিন্দু, বৌদ্ধ এবং জৈনধর্ম। তখন থেকে মেদিনীপুর অঞ্চলের প্রসিদ্ধি লাভ। আর সমৃদ্ধি কংসাবতী নদীর তীরে অখ্যাত পাথরা গ্রামের। মেদিনীপুর থেকে দশ কিলোমিটার দূরের সেই গ্রামে আজও দেখা মেলে আড়াইশো বছরেরও বেশি পুরানো স্থাপত্য কীর্তির।
এ অঞ্চলের মোড় ঘুরে যায় ১৭৩২ সালে। তখন বাংলার নবাব আলিবর্দী খাঁ। তিনি বিদ্যানন্দ ঘোষালকে নিযুক্ত করলেন রত্নাচক পরগণার কর আদায়ের জন্য। বিদ্যানন্দ ঘোষাল ধর্মপ্রাণ মানুষ ছিলেন। কর আদায়ের সঙ্গে সঙ্গে পাথরা গ্রামে কংসাবতী নদীর তীরে প্রতিষ্ঠা করলেন এক মন্দির। তীর্থযাত্রীদের আনাগোনা শুরু হলো। মন্দির প্রতিষ্ঠার কারণে বিদ্যানন্দের সুনাম ছড়ালেও তাঁর কাজে নবাব আলিবর্দী খাঁ মোটেই সন্তুষ্ট ছিলেন না। রাজস্বের টাকা তিনি ঠিকঠাক না জমা দিয়ে তা মন্দির নির্মাণে ব্যয় করেছিলেন। নবাব তাঁকে গ্রেপ্তার করে জেলে পাঠান ও শেষপর্যন্ত মৃত্যুদণ্ড দেন।
/indian-express-bangla/media/post_attachments/wp-content/uploads/2019/08/1-17.jpg)
/indian-express-bangla/media/post_attachments/wp-content/uploads/2019/08/1A.jpg)
কথিত আছে, হাতির দ্বারা পদপিষ্ট করে তাঁর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। জনশ্রুতি, হাতি তাঁর শরীরে পা তুলতে গিয়েও সরিয়ে নেয়, তাই থেকে গ্রামের নাম 'পা উতরা', ক্রমে পাথরা। মন্দির নির্মাণের ধারা বিদ্যানন্দের বংশধরেরা এগিয়ে নিয়ে চলেন। তাঁরা তাঁদের পদবী পরিবর্তন করে মজুমদার করে নেন। পরিবারের আরেক ধারা বন্দোপাধ্যায় পদবীধারী, তাঁরাও মন্দির নির্মাণ কাজ চালিয়ে যান পাথরা গ্রামে। বংশধরদের অর্থের অভাব ছিল না, নীল চাষ এবং রেশমের ব্যবসায় তাঁরা প্রচুর উন্নতি করে প্রভাব ও প্রতিপত্তিশালী হয়ে ওঠেন।
আরও পড়ুন: হাওড়ার রাসবাড়িতে রাধাকৃষ্ণের ঘরগেরস্থালি
আঠারো শতকের শেষে মন্দির নির্মাণ থেমে গেল, কারণ এই ধনী পরিবার ক্রমশ গ্রাম ছেড়ে অন্যত্র গমন করা শুরু করলেন। ক্রমে পাথরা গ্রাম ও তাম্রলিপ্ত বন্দর কালের নিয়মে গুরুত্ব হারাল। বন্দরের মতো মন্দিরগুলিও পরিত্যক্ত হয়ে গেল।
মন্দিরগুলিতে যথেচ্ছ লুটপাট শুরু হলো। অনেক মন্দির ধ্বংসস্তুপে পরিণত হলো। বাঁচিয়ে রাখা গেছে ৩৪টি মন্দির। মন্দির বাঁচানোর ক্ষেত্রে পাশের গ্রামের ইয়াসিন পাঠানের ভুমিকা অনস্বীকার্য। ভিন্নধর্মাবলম্বী হয়েও মন্দির রক্ষার উদ্যোগ নেওয়ায় স্বধর্মের মানুষদের বিরূপতার সম্মুখীন হতে হয়েছে তাঁকে, মৃত্যুর হুমকি পর্যন্ত শুনতে হয়েছে। কিন্তু হার মানেন নি ইয়াসিন পাঠান। অবশেষে আর্কিওলজিকাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া (ASI)-কে উপলব্ধি করাতে সক্ষম হন, ফলত আজ ৩৪টি মন্দিরের মধ্যে ২৮টি মন্দির ASI-এর তত্ত্বাবধানে এবং ইতিমধ্যেই এই সংস্থা ২৮টির মধ্যে ১৮টির যথাযথ পদ্ধতি মেনে সংস্কার করেছে।
/indian-express-bangla/media/post_attachments/wp-content/uploads/2019/08/2-1-3.jpg)
/indian-express-bangla/media/post_attachments/wp-content/uploads/2019/08/3-9.jpg)
এছাড়াও ইয়াসিন পাঠান এবং স্থানীয় গ্রামগুলির হিন্দু-মুসলমান দুই সম্প্রদায়ের মানুষদের পাশে নিয়ে ১৯৮৬ সালে গঠিত হয় একটি বেসরকারি সংস্থা, Pathra Archaeological Preservation Committee, সেটিও মন্দিরগুলির রক্ষণাবেক্ষণ করে। ১৯৬০ সালের মধ্যভাগ থেকেই মন্দিরগুলি সরকারী সাহায্য ও আইআইটি খড়গপুরের কারিগরী সহায়তা পেতে শুরু করে। আর ইয়াসিন পাঠান, যিনি স্থানীয় একটি স্কুলে পিয়নের চাকরী করতেন, সরকারের থেকে ১৯৯৪ সালে তাঁর অসামান্য প্রয়াসের জন্য কবীর সম্মান পান।
ভারতে যে সব প্রাচীন মন্দিরের নিদর্শন পাওয়া যায়, সেগুলি পাথর বা ইটের তৈরী। বাংলায় পাথরের ব্যবহার পাওয়া গেলেও এঁটেল মাটির প্রতুলতার জন্য মাটি পুড়িয়ে ইট তৈরী সহজ ছিল। তাই পোড়ামাটির অর্থাৎ ইটের মন্দিরের আধিক্য। পাথরার মন্দিরগুলিও মূলত ইটের তৈরী। বাংলা মন্দিরের চূড়া বা ছাদ নির্মাণে মূলত তিন ধরনের আঙ্গিক দেখা যায়। যেমন চালা। বারো চালা অবধি মন্দির দেখা যায়। আবার চালা এবং শিখররীতির মিলিত ফল 'রত্ন', যা বেজোড় সংখ্যক হয়। একরত্ন থেকে শুরু করে পঞ্চবিংশ রত্ন অবধি উদাহরণ পাওয়া যায়। এছাড়াও আছে বাংলায় সমতল ছাদের দালান রীতি।
/indian-express-bangla/media/post_attachments/wp-content/uploads/2019/08/4-6.jpg)
/indian-express-bangla/media/post_attachments/wp-content/uploads/2019/08/5-5.jpg)
/indian-express-bangla/media/post_attachments/wp-content/uploads/2019/08/5A.jpg)
চুনসুরকির গাঁথুনির ব্যবহার তুর্কী আক্রমণের সময় থেকে বাংলায় প্রচলিত। আর কুলুঙ্গি, খিলান, নিচু ও মোটা থাম পাঠান যুগের রীতির পরিচায়ক। আর একটি রীতি বৈষ্ণবদের আমল থেকে চলে আসছে, তা হলো মঞ্চরীতি। উদাহরণ তুলসীমঞ্চ, রাসম়়ঞ্চ, দোলমঞ্চ। পাথরায় চালা, দালান, রত্ন, রাসমঞ্চসহ সমস্ত আকারের মন্দিরের উদাহরণ পাওয়া যায়। এছাড়া এখানকার বিশেষ আকর্ষণ টেরাকোটার প্যানেল বা ফলক।
মাটির ফলকে বিভিন্ন নকশা এঁকে তারপর সেগুলিকে পোড়ানো হতো। এই পোড়ামাটির ফলকগুলি চুনসুরকি দিয়ে মন্দিরগাত্রে আটকে দেওয়া হতো। কিছু ক্ষেত্রে ইটটিকেও প্রয়োজনীয় নকশা করে তারপর পুড়িয়ে নকশার ধরন অনুযায়ী পরপর বসানো হতো। বেশ খানিক নষ্ট হয়ে গেলেও চোখে পড়ে পঙ্খের কাজ। চুন, বালি, চিটেগুড়, পাকা কলা, জায়ফল, হরিতকী, খয়ের, সুরকিগুড়ো, শাঁখ, ঝিনুকের মিহি গুঁড়ো ইত্যাদি মিশিয়ে তৈরী হতো পঙ্খ। এই মিশ্রন দিয়ে মন্দিরগাত্রে নকশা আঁকা হতো।
/indian-express-bangla/media/post_attachments/wp-content/uploads/2019/08/6-3.jpg)
/indian-express-bangla/media/post_attachments/wp-content/uploads/2019/08/7-3.jpg)
/indian-express-bangla/media/post_attachments/wp-content/uploads/2019/08/8-1.jpg)
পাথরা মন্দিরগুলি দু-তিনটি কমপ্লেক্সে বিভক্ত। কংসাবতী নদীতীরে কয়েকটি, রাস্তার অপরপারে বেশ ক'টি, এবং খানিক দূরে গ্রামের মধ্যে রাসমঞ্চ এবং অন্যান্য মন্দির। প্রথমে নদীর উত্তর তীরে দক্ষিণমুখি একটি উনিশ শতকের পঞ্চরত্ন মন্দির। ঢালু চালার উপরে চারদিক খোলা চারটি রত্ন। কেন্দ্রে একই আকারের একটি বড় রত্ন। প্রবেশপথে তিনটি খিলান। একগুচ্ছ গোলাকার থাম খিলানগুলিকে ধরে রেখেছে। তাদের মাথায় বিলুপ্তপ্রায় পঙ্খের কাজ। তার উপরে টেরাকোটার ফলক। মন্দিরের কোণায় পাতলা ইটের ব্যবহারও নজরে আসে।
কালাচাঁদ মন্দির চত্ত্বরে আছে সবথেকে উঁচু এবং চিত্তাকর্ষক নবরত্ন মন্দির। এটি আঠেরো শতকে মজুমদার বংশের প্রতিষ্ঠিত। নদীর উত্তর তীরে অবস্থিত। প্রবেশপথে তিনটি খিলানকে দুটি খর্বাকৃতি থাম ধরে রেখেছে।থামগুলি ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়ে যাওয়ায় ASI সংস্কার করেছে। এটি চল্লিশ ফুট উঁচু। প্রথম ধাপে চার কোণে চারটি রত্ন। তারপর আবার নীচের মতই ত্রিখিলান এবং মাথায় চালা, তার উপরে আবার চার কোণে চারটি রত্ন। সবার উপরে বড় একটি রত্ন। মন্দিরের ভেতরের গায়ে পঙ্খের কাজ ও থামের মাথায় ফুলের উল্টনো পাপড়ি। আছে মুসলিম ধারায় প্রভাবিত কুলুঙ্গী।
/indian-express-bangla/media/post_attachments/wp-content/uploads/2019/08/9-2.jpg)
/indian-express-bangla/media/post_attachments/wp-content/uploads/2019/08/10-2.jpg)
/indian-express-bangla/media/post_attachments/wp-content/uploads/2019/08/11-1.jpg)
উঁচু ভিতের উপরে স্থাপিত এই নবরত্ন মন্দিরের একপাশে তিনটি সমতল ছাদের মন্দিরও রয়েছে। সম্ভবত এগুলি শিবমন্দির। ১৮১৬-তে প্রতিষ্ঠিত একটি ছোট আটচালা মন্দিরও আছে এই চত্ত্বরে। অপরপারে তুলনায় ছোট নবরত্ন মন্দির। এটি শিবের মন্দির। তিনটি ছোট আটচালা মন্দির। বড় চারচালা ছাদ আর তার ওপরে আরেকটি ছোট চারচালা ছাদ। এই নিয়ে আটচালা। রয়েছে সমতল ছাদের দালান রীতিতে তৈরী মন্দির, দুর্গাদালান। প্রবেশপথে পাঁচটি খিলান। একটি ছোট তুলসী মঞ্চ। কিছু ধ্বংসপ্রাপ্ত পাথরের কাঠামোও নজরে আসে।
গ্রামের পথে খানিক এগোলে কতকগুলি মন্দির। এর মধ্যে পাশাপাশি তিনটি পঞ্চরত্ন মন্দিরে রয়েছে, তাদের দেওয়াল জুড়ে পঙ্খের সূক্ষ্ম নকশা। রয়েছে টেরাকোটায় তৈরী বহু মুর্তি যেমন রাম, বলরাম, রাধা-কৃষ্ণ, হনুমান, দুর্গা। এছাড়া রয়েছে পাগড়ীপরা দ্বাররক্ষক। তিনযুগের তিনরকম সৈন্য দেখা যায়, যেমন লাঠি হাতে লাঠিয়াল, তরোয়াল হাতে সৈন্য, এমনকি বন্দুকধারী সিপাহী। মন্দিরগুলিতে শিব, বিষ্ণু এবং কৃষ্ণের পূজা করা হয়। জানালা দিয়ে উঁকি দেওয়া এক মহিলার মুর্তি নজর কাড়ে, বাতায়নবর্তিনী। নবজাগরণের সময় মহিলাদের অন্তরাল থেকে বাইরের জগতে পা দেওয়ার ছাড়পত্র মেলার প্রতিফলণ বাতায়নবর্তিনীতে।
/indian-express-bangla/media/post_attachments/wp-content/uploads/2019/08/12-2.jpg)
/indian-express-bangla/media/post_attachments/wp-content/uploads/2019/08/13-1.jpg)
/indian-express-bangla/media/post_attachments/wp-content/uploads/2019/08/16-1.jpg)
কাছাকাছি একটি অষ্টভূজাকৃতি নবরত্নযুক্ত রাসমঞ্চ রয়েছে। ASI ২০০০ সালে এটির সংস্কার করে। একসময় এখানে রাসলীলা হতো। কাছারি বাড়ি আজ ভগ্নপ্রায়, তার গুপ্ত দরজাও আর নেই। কংসাবতী দিয়ে আর জাহাজ চলে না। শিব, দুর্গা, কালাচাঁদ, ধর্মরাজ, ইত্যাদি বহু মন্দিরগাত্রের গল্পকথা লোকমুখে ফিরে বেড়ায়। ১৯৬১-তে হঠাৎ খুঁড়ে পাওয়া বিষ্ণু লোকেশ্বর মন্দির মনে করিয়ে দেয়, বৌদ্ধদেরও আনাগোনা ছিল একসময় এখানে। আজও গাঁয়ের বধূ পুকুরঘাটে যে পাথরে কাপড় কাচে, সেটি হয়তো মন্দিরেরই কোন অংশ, হয়তো কারো বাড়ীতে উঁকি দিলে পাওয়া যাবে টেরাকোটার কোন ফলক। এই সব নিয়েই পাথরা গ্রাম বাঁচে নিজস্ব নিয়মে। অজ্ঞানতার নানা অচেনা ছায়ায় ঢেকে যায় পাথরার ঐতিহ্য।